ফ্যাসিস্ট জামায়াতকে নিয়ে বেকায়দায় বিএনপি- সঙ্গত্যাগের জন্য কর্মী সমর্থক দেশী-বিদেশীদের চাপ বাড়ছে

 ফ্যাসিস্ট জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে ‘চরম বেকায়দায়’ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। নির্বাচনী বছরে স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক এই রাজনৈতিক দলটির ভয়ঙ্কর নাশকতামূলক কর্মকা-ে বিব্রত ও নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে বিএনপিকে।
জামায়াতের সকল অপকর্মের দায় পড়ছে বিএনপির ঘাড়ে। যুদ্ধাপরাধীদের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতের ‘সঙ্গ ত্যাগ’ করতে দেশী-বিদেশীদের প্রবল চাপের মুখেও পড়তে হয়েছে বিএনপিকে। এমন পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র নির্বাচনী ভোটের অঙ্কে কাছে টেনে নেয়া জামায়াতে ইসলামীকেই এখন দলের জন্য ‘বড় বোঝা’ বলেই মনে করছে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। দলটির হাইকমান্ডের আশঙ্কা, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় জামায়াত-শিবির দেশব্যাপী জঙ্গী স্টাইলে এভাবে তা-ব চালাতে থাকলে জোটে রাখার অপরাধে আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে আবারও চরম মূল্যে দিতে হতে পারে।
জামায়াতের সহিংস কর্মকা- সমর্থন করে না দাবি করলেও স্বাধীনতাবিরোধী এ রাজনৈতিক দলটির সকল নাশকতামূলক কর্মকা-ের ‘দায়’ পড়ছে বিএনপির ঘাড়েই। সরকারী দল আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ছাড়াও দেশের সুশীল সমাজ থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই মনে করে বিএনপির প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া ঢাকাসহ সারাদেশে জামায়াত-শিবিরের এমন ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালানো সম্ভব নয়।
এমনিতেই দেশের নতুন প্রজন্মের ভোটাররা উগ্র সাম্প্রদায়িক জামায়াত-শিবিরকে জোটে নেয়ায় নাখোশ। এভাবে যদি নির্বাচনী বছরে জামায়াত-শিবির নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়ে যেতেই থাকে, তার সকল ভার যে বিএনপির উপরই পড়বে- এ বিষয়টি আঁচ করতে পেরেই চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠেছে দলটির হাইকমান্ডে। দেশের মানুষের এই মনের রেখা বুঝতে পেরে জামায়াত ইস্যুতে ‘সতর্কতা’ অবলম্বন করে পথ চলার কৌশল নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জামায়াতকে বিএনপির ‘বোঝা’ বলেই মনে করছেন দলটির অধিকাংশ নেতাকর্মী-সমর্থক ছাড়াও দেশের সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আগামী নির্বাচনেও বিএনপির ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে বলেই মনে করছেন তারা। বিশ্লেষকদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক মানুষ বিএনপিকে পছন্দ করে। দলটিতেও অনেক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রয়েছেন। জামায়াতকে জোটে নেয়ার পর এমনিতেই ওই অংশটি বিব্রত। তার ওপর জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রতিক অপতৎপরতায় বিএনপিতে থাকা জামায়াতবিরোধী এ বিরাট অংশও চায় আগামী নির্বাচনে ভরাডুবি ঠেকাতে তাদের জোট থেকে বহিষ্কার করা হোক।
ভেতরে ভেতরে জামায়াতকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও ভোটের হিসাব-নিকাশ থেকে এখনও প্রকাশ্যে দলটির বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে নারাজ বিএনপির সিনিয়র নেতারা। জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসের দায়ও অবশ্য নিতে চাননি বিএনপির মুখপাত্র ও স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল। তাদের নিজস্ব কিছু কর্মসূচী থাকে। তাই নিজস্ব কর্মসূচীতে তারা পুলিশের হামলা বা অন্য কিছু করে থাকলে এর দায়-দায়িত্ব জামায়াতের, বিএনপির নয়। জামায়াতের কারণে আগামী নির্বাচনে বিএনপির ভোটে প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে শুধু বলেন, ভবিষ্যতই তা বলে দেবে।
বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকও জামায়াত প্রসঙ্গ টেনে বলেন, গতকাল (সোমবার) পুলিশের ওপর ঝটিকা আক্রমণে কিছু পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এটা দুঃখজনক। বিএনপি সহিংসতা ও গাড়ি ভাংচুরের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তবে পুলিশ কমিশনারের গুলি করার নির্দেশকে বেআইনী বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জামায়াত-শিবিরের দেশব্যাপী ভয়ঙ্কর নাশকতামূলক কর্মকা-ের দায় কোনভাবেই বিএনপি এড়াতে পারে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন সিনিয়র আইনজীবী ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, জামায়াত-শিবিরের আজকের এই ব্যাপ্তি-প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণরূপেই বিএনপির সরাসরি আশ্রয়, প্রশ্রয় এবং প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে। তাই জামায়াত-শিবিরের যে কোন নাশকতা বা অপরাধমূলক কর্মকা-ের দায়িত্ব কোনভাবেই বিএনপির অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বরং জামায়াত-শিবির যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় যেসব তা-ব বা অপরাধ করছে, বৃহত্তর অর্থে বিএনপিও এসব অপরাধের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত হবে।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধসহ জামায়াতের বিরুদ্ধে শত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধার প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের ‘ভোটব্যাংক’। ভোটের ফল ঘরে তুলতে জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন করলেও সম্প্রতি তাদের নাশকতামূলক কর্মকা-ে প্রচ- সমালোচনার মুখে পড়েছে বিএনপি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটে জামায়াত অন্তর্ভুক্ত থাকায় তাদের ভয়ঙ্কর এসব নাশকতামূলক কর্মকা- কিছুটা হলেও বিএনপির ওপর বর্তায় বলে মনে করেন দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী। এছাড়া বিএনপির তরুণ প্রজন্মের সমর্থকদের বিরাট অংশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে এবং জামায়াত-শিবিরের দেশব্যাপী পরিচালিত তা-বের বিপক্ষে।
সূত্র জানায়, জামায়াতের সঙ্গে জোট করেও গত নির্বাচনে চরম ভরাডুবি ঘটেছে বিএনপির। দলের বড় অংশই মনে করে, বিগত নির্বাচনের তুলনায় জামায়াতের সমর্থন অর্ধেকেরও বেশি নিচে নেমে এসেছে। অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়া জামায়াত শত শত ক্যাডার নামিয়ে সন্ত্রাসনির্ভর তাদের সাংগঠনিক শক্তির মহড়া দেখিয়ে অস্তিত্বের জানান দিলেও বাস্তবে কোন মহলেই স্বাধীনতাবিরোধী এই দলটির সমর্থন নেই। বরং গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুযোগ নিয়ে বিএনপির কাঁধে বন্দুক রেখে জামায়াত-শিবির যেসব অপতৎপরতা চালাচ্ছে তাতে আগামী নির্বাচনে আরও বড় ধরনের ধাক্কা খেতে হতে পারে বিএনপিকে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরেই উদ্বিগ্ন বিএনপির হাইকমান্ড। আপাতত জামায়াতকে এড়িয়ে চলার কৌশল নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামায়াত ইস্যুতে খোদ বিএনপিতেই রয়েছে দ্বিধাবিভক্তি। দলের নেতাকর্মীরা দু’ভাবে বিভক্ত। উদারপন্থী বলে খ্যাত দলটির অধিকাংশ নেতাকর্মীই আগামী নির্বাচনে বিজয়ের স্বার্থে এখনই জামায়াতকে আর বেশি প্রশ্রয় না দেয়ার পক্ষে। জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করারও দাবি উঠেছে দলটির ভেতর থেকেই। এ অংশটি দলটির প্রধান খালেদা জিয়াকে নানাভাবেই বোঝাতে চেষ্টা করছেন, নির্বাচনে এখন আর জামায়াত কোন ফ্যাক্টর নয়, বরং জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে গেলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বড় অংশের ভোট হারাতে হতে পারে বিএনপিকে।
সূত্র জানায়, দলটির বড় অংশের নেতাকর্মীদের বদ্ধমূল ধারণা, জামায়াত বিএনপির সঙ্গে সব সময় ‘ছলচাতুরি’ ও ‘ব্ল্যাকমেল’ করে আসছে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় এখন জামায়াত বিএনপিকে ব্যবহার করতে চাইছে, নির্বাচনী বছরে বিএনপির ইমেজ ধ্বংসের মিশনে নেমেছে। তাদের অভিযোগ, জামায়াতের নিয়োগকৃত সুবিধাভোগী লবিস্টরা মূলত বিএনপির ভেতরে কাজ করছে। তারা খালেদা জিয়াকে বিভিন্নভাবে আগামী নির্বাচনে জামায়াতের প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু অচিরেই জামায়াত প্রশ্নে বিএনপির হাইকমান্ডের ভুল ভাঙ্গবে বলেই আশাবাদী এ অংশটি।
জামায়াতের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ বিএনপির অনেক নেতাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে উদাহরণ টেনে বলেন, ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে বিএনপি। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জামায়াত বিএনপির পক্ষে ছিল না। খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে যখন ওই সরকার বিএনপিকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করার মিশনে লিপ্ত, তখন জামায়াত বিএনপির পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হয়েছিল। আর জামায়াতের কারণেই বিএনপিকে দাবি আদায় ছাড়াই তড়িঘড়ি করে নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। দ্রুত নির্বাচনে না হলে বিএনপির এত ভরাডুবি ঘটত না বলেই মনে করেন তারা।

No comments

Powered by Blogger.