মত ও মন্তব্য-দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় নবযাত্রার শুভ অধ্যায় by হারুন হাবীব

বাংলাদেশ চার দশক অতিক্রম করেছে। এই চার দশকে নানা সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে ব্যর্থতাও কম নেই বাংলাদেশের। যে ব্যর্থতাগুলো জাতির কপালে কলংকতিলক পরিয়ে দিয়েছিল, তার অবসান ছিল জরুরি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচার সমাপ্ত করার মধ্য দিয়ে বড় একটি কলঙ্কের মোচন হয়েছে। এবার মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায় প্রদান শুরু হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি গুরুত্বপূর্ণ আরেক জাতীয় অধ্যায়ের শুভারম্ভ।
২১ জানুয়ারি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রথম রায়টি ঘোষিত হওয়ার মধ্য দিয়ে চার দশকের প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। এ রায়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত একটি অধ্যায়ের যেমন শুভ সূচনা হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশ আবারও এক ইতিহাস সৃষ্টি করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। ঐতিহাসিক এ রায়ে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নেতা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর দুটি ট্রাইব্যুনালে বেশ কয়েকটি মামলার কার্যক্রম শুরু হয়, যার মধ্যে বাচ্চু রাজাকারের মামলার রায়টিই প্রথম। কিন্তু মামলার রায়টি প্রথম হলেও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি পলাতক। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে বিস্ময়করভাবে বাচ্চু রাজাকার হঠাৎ দেশ থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। জানা গেছে, সে এখন পাকিস্তানে। প্রশ্ন থেকেই যায়, এত সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ রকম একজন দাগি আসামির পক্ষে দেশ থেকে পালানো কিভাবে সম্ভব হলো!
একাত্তরের জামায়াতে ইসলামীর রোকন ও ফরিদপুর অঞ্চলের রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, আটক রাখা ও নির্যাতন- এসব অপকর্মের অভিযোগ আছে। এই লোকটির বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ, সে মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজাকার বাহিনী গঠনের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেছে। তার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন।
বলা বাহুল্য, এ রায়ে ব্যাপক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটেছে বাংলাদেশে। দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় বুঝতে অসুবিধা হয় না বা হয়নি যে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে এমন রায়ের জন্যই অপেক্ষা করছিল দেশবাসী। যে মাটিতে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যা ও নারী ধর্ষণসহ বর্বরতম অপরাধ সংঘটিত করেছে এক শ্রেণীর ধর্মব্যবসায়ী, সে মাটিতে এমন প্রতিক্রিয়াই অবশ্য স্বাভাবিক ছিল।
তবে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ রায়ে খুশি হয়নি। তারা, তাদের ভাষায়, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিচার চায়। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে 'প্রহসনের বিচার' বলে আসছে অনেক দিন ধরেই। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ ধারণ করে খালেদা জিয়া নিজেও বারবার অভিযুক্তদের মুক্তি দাবি করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁদের বক্তব্য গ্রহণ করেছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঐতিহাসিক পর্বটির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই বড় রাজনৈতিক দলটি কেবল জাতীয় ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধেই দাঁড়ায়নি, একই সঙ্গে তারা গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছে, লাখো শহীদের আত্মার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
ইতিহাস চিরকাল স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল থাকে। কখনো কখনো সে ইতিহাসকে বিকৃত বা বিতর্কিত করার চেষ্টা যে চলে না, তা-ও নয়। কিন্তু বিশ্বের কোথাও একটিও দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না যে ইতিহাসকে বিকৃত বা বিভাজিত করে কোনো জাতি লাভবান হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত ও বিতর্কিত করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। পরিকল্পিত বিকৃতির মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশকে জাতীয় গর্বের ইতিহাস সম্পর্কে আস্থাহীন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য যে নতুন প্রজন্ম নিজেরাই নিজেদের প্রয়োজনে মাটি খুঁড়ে জাতীয় ইতিহাসের নিগূঢ় সত্য বের করে আনতে সক্ষম হয়েছে। এ এক এমন সুবিশাল মনোজাগতিক বিপ্লব সাধন- যা জাতির জন্য মঙ্গলজনক।
দলীয় রাজনীতি ও জাতীয় ইতিহাস কখনো এক নয়, এক করে দেখাও ঠিক নয়। কিন্তু সে অপরাধটিই করা হয়েছে বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগসহ বহু মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর এদেশীয় কিছু মানুষের হাতে। শুধু বাচ্চু রাজাকার নয়, যে কজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী বর্তমানে বিচারাধীন, তারা সবাই নিজেদের অবস্থান থেকে ঘৃণ্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছে, নিজেরাও অংশ নিয়েছে ঘৃণ্য অপরাধকর্মে। মানবাধিকার সমুন্নত করা এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে তাদের আইনের হাতে সোপর্দ করা উচিত ছিল অনেক আগেই। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে দীর্ঘ চার দশক এসব অপরাধী নিজেদের দায়মুক্ত রাখতে সমর্থ হয়েছে। মূলত সামরিক শাসকদের ছত্রচ্ছায়ায় তারা রাজনীতিসহ প্রতিটি সামাজিক স্তরে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। রাজনীতির নষ্ট সমীকরণের সুযোগ নিয়ে তারা বাংলাদেশে পাকিস্তানি ধারায় মৌলবাদী ও ধর্মীয় রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা দিয়েছে। বাংলাদেশকে এরা নতুন পাকিস্তান বানানোর স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু তাদের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এসব অপরাধীকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। আয়োজন করা হয়েছে ঐতিহাসিক বিচারের। সে কারণেই এ বিচার একটি বড় জাতীয় দায়বদ্ধতার পূরণ।
অনেকের কাছ থেকেই একটি প্রশ্ন বারবার করে আসে। আগামী নির্বাচনের আগেই যদি বিচারকাজ শেষ করা না যায় বা রায় কার্যকর করা সম্ভব না হয়, তাহলে কি যুদ্ধাপরাধীদের ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়াটি ভণ্ডুল হয়ে যাবে? আমি মনে করি, এ বিচারটি যেহেতু দলীয় রাজনীতির বিষয় নয়, যেহেতু এ বিচার ঐতিহাসিক এবং জাতীয় নৈতিকতা ও জাতীয় দায়বদ্ধতার বিষয়, সেহেতু সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকার সংগত কোনোই কারণ নেই। আমি তো মনে করি, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যদি কোনো কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা হয় কিংবা বন্ধ করার ষড়যন্ত্র ঘটে, তাহলে এক বড় বিপ্লব অনিবার্য। কারণ এই অভিযুক্তরা গণহত্যা, হত্যা, নির্বিচার নারী ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগসহ এমন কোনো ঘৃণ্য অপরাধ বাদ রাখেনি, যা কোনো সভ্য জাতি ক্ষমা করতে পারে। মনে রাখতে হবে, এ বিচারের সঙ্গে ৩০ লাখ শহীদের আত্মা জড়িত, চার লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম জড়িত, আরো জড়িত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা।
আমার বিশ্বাস, বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দায়হীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটেছে। জাতির দীর্ঘদিনের দাবি ছিল একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে কিছু লোকের বিচার সম্পন্ন করা হয়েছিল; কিন্তু ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর সে আইন বাতিল করে সাজাপ্রাপ্ত ও কারাবন্দি অপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ১৯৯১ সালে গড়ে ওঠে এক ব্যাপক গণ-আন্দোলন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বিচার পূর্ণতা লাভ করেনি। সেদিনের আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই কবি বেগম সুফিয়া কামাল, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, আবদুর রাজ্জাক- তাঁরা আজ কেউ বেঁচে নেই। এসব বরেণ্য মানুষের আত্মা আজ শান্তি লাভ করবে। তাঁদের হাতে গড়া আন্দোলন আজ পূর্ণতা লাভ করেছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর তাদের নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার। বাচ্চু রাজাকারের মামলা দিয়েই শুরু হয় ট্রাইব্যুনাল-২-এর কার্যক্রম। গত বছরের ৩ এপ্রিল বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু সে দেশ থেকে পালিয়ে যায়।
বাচ্চু রাজাকারের মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীসহ রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। শুধু শহীদ পরিবার কেন, গোটা জাতিই সে কারণে অপেক্ষা করে ছিল এমন একটি দিনের। দুটি ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় ১৪ জন অপরাধীর বিচার চলছে। তাদের বেশির ভাগই আবার জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা। জাতির প্রত্যাশা, দ্রুত তাদের বিচারের রায়ও ঘোষিত হবে এবং চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে একাত্তরের সব যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীর বিচার সম্পন্ন করা হবে।
এটিই বলা সংগত হবে যে এ রায় জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের রায়। এ রায়ের মধ্য দিয়ে অবসান হয়েছে দীর্ঘ এক প্রতীক্ষার। এ রায় কোনো অর্থেই প্রতিহিংসা নয়, এ রায় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ রায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এর রায়ের বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ রয়েছে, বিশ্বের আর কোথাও যা নেই। সবাই দেখেছেন, রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ পরিপূর্ণ যোগ্যতায় এ বিচারকাজে অংশ নিয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা প্রতিনিয়ত এ বিচার পর্যবেক্ষণ করছেন। সব দিক থেকেই বিচারের আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করা হচ্ছে। কাজেই এ বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। একটি কথা স্মরণ রাখা উচিত, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। কাজেই সে স্বাধীনভাবেই তার নিজস্ব আইনের প্রয়োগ করার অধিকার রাখে।
জানা গেছে, বাচ্চু রাজাকার পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। তাকে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে সরকারের তরফ থেকে সব রকম প্রচেষ্টা চালানো হবে- এটিই সবার কাম্য।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও কলামিস্ট
hh1971@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.