বাচ্চু রাজাকার মামলার রায় ॥ ইতিহাসের অধিকার ফিরে পাওয়া by মুনতাসীর মামুন

রায়ের মর্মার্থ ধরলে এত সাক্ষী-সাবুদ এবং এত শুনানির প্রয়োজন নেই। প্রতিদিন বিনা কারণে একটি আবেদন করেন বিবাদীর আইনজীবী। বিচারক ধৈর্য ধরে তা শোনেন।
প্রথমদিকে, সব পক্ষই ফৌজদারি ধারায় চলেছিল; এখন অবশ্য সেটি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। এত বেশি স্বচ্ছতা দেখানো হচ্ছে, এত বেশি নিরপেক্ষতা দেখানো হচ্ছে যে, বিচার প্রক্রিয়া শ্লথ হয়ে যাচ্ছে যা জনস্বার্থবিরোধী। বিএনপি-জামায়াত চায়, বিচার প্রক্রিয়া থমকে দাঁড়াক বা শ্লথ হোক; আর কয়েকটি মাস কেটে গেলেই হয়ত পটপরিবর্তন হবে। তারা মনে করে, পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে না, তখন বিচার বন্ধ করে দেয়া হবে। বিএনপি তা ঘোষণাও করেছে। জানি না, ট্রাইব্যুনাল এ দিকটা ভেবে দেখবে কিনা।
এ মুহূর্তে আমরা বলতে পারি বিচারের এই আইন ও রায় একটি আন্তর্জাতিক মানদ- তৈরি করেছে। সীমিত অবকাঠামো, রিরাপত্তার শৈথিল্য, ভবিষ্যতের ভয়, সব কিছুকে এই তিন বিচারক অতিক্রম করে অনবদ্য এক রায় দিয়েছেন। সব মহলে এ রায় আদৃত হয়েছে। বাঙালীর ইতিহাসের অধিকার তাঁরা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের ইতিহাস আমরা নির্মাণ করেছিলাম। সেই ইতিহাস কেড়ে নেয়া হয়েছিল। মাহফুজ আনাম যথার্থই লিখেছেন এবং তাঁর এই বাক্য ক’টি আমার খুবই ভাল গেলেছে এই রায় সঠিকভাবে অমোচনীয় ও অভ্রান্তভাবে, আইনগত এবং ইতিহাসের দিক থেকে যারা আমাদের মানুষের বিরুদ্ধে লড়েছে, গণহত্যা চালিয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের সেইসব অপরাধ তুলে ধরেছে। যে কারণে শুধু বাঙালী নয়, পৃথিবীর তাবত স্বাধীনতাকামী এবং ন্যায় বিচারকামী মানুষের তা স্বীকার করে জয়োল্লাস করা উচিত। এ কারণেই আমরা এই রায় উদযাপন করছি।
“We celebrate the verdict becaus it correctly, irrevocably, legally and historically set out the role, those who opposed our war, committed genocide against our people and crimes against humanity that not only we, the Bangladeshis, but the freedom loving and justice seeking world needs to recognise and applaud us for” Daily Star, 23.1.2013]
২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি আমরা আবার আমাদের ইতিহাস ফিরে পেলাম। এটি একটি বড় ঘটনা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ যেমন মাইলফলক আমাদের ইতিহাসে ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর তেমনি একটি মাইলফলক।

॥ সাত ॥
দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের জন্য আগে কখনও এ ধরনের আইন করা হয়নি এবং ঐ রকম আইন অনুযায়ী বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়নিÑযেমনটি করা হয়েছিল বাংলাদেশে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সংবিধান করে ধর্ম ব্যবসায়ীদের দল জামায়াত, মুসলিম লীগ প্রভৃতিকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। দালাল আইন যথাযথ মনে না হওয়ায় ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন করা হয়েছিল। কিন্তু এই আইন দ্বারা কখনও বিচার করা সম্ভব হয়নি। কারণ, সর্বত্র বিজয়ীরা পরাজিতদের বিচার করে। এ দেশে পরাজিতদের ক্ষমতায় এনে জিয়া বরং বিজয়ীদের বিচার ও হত্যা শুরু করেন। পৃথিবীতে এ ধরনের ট্র্যাজেডি খুব কম।
১৯৭২ সাল থেকে সিভিল সমাজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছে। ১৯৯২ সালে নির্মূল কমিটি এই বিচার দাবি কার্যকর করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালত বিচারের দাবিটির ভিত্তি সুদৃঢ় করে। এই আন্দোলনে কখনও ভাটা পড়েছে, কখনও জোয়ার এসেছে; কিন্তু নির্মূল কমিটি মূলত শাহরিয়ার কবিরের নেতৃত্বে এই দাবিতে অটল থেকেছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে আশা করা হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। কিন্তু তিনি করেননি। রাজনৈতিকভাবে সময় হয়েছে বলে তিনি হয়ত মনে করেননি। কিন্তু সেই সময় ইনডেমনিটি বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করেন, চার জাতীয় নেতার বিচারও শুরু হয়।
২০০১ সালে বেগম জিয়া জামায়াতীদের নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। সারা জাতির জন্য ছিল এটি একটি অপমান। আমাদের মতো নির্লজ্জ বুড়ো আমরা আগে ইতিহাসের অস্বীকৃতি, অপমান মেনে নিয়েছি। নতুন প্রজন্ম তা মানতে রাজি হয়নি। শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ইতিহাসের সত্যটি তারা জেনেছিল। বুদ্ধিজীবীদের লেখালেখি, কিছু মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকা ক্রমেই বিচারের দাবি জোরালো করে তুলেছিল। পরাজিত খুনীদের ক্ষমতায় নেয়াটা কিছুতেই মানতে পারেনি নতুন প্রজন্ম। ১৯৯২ সালেই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রয়োজনে তিনি বুকের রক্ত দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ সমাপন করবেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাই আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি রেখেছিলেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার এক বছর পর ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। আজ অনেক ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে রায় পর্যন্ত আমরা পৌঁছেছি। আমরা যেমন উদ্বেলিত, তেমনি শঙ্কিতও। জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে কী করতে পারে তা আমরা জানি। তারা ট্রাইব্যুনালকে লুপ্ত করার জন্য এখন প্রয়োজনে খুনখাবারিতে নেমে পড়বে। ইতিহাসের যে পতাকা আমাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে তা আবার কেড়ে নেয়া হবে। বিচারমুখিনতা এবং কলঙ্কমোচনের এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য ট্রাইব্যুনালের তাই স্থায়ী রূপ দেয়া বাঞ্ছনীয়। শুধু স্থায়ীরূপ নয়, এর স্বায়ত্তশাসন দেয়া এবং সাংবিধানিক সুরক্ষা দেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে সাক্ষী সুরক্ষা আইনও জরুরি। সরকারের এ দিকটি বিবেচনা করা উচিত।
ট্রাইব্যুনালে এখন বিপুল পরিমাণ নথিপত্র জড়ো হয়েছে। ইতিহাসের এই দিকটা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। তদন্ত দল গণহত্যার বিপুল পরিমাণ দলিল-দস্তাবেজ হস্তগত করেছে। এগুলো আমাদের ইতিহাসের ঐতিহ্য অংশ। ট্রাইব্যুনালকে অনুরোধ জানাব, এসব নথিপত্র যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য এখনই বিধিব্যবস্থা করা উচিত। ১৯৭২-৭৩ সালে সংগৃহীত সব দলিল দস্তাবেজ হারিয়ে গেছে এবং স্বাধীনতাবিরোধীরাও সিস্টেম্যাটিকালি সব বিনষ্ট করে ফেলেছে। সরকারের কাছে আগেও আবেদন করেছি, এখনও করছি: পুরনো হাইকোর্ট ভবনে এসব নথিপত্র সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করে ‘গণহত্যা জাদুঘর ও আর্কাইভ’ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু করুন। এটিই উপযুক্ত জায়গা। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্র। এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক ও ছাত্ররাই প্রথম হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছিলেন। ইতিহাসের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার এটি একটি উপাদান।
গণহত্যাকে আমাদের ইতিহাসের ন্যারেটিভ থেকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করেছে এক সময় সামরিক বাহিনী, বিএনপি এবং জামায়াত। গণহত্যা ন্যারেটিভ থেকে হারিয়ে যাওয়ার কারণ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্ব, আমেরিকা, চীন গণহত্যা সমর্থন করেছিল। সে কারণে তারা বাংলাদেশের গণহত্যাকে এড়িয়ে গেছে। পাশ্চাত্যের গণহত্যাবিষয়ক কোন গ্রন্থে বাংলাদেশের গণহত্যার কোন উল্লেখ নেই ভাবা যায়? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের আর কোথাও এত কম সময়ে এত বিশাল গণহত্যা হয়নি। গণহত্যার কথা ভুলে গেলে আমাদের স্বাধীনতার ন্যারেটিভে আর সত্যতা থাকে না। ইতিহাস বিকৃত হয়। ইতিহাসের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের রায় আমাদের ইতিহাসে গণহত্যা শব্দটি ফিরিয়ে এনেছেন। ত্রিশ লাখ বা তার বেশি শহীদ হয়েছিলেন এটিই সত্য। এটি অস্বীকার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় আনা উচিত। ইউরোপে ‘হলোকাস্ট’ অস্বীকার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমাদের প্রস্তাব আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি অটুটু রাখা ও সারা পৃথিবীর গণহত্যায় নিহতদের স্মরণার্থে ১ মার্চ অথবা ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা। ১ মার্চের কথা বললাম এ কারণে যে, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান গণহত্যার প্রস্তুতি নিয়েছিল এবং ঐ সময়ে প্রায় ৩০০ জনকে তারাু হত্যা করেছিল। ২৫ মার্চ তো ব্যাপক আকারে গণহত্যা শুরু হয়। আমরা আহ্বান জানাব, সরকার না চাইলেও আমরা এ দু’টি দিনের যে কোন একটি গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন শুরু করি। কাউন্টার ন্যারেটিভের জন্য এটি প্রয়োজন।
সমসাময়িককালে অনেকে নানা কারণে পরিচিতি লাভ করেন। বিখ্যাত হন। কিন্তু, সময় এত নিষ্ঠুর যে, কালের ক্যানভাসে কিছুই থাকে না। যেমন ৫০ বছর পর বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা হলে জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের নাম থাকবে। কোন মেজরের নাম থাকবে না। শেখ হাসিনার নাম থাকবে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বেরকালের জন্য নয়, অন্য কারণে। সেটি হলো, বাংলাদেশে বিচারহীনতার ও দায়হীনতার যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল তিনি তা থেকে বেরিয়ে বিচারমুখিনতা ও দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন যা সভ্য সমাজের সংস্কৃতি। আর বিচারিক ইতিহাসে ট্রাইব্যুনাল-২-এর রায় বারবার উল্লেখিত হবে রাষ্ট্রে দায়বদ্ধতা ও রাষ্ট্রের মানুষদের কাছে ইতিহাসের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। (সমাপ্ত)

No comments

Powered by Blogger.