ভারতকন্যা-সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ জানায় অসভ্যতা by অমিত বসু

দিলি্ল জঙ্গল। পশুদের বাসস্থান। নিরাপত্তার বালাই নেই। সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে অসভ্যতা। বিশৃঙ্খলায় বিচলিত দৈনন্দিন শৃঙ্খলা। ভারতের রাজধানীর গৌরব কখনোই তার প্রাপ্য নয়। এ দুরবস্থার কথা দুনিয়া জানুক। দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতকে চিনুক। তার অপদার্থতায় শিউরে উঠুক সবাই।
বিক্ষোভে ফেটে পড়ূক জনতা। তাকে চেয়ার থেকে ছুড়ে ফেলুক। এই চূড়ান্ত চাওয়াতেই পথ চেয়েছিলেন সদ্যোজাত রাজনৈতিক দল আমআদমি পার্টির চেয়ারম্যান অরবিন্দ কেজরিওয়াল। হলো না। মৃত ধর্ষিত কন্যার শেষকৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে সব শান্ত। যেমন ছিল তেমন। শীতের শহরের ব্যস্ততা তুলনাহীন। কেজরিওয়ালের কপাল খারাপ। ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রলয়ঙ্করী ঝড় ধরে রাখা গেল না। রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হলে মানুষ দরকার। যত বেশি হয় তত ভালো। লোকে না মানলে লোকমান্য হওয়া যায় না। গান্ধীজি যখন নিঃসঙ্গ, তখন তাকে প্রেরণা জোগাতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে।' গান্ধীজি তাই করেছিলেন। একা হওয়াতেও কুঁকড়ে যাননি। নির্ভীক পথিক হয়ে পথ চলেছিলেন নিজের রাস্তায়। কংগ্রেসের মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলও তার সড়কে কাঁটা ছড়িয়েও তাকে আটকাতে পারেনি। কেজরিওয়ালের কি সেই দৃঢ়তা আছে! তিনি গান্ধী টুপি পরেন। কথায় কথায় গান্ধীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে ভাবমূর্তি নির্মাণে ব্যস্ত। সেটা কি সম্ভব! মানুষকে কী ভাবেন তিনি। যা বোঝাবেন তাই বুঝবে। নিজেকে যেভাবে চেনাবেন সেভাবেই চিনবে।
কিছু লোক জোগাড় করে হৈহৈ হল্লা করাটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। অর্থ থাকলেই সম্ভব। সেটা তার আছে। নেপথ্যে থেকে একাধিক এনজিও টাকার জোগান দিচ্ছে। তাদের দরকার একটা পুতুলের। যে পুতুল তাদের কথায় উঠবে, বসবে, নাচবে। যার নিজের কোনো সত্তা থাকবে না। থাকার মধ্যে থাকবে লোভ। যার নেশায় যা খুশি তাই করবে। যার কোনো শিকড় থাকবে না। ব্যবহার করে আগাছার মতো ছুড়ে ফেলাও যাবে। কেজরিওয়াল সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন। তার সামনে গাজরের মতো ঝুলছে দুটি রাজ্য_ দিলি্ল আর হরিয়ানা। সে দুটি মুখে পুরতে মরিয়া। তিনি জানেন, ভারতের মতো বৃহৎ দেশে তিনি অপাঙ্ক্তের। কেউ তাকে চেনে না, জানেও না। টিভি ক্যামেরার সামনে যে ভাষণ দিচ্ছেন, সেটা পাগলের প্রলাপের মতো। মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যায় না। শব্দের চমক নেই। ভাষায় ক্যাচলাইন বলতে যেটা বোঝায় তাও পাওয়া দুষ্কর। তার চেহারা বা আচরণে জনমোহিনী শক্তি নেই। যানবাহনের চলার শক্তি জ্বালানিতে। রাজনীতি চলে টাকায়। কিন্তু নির্দিষ্ট গন্তব্যে পেঁৗছতে স্টিয়ারিং কন্ট্রোলটা জরুরি। নইলে যেখানে-সেখানে ধাক্কা লেগে ভেঙে চুরমার। রাজনীতির গাড়িটার নিয়ন্ত্রণ রাখতে যে মেধার দরকার তার কি সেটা আছে?
তিনি সরকারি কাজ করতেন। পদমর্যাদার প্রতি সুবিচার করতে তার অসুবিধা হয়নি। কারণ, কাজটি তিনি একাই করতে পেরেছেন। লোক থাকার দরকার ছিল না। কী করছেন, না করছেন তাই নিয়ে সাধারণ মানুষকে জবাবদিহি করতে হয়নি। কেন করছেন? তিনি তো মানুষের কাছে দায়বদ্ধ নন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট রাখলেই হলো। রাজনীতিতে তিনি মানুষের চাকর। প্রতিটি পদক্ষেপে কৈফিয়ত দিতে হবে মানুষকে। সেটাই তিনি পেরে উঠছেন না। প্রতি পদে ভুল। নিজেকে জাহির করতে প্রথম দিকে অঁাঁকড়ে ধরে ছিলেন দুর্নীতির ইস্যু। সরকারকে নাজেহাল করতে সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধীর মতো ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে কামান দাগাতে তিনি পিছপা হননি। কিন্তু গোলায় বারুদ ছিল না। কাগজের বলের মতো নিষ্ফলা। যাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ তারা নির্বিকার।
ব্যর্থ হয়ে বসে থাকাটা ঠিক নয়। কিছু একটা করতে হবে। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। হঠাৎ সামনে এসে গেল ধর্ষণের ইস্যু। তিনি অনতিবিলম্বে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
বিক্ষোভ ছড়াতে লোক জড়ো করলেন, কিন্তু সামনে এলেন না। তিনি জানতেন, আন্দোলনে রাজনৈতিক রঙ ছড়ালে লোকে ছিটকে যাবে। তার আমআদমি পার্টির মতো অর্বাচীন একটি দলকে কে পাত্তা দেবে। তাই নেপথ্যে থেকে যা করার করলেন। মধ্যবিত্ত ছাত্রছাত্রীদের সেন্টিমেন্ট উস্কে দিলেন।
ধর্ষণের শিকার হয়েছেন দিলি্লতে প্যারামেডিকেলের ছাত্রী। যে কলেজে তিনি পড়তেন, সেই কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আবেগকে কাজে লাগালেন। তাদের প্রভাবে অন্যান্য কলেজেও ঝড় উঠল। নেতৃত্ব ছিল না বলে মুহূর্তে আন্দোলনে তীব্র বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীদের কথাবার্তায়, উদ্দেশ্য স্পষ্ট হলো না। মিডিয়ায় এলোমেলো হাঙ্গামার ছবিটাই সামনে এলো। প্রতিবাদী গভীর কোনো বার্তা পেঁৗছে দেওয়া গেল না। আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মন্তব্য করে বসলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির পুত্র সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। তিনি বললেন, এসব ছাত্রছাত্রী পার্টি থেকে বেরিয়ে বিক্ষোভের স্রোতে ভেসেছেন। এ কথায় উল্টো প্রতিক্রিয়া হলো। এমন একটা আবেগঘন পরিবেশে বিক্ষুব্ধদের সমালোচনা করাটা বিবেচনার কাজ নয়। আন্দোলন যতই মেকি হোক, সমালোচনার উপযুক্ত সময় এটা নয়। এটা ঠিক, আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা। তাদের এগিয়ে আসার কারণও ছিল। যিনি আক্রান্ত তিনি তাদের শ্রেণীভুক্ত। তিনি ডাক্তারি পড়তেন। তার সঙ্গে ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের। তারা দু'জনেই উচ্চবিত্ত নাগরিক। গ্রাম বা মফস্বলের এলেবেলে মানুষ নন। ২০১২ সালে দিলি্ল পুলিশ ধর্ষণের অভিযোগে ৭৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। এখনও একটি মামলারও ফয়সালা হয়নি। কবে আদালত রায় দেবেন কেউ জানে না। পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটকে অজস্র ধর্ষণের মামলা চলছে। তার মধ্যে নাবালিকা শিশুকন্যাকে ধর্ষণের অভিযোগও রয়েছে। এসব ঘটনায় মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছেন কিন্তু আন্দোলনে নামেননি। দিলি্লতে আগে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেখানেও আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগেনি। কারণ, তাদের অধিকাংশই মাটির মানুষ। তাই দামি নয়, সস্তা। কেজরিওয়াল উচ্চবিত্তদের নিয়েই রাজনীতি করছেন। দিলি্লর সাম্প্রতিক ঘটনা তার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। দুর্নীতির ইস্যু ধোপে টেকেনি বলে ধর্ষণের ইস্যুকে অস্ত্র করেছেন তিনি। তার গুরু আন্না হাজারের কথা শুনলে ভালো করতেন। হাজারের উপদেশ ছিল ক্ষমতার জন্য ছটফট করো না, করলে দ্রুত এগোতে গিয়ে আরও পিছিয়ে পড়বে।

অমিত বসু :ভারতীয় সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.