প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১৮- পুরস্কার নিলেন তিন গুণী

অনাড়ম্বর আয়োজন। তবে শীতের সন্ধ্যায় হূদয়ের উষ্ণতা ও আতিথেয়তায় অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিল পরিবেশ। গতকাল মঙ্গলবার রূপসী বাংলা হোটেলের বলরুমে দেশের সাহিত্যিক, প্রকাশক, শিল্পী ও বিদগ্ধজনের এই সম্মিলনীর উপলক্ষ ছিল ১৪১৮ সনের প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার বিতরণী।
আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, এবার সৃজনশীল শাখায় শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত কথাশিল্পী ওয়াসি আহমেদের গল্পগ্রন্থ কালাশনিকভের গোলাপ এবং মননশীল শাখায় প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানের গবেষণাগ্রন্থ উয়ারী-বটেশ্বর: শেকড়ের সন্ধানে বর্ষসেরা বই নির্বাচিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে লেখকদের হাতে তুলে দেওয়া হলো পুরস্কার।
গোলাপে যেমন কাঁটা থাকে, তেমনি গোলাপচর্চায় নিবেদিত আবদুশ শাকুরের অনুপস্থিতিতে একটু বিষাদের স্পর্শ থেকে গেল অনুষ্ঠানের প্রীতিময় পরিবেশে। তিনি ছিলেন বর্ষসেরা বইয়ের বিচারকমণ্ডলীর সদস্য। অনুষ্ঠানের শুরুতেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হলো। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ আমন্ত্রিত অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে তুলে ধরলেন এই পুরস্কারের প্রেক্ষাপট। প্রথম আলোর বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়েছিল ১৪১০ সন থেকে। তিনি বললেন, লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের উৎসাহেই এই পুরস্কার অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছে। লেখকদের কাজের স্বীকৃতি ও অনুপ্রেরণা দিতেই এই পুরস্কারের আয়োজন।
শোকার্ত চিত্তে আবদুশ শাকুরের অনুপস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথমবার মননশীল শাখায় তাঁর গোলাপসংগ্রহ পুরস্কার পেয়েছিল। এরপর চারবার তিনি এই পুরস্কারের বিচারকমণ্ডলীতে ছিলেন। এসেছেন প্রতিটি অনুষ্ঠানে। এই প্রথম তাঁর অনুপস্থিতি। এরপর বিচারকমণ্ডলীর সদস্য কবি বেলাল চৌধুরীকে আবদুশ শাকুর সম্পর্কে বক্তব্য দিতে আমন্ত্রণ জানালেন।
বেলাল চৌধুরী অল্প কথায় তুলে ধরলেন আবদুশ শাকুরের বহুমাত্রিক প্রতিভার পরিচয়—তিনি মাদ্রাসায় পড়ালেখা শুরু করে ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। সরকারি কর্মকর্তা হয়েছেন। তবে পড়া ও লেখা তাঁর মাথা থেকে যায়নি। এরপর সংক্ষিপ্ত সময়ে গান শোনা। গীতাঞ্জলির ১০০ বছর পূর্ণ হচ্ছে এ বছর। কবিগুরুর গীতাঞ্জলি নিয়ে চকপ্রদ কিছু তথ্য তুলে ধরলেন সঞ্চালক। এরপর গীতাঞ্জলির দুটি গান গেয়ে শোনান শিল্পী অদিতি মহসিন। শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল শোনান দুটি নজরুলসংগীত। এরপর পুরস্কার প্রদানের পর্ব।
বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বিচারকমণ্ডলীর সদস্য কবি বেলাল চৌধুরী, অধ্যাপক আহমদ কবির, সাহিত্যিক শাহীন আখতার ও পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের নিয়ে মঞ্চে আসেন। লেখকদের অভিনন্দন জানিয়ে আনিসুজ্জামান পুরস্কারপ্রাপ্ত বই দুটির বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য তুলে ধরেন। বলেন, উয়ারী-বটেশ্বরে প্রত্ন খননে সংগৃহীত উপকরণ ও তথ্য দিয়ে আমাদের ইতিহাসের যে পুনর্নির্মাণ চলছে, মননশীল শাখার বইটি সেই পরিচয় তুলে ধরেছে। অপর দিকে, সৃজনশীল শাখার বইটিতে লেখক জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে দার্শনিকতার সংশ্লেষণে গল্পে যে কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন, তা আনন্দদায়ক হয়েছে। এই পুরস্কার তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রেরণাস্বরূপ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ওয়াসি আহমেদের শংসাবচন পাঠ করেন শাহীন আখতার। এরপর লেখককে উত্তরীয় পরিয়ে দেন আহমদ কবির। তাঁর হাতে পুরস্কারের স্মারক ৫০ হাজার টাকার অর্থমানের চেক তুলে দেন আনিসুজ্জামান।
প্রতিক্রিয়ায় লেখক প্রথম আলোকে জন্মলগ্ন থেকে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দেওয়াসহ ইতিবাচক ও অগ্রসর চিন্তা তুলে ধরার ভূমিকা পালন করায় অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, ‘লেখক তাঁর অন্তর্গত তাগিদ থেকেই লেখেন। সমাজকে ব্যাখ্যা করার কাজটি তাঁকে করতে হয়। সেই ব্যাখ্যায় হয়তো অনেক ক্ষেত্রে সদুত্তর মেলে না, অনেকে এর সঙ্গে একমত হন না। কিন্তু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। উপযুক্ত প্রশ্ন তোলাটা জরুরি। এই কাজটিই লেখাকে অর্থময় করে তুলতে পারে।’
আহমদ কবির পাঠ করেন সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানের শংসাবচন। লেখকদের উত্তরীয় পরিয়ে দেন শাহীন আখতার। আনিসুজ্জামান তাঁদের হাতে স্মারক ও চেক তুলে দেন।
প্রতিক্রিয়ায় মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান বলেন, পুরস্কার পাওয়ায় তিনি অভিভূত। তাঁর বাবা হানিফ পাঠান এই প্রত্নস্থল নিয়ে কাজ শরু করেছিলেন। তারপর তিনি। ৮০ বছর ধরে তাঁরা কাজ করছেন। এর সঙ্গে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান যুক্ত হয়েছেন। এই স্থানটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এবং এখানে পাওয়া নিদর্শন থেকে জাতি গর্বিত হবে।
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রত্ন খনন ও গবেষণা শ্রম ও ব্যয়সাধ্য কাজ। এতে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বা তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সহায়তা করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শ্রমসাধ্য কাজ করেছেন। প্রথম আলো গুরুত্বের সঙ্গে সংবাদ প্রকাশসহ নানাভাবে সহায়তা করেছে। সবাইকে তিনি অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, এই প্রত্ন গবেষণাটি থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে আমাদের আড়াই হাজার বছরের বেশি প্রাচীন সমৃদ্ধ অতীত রয়েছে। জাতিকে এই প্রত্নসম্পদ অনেক উচ্চ মর্যাদায় আসীন করবে।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান সবাইকে এই আয়োজন সফল করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘প্রতিদিন ৫৩ লাখ পাঠক প্রথম আলো পড়েন। এ ছাড়া বিশ্বের ১৯০টি দেশে অনলাইনে পড়া হয়। সেখানে পাঠকসংখ্যা ১৫ লাখ, মুঠোফোনে ডাউনলোড করে পড়েন তিন লাখের বেশি পাঠক। পাঠকদের আমরা আহ্বান জানাই, আসুন, নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলি। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালিরা অনেক বড়, অনেক ভালো কাজ করছে। আমারা তাদের সাফল্যের পরিচিতি তুলে ধরছি। আমারা গভীরভাবে বিশ্বাস করি, এ দেশ বদলাবে। আমরা মিলিতভাবে এগিয়ে যাব।’
আনুষ্ঠানিকতা শেষ। এরপর ছিল চেনাজানা প্রিয়জনদের সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে উষ্ণ চায়ের পেয়ালা হাতে তুলে নেওয়ার পর্ব।

No comments

Powered by Blogger.