বিসমিল্লাহ টাওয়েলস-প্রিমিয়ার ব্যাংকের মতো প্রাইম থেকেও অর্থ আত্মসাৎ by শেখ শাফায়াত হোসেন

প্রিমিয়ার ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীগোষ্ঠী বিসমিল্লাহ টাওয়েলস গ্রুপ প্রাইম ব্যাংক থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে। গ্রুপটির কয়েকটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন সক্ষমতার বেশি রপ্তানি দেখিয়ে অতিরিক্ত নগদ সহায়তা তুলে নিয়েছে বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ব্যাংকটির মতিঝিল শাখা পরিদর্শন করতে গিয়ে সম্প্রতি এসব অসংগতি খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকদল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিদর্শকদল সম্প্রতি প্রাইম ব্যাংকের মতিঝিল শাখা পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পায়, ওই শাখা থেকে বিভিন্ন উপায়ে ৪০৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিসমিল্লাহ টাওয়েলস গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আলপা কম্পোজিট টাওয়েলস লিমিটেড, বিসমিল্লাহ টাওয়েলস লিমিটেড ও হিন্দুল ওয়ালি টেঙ্টাইলস লিমিটেড। এ বিষয়ে একটি বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদন গত ২০ ডিসেম্বর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম মোল্লার কাছে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ঋণ অনিয়মের বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে এখনো কোনো ধরনের প্রতিবেদন পেশ করেনি বলে জানা গেছে।
এদিকে প্রিমিয়ার ব্যাংক তাদের মতিঝিল শাখা থেকে বিধিবহির্ভূত ৫৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত রবিবার রাজধানীর মতিঝিল থানায় বিসমিল্লাহ টাওয়েলস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরীন হাসিবের নামে মামলা করে। মামলায় বিসমিল্লাহ টাওয়েলস গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আলপা কম্পোজিট টাওয়েলস লিমিটেডের পরিচালকসহ ব্যাংকটির কয়েকজন কর্মকর্তাকেও আসামি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, প্রাইম ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় পরির্দশনে গিয়ে দেখা গেছে, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া ঋণপত্র স্থাপন, অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয় (ইনল্যান্ড বিল পারচেজ- আইবিপি) ও স্বীকৃত বিল ক্রয় সংক্রান্ত অনিয়মের মাধ্যমে ব্যবসায়ী এই গোষ্ঠীটি বিপুল পরিমাণের এ ঋণ দায় তৈরি করেছে। এ ছাড়া উৎপাদন সক্ষমতার বেশি রপ্তানি দেখিয়ে অতিরিক্ত নগদ সহায়তাও তুলে নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রাইম ব্যাংকের একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে জানান, বিসমিল্লাহ গ্রুপের সঙ্গে তাঁরা ২০০৫ সাল থেকে লেনদেন করে আসছেন। প্রথম দিকে এই গোষ্ঠীর লেনদেন বেশ ভালো ছিল। ইদানীং লেনদেনে কিছু সমস্যা দেখা যাচ্ছে। তবে এর মধ্যে কিছু ঋণ সমন্বয়ও করা হয়েছে। বাকিটাও আদায় করা সম্ভব হবে। কেননা ঋণের বিপরীতে যথেষ্ট জামানত নেওয়া আছে।
বিসমিল্লাহ টাওয়েলস গ্রুপকে বিধিবহির্ভূত ঋণ দেওয়ার এই ঘটনায় প্রাইম ব্যাংকের মতিঝিল শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হোসেনসহ আরো কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না তা এখনো বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়নি। এ বিষয়ে ব্যাংকটির ওই কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রাইম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বেশ শক্ত। এর আগে ব্যাংকটিতে যে দু-একটি অনিয়মের ঘটনা ঘটেছিল, সে বিষয়ে পর্ষদ কঠিন ব্যবস্থা নিয়েছিল। এ ঘটনার বিষয়েও ব্যাংক তদন্ত করছে। তদন্তে সে রকম কিছু পাওয়া গেলে কর্তৃপক্ষ নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুয়া রপ্তানির মাধ্যমে ২০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা নগদ সহায়তা তুলে নিয়েছেন খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী। মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে হাতিয়ে নেওয়া এই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলেছে সংস্থাটি। তবে নির্দেশনাকে চ্যালেঞ্জ করে ওই রপ্তানিকারক আদালতে একটি মামলা করেছেন, যা বর্তমানে বিচারাধীন বলে জানা গেছে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তিতে আবেদন করা নগদ সহায়তার আরো সাত কোটি ৩৩ লাখ টাকা আটকে আছে। এরও আগে গোষ্ঠীটি প্রায় ২২ কোটি টাকার নগদ সহায়তা তুলে নিয়েছে বলেও জানা গেছে।
গত ২০ ডিসেম্বর প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে বিসমিল্লাহ টাওয়েলস গ্রুপের ওই তিন প্রতিষ্ঠানের ঋণ অনিয়মের বিশদ বিবরণ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ব্যাংকটির মতিঝিল শাখার অন্য কয়েকটি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিষয়ও তুলে ধরা হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র মতে, হলমার্কের মতো একই পন্থা অনুসরণ করে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সুতা কিনেছে ব্যবসায়ী এই গোষ্ঠীটি। গোষ্ঠীটির এমডি খাজা সোলায়মান প্রাইম ব্যাংকের মতিঝিল শাখার মাধ্যমে স্থানীয় ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র (এলসি) খুলে বে-ইয়ার্ন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রায় ১৪০ কোটি টাকার সুতা কেনেন। অথচ এই প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি পরিদর্শনদল।
বিসমিল্লাহ টাওয়েলস গ্রুপের ঋণ অনিয়মের বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরুর সঙ্গে দুই দিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। গতকাল দুপুরে ব্যাংকটির এমডির সঙ্গে দেখা করার কথা থাকলেও দুপুরের পরপরই ব্যাংকের জনসংযোগ প্রধান ফেরদৌসী সুলতানা জানান, একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বিকেল ৪টায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বৈঠকটি একটু এগিয়ে ২টায় আনা হয়েছে। এ কারণে ব্যাংকের এমডি আজ (মঙ্গলবার) আর সময় দিতে পারবেন না।
এদিকে আলপা কম্পোজিট টাওয়েলসের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রিমিয়ার ব্যাংকের মামলার পর ওই কর্মকর্তারা আর দপ্তরে আসছেন না। সোমবার গোষ্ঠীটির প্রধান কার্যালয়ে (লেভেল-৯, ডিকে টাওয়ার, ৯৪ বীর-উত্তম সি আর দত্ত সড়ক) গিয়ে তাঁদের কারো সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। পরে গ্রুপের এমডি খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে দেখা গেছে ফোনটি বন্ধ।
ঋণ অনিয়মের বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের মতিঝিল শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হোসেনের (বর্তমানে যমুনা ব্যাংকের ডিএমডি, সাময়িক বরখাস্ত) সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে ফোনটি খোলা পাওয়া গেলেও তিনি ফোন কলে সাড়া দেননি। কিছুক্ষণ পর যন্ত্রটি বন্ধ পাওয়া যায়।

No comments

Powered by Blogger.