জামায়াত-বিএনপির নিস্তার নেই by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

ইতিহাস এবং রাজনীতি মৌলিকভাবে সম্পর্কিত। যাঁরা ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন তাঁরা তাঁদের কাজের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য গোপন করেননি।
পেশাদার ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হচ্ছে জাতীয় অতীতের একটা নির্দিষ্ট ধারার মধ্যে বেঁচে থাকার সংগ্রাম উন্মোচিত করা। এই উন্মোচন হচ্ছে স্কলারশিপ, এই উন্মোচন হচ্ছে মতাদর্শিক লড়াই, এভাবে তৈরি হয় ইতিহাস চর্চা। এভাবেই ইতিহাসবিষয়ক লেখা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্র্যাকটিসের অংশ, কিংবা রাজনৈতিক প্র্যাকটিস। আমরা তদন্ত করেছি ইতিহাস-রাজনীতির সম্পর্ক, বুঝবার চেষ্টা করেছি কলোনির ইতিহাস-রাজনীতি এবং কলোনিত্তোর ইতিহাস-রাজনীতি। যাঁরা লিখেছেন তাঁরা ইতিহাস চর্চা করেছেন রাজনৈতিক সংঘাতে বুদ্ধিজীবী হিসেবে যুক্ত থেকে। ইতিহাস চর্চা করা তাঁদের রাজনৈতিক প্র্যাকটিসের গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইতিহাস লেখা শ্রমজীবী আন্দোলনকে শক্তি যুগিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনকে বেগবান করেছে, নারীবাদী আন্দোলনকে মতাদর্শ দিয়েছে। একটা নির্যাতিত সমাজে চোখ খুলে দিয়েছে, অনেককেই লড়াকু করেছে এবং অনেককেই বিদ্রোহী করেছে। আমরা লড়াই করে, বিদ্রোহ করে আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন উদ্ধার করেছি পাকিস্তানীদের হাত থেকে। এই উদ্ধারের প্রক্রিয়া থেকেই সর্ব দিক জোড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি গঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ সেজন্য আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন নির্মাণের লড়াই, এ লড়াইয়ে সকল রাস্তা মুক্তিযুদ্ধের দিকে গেছে, আর সকল রাস্তায় সকল মানুষ কুচকাওয়াজ করেছে। যুদ্ধ করেনি কে? নারী পুরুষ শ্রমিক কৃষক শিক্ষিত নিরক্ষর মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত-সরকারী চাকুরে অ-সরকারী চাকুরে : সবাই নিজের নিজের অবস্থান থেকে জাতীয় মুক্তির দিকে হাত বাড়িয়েছে। যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে কে? পাকিস্তান এবং জামায়াতে ইসলামী ও তার অঙ্গ সংগঠন। মানুষ হত্যা করেছে কে? পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং জামায়াতে ইসলামী ও তার অঙ্গ সংগঠন। এ এক লড়াই সশস্ত্রদের সঙ্গে নিরস্ত্রদের। এই এক লড়াই যে ক্ষেত্রে সশস্ত্ররা পরাজিত হয়েছে নিরস্ত্রদের কাছে, নিরস্ত্রদের অভিজ্ঞতা চারিয়ে গেছে জনজীবনে, নিরস্ত্রদের অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি হয়েছে জাঁকালো সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য। এই ঐক্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি। এই ঐক্য বিশ্লেষণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
আমরা কি করে ভুলে যাব বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের কলোনি। ১৯৪৭ থেকে কলোনির ইতিহাস থেকে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ আর কলোনির বাংলাদেশ থেকে তৈরি করেছে কলোনিয়াল বাঙালী জাতি। কলোনিয়াল বাঙালী জাতি কলোনির বাংলাদেশ অস্বীকার করেছে আর লড়াই করেছে স্বাধীন বাঙালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মত। এই রাষ্ট্র বাঙালী জাতির কেন্দ্র ভিত্তিমূল এবং ইতিহাসের আশ্রয়। এই রাষ্ট্র জাতি থেকে তৈরি হয়েছে স্বতন্ত্র ইতিহাস, যে ইতিহাস পাকিস্তানের ইসলাম থেকে ভিন্ন এবং ভারতীয় জাতীয়তা থেকে ভিন্ন। এই ভিন্নতা প্রতিষ্ঠাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্বেষণ ও নিয়তি। এই অন্বেষণ ও নিয়তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কলোনি রক্ষার জন্য পাকিস্তানের সশস্ত্র শক্তি পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে একত্রে লড়াই করেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র ও পাকিস্তানের রাজনীতির ভিত্তি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে কলোনি রক্ষার সশস্ত্র লড়াই করেছে। আর বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অধিবাসী কলোনি উচ্ছেদের জন্য সশস্ত্র লড়াই করেছে। এই দুই সশস্ত্র লড়াইয়ের লক্ষ্য একেবারে আলাদা; কলোনি রক্ষার লড়াই বনাম কলোনি উচ্ছেদের লড়াই। এই লড়াইতে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও জামায়াতে ইসলামীর পরাজয় দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির মানচিত্র বদলে দিয়েছে।
কিন্তু এই পরাজয় সত্ত্বেও, পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশ শাসনের ক্ষেত্রে তার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। এই ঐতিহ্যের সমর্থন মিলেছে কলোনিকালে এবং কলোনিত্তোরকালে জামায়াতে ইসলামী থেকে। জামায়াতে ইসলামী দেশ শাসনের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অধিকারে বিশ্বাসী। সিভিল শাসনের বিরোধী জামায়াতে ইসলামী : কলোনিকালে জামায়াতে ইসলামী সেনাশাসনের পক্ষে নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করেছে। কলোনিত্তোরকালে এই বিশ্বাস থেকে জামায়াতে ইসলামী সরে যায়নি। বিএনপির উদ্ভব কলোনিত্তোরকালে সামরিক শাসন থেকে। সামরিক শাসনের বিরোধী বলে, বিএনপি গণতন্ত্রকে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত বলে ভেবেছে এবং সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে এবং শাসনের মানচিত্র থেকে হটিয়ে দিয়ে সামরিক শাসন, জামায়াতে ইসলামী উগ্র বাম দল, আওয়ামী লীগবিরোধী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বিএনপিকে তৈরি করেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা এই রাজনীতির ভিত্তি মুক্তিযুদ্ধ ভারতের সাহায্যে হয়েছে, সেজন্য ভারতবিরোধিতা এই রাজনীতির লক্ষ্য। জামায়াতে ইসলামী, উগ্রবাম, আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তি এবং সামরিক শাসন একত্র করে বিএনপির প্লাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে সাধারণ মানুষের মন থেকে মুছে ফেলে এই শাসনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ইতিহাসকে বিএনপি ব্যবহার করেছে জামায়াতে ইসলামীর সহায়তায়, ইতিহাসের সামরিক শাসনকে অনিবার্য ও প্রবল বলে চিহ্নিত করেছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ক্রিয়াশীল গণতন্ত্রকে সামরিকতার মধ্যে অধস্তন করে এবং জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের রাজনীতি ক্ষেত্রে ত্রাণকর্তা হিসেবে প্রচার করে। সামরিকতার ভিতর কোন প্রতিরোধ নেই, প্রতিরোধ আছে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, এভাবে গণতন্ত্র বিরোধিতা বিএনপি রাজনীতিতে প্রবল হয়ে উঠতে থাকে জামায়াতের সাহায্যে। বিএনপি এবং জামায়াত ক্ষমতার বাইপোলার উপাদান, এই দুই উপাদান একত্র করে ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, যে রঙ্গমঞ্চে গণতন্ত্র প্রতিরোধকারী ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছেন খালেদা জিয়া এবং পার্শ্বচরিত্রে তরবারি ঘুরিয়ে চলেছেন জামায়াতের নেতারা।
এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বদলে বাঙালী মুসলমানকে ইতিহাসে উপস্থাপিত করা হয় এবং বিভিন্ন সম্প্রদায় মিলে বাঙালী জাতির বদলে মুসলমানিত্বের বোধ থেকে গঠিত ঐতিহ্য তৈরি করা হয়। এই ঐতিহ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নেই, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা অপরাধ নয়, সেজন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মুসলমান বিরোধী বিচার : এখানেই জামায়াত ও বিএনপির মৈত্রী। এই মৈত্রী একপক্ষে বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিরোধী, অন্যপক্ষে বাঙালী জাতি বিরোধী। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব হিমায়িত করেছে, এই হিমায়িত অবস্থা থেকে ইতিহাসকে মুক্ত করতে হবে। বিএনপি ও জামায়াতের এই অবস্থান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এই অবস্থান থেকে, সেজন্য এই অবস্থান অপরাধ, ইতিহাসবিরোধী এই অবস্থানের কোন ইটপাথর বোমাবরুদ্ধ বাংলাদেশ রাষ্ট্রে থাকতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এই অবস্থান শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং ইতিহাস এই অপরাধের বিচার শুরু করেছে। একজন নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা যেমন অপরাধ, তেমনি ইতিহাসের ধারাবাহিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান অপরাধ। এই অপরাধের বিচার থেকে জামায়াত-বিএনপির নিস্তার নেই, যত গাড়ি পোড়াক, বোমা ফাটাক, বারুদে ঢেকে দিক রাস্তার পর রাস্তা। এই প্রক্রিয়ায় ইতিহাস উচ্ছেদ করা যায় না। নাৎসিরা জার্মানিতে ইতিহাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পরাজিত হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.