ঢাকা-দিল্লি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠক, ভিসা-প্রক্রিয়াও সহজ হলো- অপরাধী হস্তান্তরে চুক্তি সই

বাংলাদেশ ও ভারত পালিয়ে থাকা অপরাধীদের হস্তান্তর-প্রক্রিয়া সহজতর করতে ‘বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি’ সই করেছে। তবে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী’ ও ‘রাজনৈতিক অপরাধের’ দায়ে অভিযুক্ত লোকজনকে এই চুক্তির আওতায় হস্তান্তর করা যাবে না।
ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে বিচারাধীন ও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা এর আওতায় পড়বেন। গতকাল সোমবার দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক শেষে চুক্তিটি সই হয়। এর আগে মন্ত্রিসভা চুক্তির খসড়া অনুমোদন করে। কয়েক দিন আগে ভারতের মন্ত্রিসভাও চুক্তির খসড়া অনুমোদন করেছিল।
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্দে চুক্তিতে সই করেন। দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংশোধিত ভিসা-ব্যবস্থা (রিভাইজড ট্রাভেল অ্যারেঞ্জমেন্ট—আরটিএ) বিষয়ক দলিলেও সই করেছেন। আরটিএর আওতায় পর্যটক, ব্যবসায়ী, অসুস্থ ব্যক্তি, শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ দুই দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মাল্টিপল ভিসা চালুসহ বিদ্যমান ভিসা-প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে।
রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে এবারও সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের একাধিক কর্মকর্তা দাবি করেন। যদিও যৌথ ঘোষণায় সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে কিছু বলা হয়নি। তবে প্রশ্নোত্তর পর্বে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্দে সীমান্ত হত্যাকাণ্ডকে দুর্ভাগ্যজনক বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর মতে, এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আর একটিও হওয়া উচিত নয়। বৈঠকে যোগ দিতে সুশীল কুমার গতকাল সকালে ঢাকায় পৌঁছান। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। সফরের দ্বিতীয় দিনে সুশীল কুমার আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক শুরু হয় বেলা তিনটায়। এর আগে আড়াইটায় একান্তে বৈঠক করেন দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠকে বাংলাদেশের ১৮ সদস্যের দলে আরও ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ও দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারেক এ করিম। ভারতের ১৫ সদস্যের দলে ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ সরন। বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে যৌথ ঘোষণা পড়ে শোনান মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
প্রত্যর্পণ চুক্তি: চুক্তির আওতায় কাকে প্রথম হস্তান্তর করা হবে, জানতে চাইলে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘নাম বলার ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। দুই পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে এটি ঠিক করবে। আর এই মুহূর্তে নামগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করাটা ঠিক হবে না।’
চুক্তির ফলে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে—এই প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, ‘আমাদের হিসাবমতে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়া অপরাধীর সংখ্যা যত রয়েছে, তার চেয়ে অনেক কমসংখ্যক ভারতের অপরাধী বাংলাদেশে আছে। তাই ভারতের চেয়ে বেশিসংখ্যক অপরাধীকে বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনতে পারবে। ফলে বাংলাদেশই বেশি লাভবান হবে।’
আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা অনুপ চেটিয়াকে কবে হস্তান্তর করা হবে, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অপরাধী হস্তান্তরের ক্ষেত্রে চুক্তিটি কার্যকর হবে। রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী এবং তথাকথিত রাজনৈতিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত কেউ এর আওতায় পড়বেন না। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা জানি, যে ব্যক্তির কথা আপনি উল্লেখ করেছেন, তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর তাঁকে বা তাঁর মতো লোকজনের ভাগ্য বহিঃসমর্পণ চুক্তির আওতায়, নাকি অন্য পন্থায় ঠিক হবে, তা দেখা হবে।’
চুক্তি অনুযায়ী এক বছরের কম শাস্তি পাওয়া বন্দীরা চুক্তির আওতায় পড়বেন না। বন্দী প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে যেকোনো দেশ সুপারিশ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে। কোন কোন ক্ষেত্রে সুপারিশ বা প্রত্যাখ্যান করা যাবে, তা চুক্তিতে উল্লেখ আছে।
যদি কোনো অপরাধীর জন্য দুটি দেশের কাছ থেকে সুপারিশ আসে, তাহলে বন্দী হস্তান্তরকারী দেশ সিদ্ধান্ত নেবে বন্দীকে কোন দেশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। কমপক্ষে ছয় মাস আগে নোটিশ দিয়ে যেকোনো দেশ এই চুক্তি বাতিল করতে পারবে। এ ছাড়া, তুচ্ছ কোনো ঘটনায় অভিযুক্ত অপরাধীরা এই চুক্তির আওতায় আসবেন না।
আরটিএ: নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চিকিৎসাপ্রার্থীরা এখন থেকে এক বছরের মাল্টিপল ভিসা পাবেন। প্রয়োজনে আবেদনকারীর ভিসার মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হবে। একজন রোগীর সঙ্গে সর্বোচ্চ তিনজন নিকটজন যেতে পারবেন। প্রয়োজনে মাল্টিপল ভিসা দেওয়া হবে। বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের দেওয়া হবে পাঁচ বছরের মাল্টিপল ভিসা। গণমাধ্যমকর্মীদের এখন থেকে এক বছরের মাল্টিপল ভিসা দেওয়া হবে। তবে প্রতিবার সর্বোচ্চ ৩০ দিন অবস্থান করতে পারবেন তাঁরা। শিক্ষার্থীরা এখন তাঁদের শিক্ষাকালীন পুরোটা সময় কিংবা প্রতিবছর ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের ভিসা পাবেন। পর্যটকদের যথাযথ কারণ সাপেক্ষে প্রয়োজনে সর্বোচ্চ এক বছরের মাল্টিপল ভিসা দেওয়া হবে। একবার সফরের পর পরবর্তী দুই মাস ভিসা আবেদনের ক্ষেত্রে যে বিধিনিষেধ আছে, তা শিথিল হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির পর শিগগিরই নতুন ভিসা পদ্ধতি কার্যকর হবে।
সীমান্ত হত্যাকাণ্ড: ভারতের অব্যাহত আশ্বাসের পরও সীমান্ত হত্যাকাণ্ড থামেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশীল কুমার বলেন, ‘দিল্লিতে আমার সঙ্গে বৈঠকে প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের লোকজনকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়া ঠিক নয়।’ সীমান্ত হত্যা রোধে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সীমান্তের কিছু এলাকায় এর প্রয়োগ হচ্ছে। দেখা গেছে, ওই সব এলাকায় হত্যাকাণ্ড কমেছে। আমাদের দুই পক্ষকে বসতে হবে, যাতে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড আর না ঘটে।’

No comments

Powered by Blogger.