নাম পরিবর্তন নিয়ে আবার শুরু হয়েছে তোলপাড়

 নাম পরিবর্তন নিয়ে আবার শুরু হয়েছে তোলপাড়। মতার পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নামকরণও। সংকীর্ণ রাজনৈতিক মানসিকতা থেকেই মতাসীন সরকারগুলো নামকরণ ও পরিবর্তনের এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইস্যুকে বাদ দিয়ে নাম বদল আর নামকরণ নিয়ে ব্যস্ত থাকে রাষ্ট্রীয় মতায় থাকা দলগুলো। নানা উৎরাই পেরিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো মতায় এলেও সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না কেউই। তবে এ বিষয়ে চারদলীয় জোট দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রেখেছে। অনেক ৰেত্রেই দৃষ্টানত্মগুলো আবার প্রতিহিংসায় পর্যবসিত হয়। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর নামফলকটি বস্তুত ৰতবিৰত করে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা হয়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ যত স্থাপনার নামকরণ করেছিল তার প্রতিটির পরিবর্তন করে চারদলীয় জোট তথা বিএনপি সরকার। এমনকি সুফিয়া কামালের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব এই প্রতিহিংসা থেকে রেহাই পাননি। এ মুহূর্তে নাম পরিবর্তন বিষয়ে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে কয়েকটি সরকারকে অসাংবিধানিক ঘোষণা।
বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে হীনমানসিকতা থেকে জাতীয় গুরম্নত্বপূর্ণ স্থাপনার নাম পরিবর্তনের এই অপসংস্কৃতি শুরম্ন হয়। ২০০১ সালের অক্টোবরে মতা গ্রহণের মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই অন্য সব গুরম্নত্বপূর্ণ ইসুু্যকে পিছনে রেখে স্থাপনার নাম পরিবর্তন শুরম্ন করে চারদলীয় জোট সরকার। মতার পাঁচ বছরে প্রায় অর্ধশত গুরম্নত্বপূর্ণ স্থাপনা, স্থান ও শিা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে জোট সরকার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরম্ন করে মরহুম জাতীয় নেতাদের নামের স্থাপনার পরিবর্তনের মহোৎসবে মেতে উঠেছিল তৎকালীন সরকার। এমনকি নামকরণ প্রসঙ্গে জাতীয় নেতাদের নিয়ে কটূক্তি করতে পিছপা হননি জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। জোট সরকার আমলে ২০০১ সালের অক্টোবরে রাজধানীর শেরেবাংলানগরে চন্দ্রিমা উদ্যানের নাম বদলে রাখা হয় জিয়া উদ্যান। কিছুদিন পর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আনত্মর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র। ২০০২ সালে শেখ হাসিনা জাতীয় যুব কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জাতীয় যুব কেন্দ্র। একই বছর ধানম-িতে সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপেস্নক্সের নাম পরিবর্তন করে ধানম-ি মহিলা ক্রীড়া কমপেস্নক্স, খুলনায় শেখ নাসের স্টেডিয়ামের নাম বদলে খুলনা বিভাগীয় স্টেডিয়াম এবং চট্টগ্রামে জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামের নাম বদলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্টেডিয়াম রাখা হয়।
২০০৩ সালে বঙ্গবন্ধু সেতুর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় যমুনা সেতু। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মওলানা ভাসানী নভোথিয়েটার। ২০০৫ সালে চট্টগ্রামে এমএ হান্নান আনত্মর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম শাহ আমানত বিমানবন্দর রাখা হয়েছিল। ভৈরবে শহীদ সৈয়দ নজরম্নল ইসলাম সেতুর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু। একইভাবে সৈয়দ নজরম্নল ইসলাম স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে কিশোরগঞ্জ জেলা স্টেডিয়াম, শহীদ কামারম্নজ্জামান স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে রাজশাহী বিভাগীয় স্টেডিয়াম, সিরাজগঞ্জে শহীদ এম মনসুর আলী অডিটরিয়ামের নাম বদলে রাখা হয় ভাষা শহীদ অডিটরিয়াম, শাহবাগে সুফিয়া কামাল পাবলিক লাইব্রেরীর নাম বদলে বাংলাদেশ গণগ্রন্থাগার রাখা হয়। তবে মহাজোট সরকারের আমলে আবার পুরনো নামকরণে ফিরে যায় বেশকিছু স্থাপনা।
জোট আমলে পরিবর্তনের এই ধারা থেকে পুলিশের মনোগ্রামও বাদ যায়নি। পুলিশের মনোগ্রাম একপাশে ধানের শীষ, অপরপাশে গমের শীষ, মাঝখানে নৌকা এবং উপরিভাগে শাপলা ফুল বেষ্টিত ছিল। জোট সরকার পুলিশের মনোগ্রাম থেকে নৌকা বাদ দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার মতায় আসার পর পুলিশের মনোগ্রামে নৌকা বহাল রাখে। আবার জোট সরকারের আমলে সংকীর্ণ রাজনৈতিক মানসিকতার কারণে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীরশ্রেষ্ঠের নাম বিকৃত করে স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছিল। বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোসত্মফা কামালের নাম পরিবর্তন করে শহীদ সিপাহী মোসত্মফা স্টেডিয়াম রাখা হয়। ঢাকার কমলাপুরে এই স্টেডিয়ামের বিকৃত নাম এখনও বহাল রয়েছে।
জাতীয় নেতাদের নাম পরিবর্তন করে দলীয় নেতাদের নামে নতুন নামকরণের প্রতিযোগিতায় নামে জোট সরকার। ঢাকার সোহ্রাওয়াদর্ী হাসপাতালের নাম বদলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিজের নামেই হাসপাতাল মেডিক্যাল কলেজের নামকরণ করেন। জোটের মন্ত্রীরাও স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজের নাম জুড়ে দেন। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে জোটের প্রয়াত প্রভাবশালী সাবেক একমন্ত্রীর নামে কয়েক ডজন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়।
বর্তমান সরকারের নাম পরিবর্তন নিয়ে আরও শোরগোল উঠেছে। সরকার মূলত নাম পরিবর্তন করেছে একটি। বাদবাকি সব স্থাপনার যে নাম বদল করা হয়েছিল সেটা বাতিল করা হয়েছে। স্থাপিত হয়েছে আগের নাম। তবে বদল করা হয়েছে জিয়া আনত্মর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম। করা হয়েছে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর। সরকারের পৰ থেকে বলা হয়েছে ৫ম সংশোধনী বাতিলের আলোকে তারা এ কাজ করেছে। তবে এ নিয়ে দেশে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। প্রধান বিরোধী দল ইতোমধ্যে এর প্রতিবাদে কর্মসূচী দিয়েছে। তবে জিয়া বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন এটাই প্রথম নয়। জেনারেল এরশাদ ৰমতা দখলের অব্যবহিত পরেই জিয়া বিমানবন্দরের নাম পাল্টে ঢাকা আনত্মর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই নানা চাপে ঢাকা বিমানবন্দর আবার জিয়া বিমানবন্দর হয়ে যায়।

No comments

Powered by Blogger.