দূরের দূরবীনে-শক্তি নয় আদর্শ : তারই পানে প্রাণ মেলে দিয়ে জাগো by অজয় দাশগুপ্ত

এক. Speeches that changed the world. পৃথিবী কাঁপানো বক্তৃতামালার এক অনবদ্য সংকলন। ধর্মগুরু থেকে যাজক শান্তির দূত থেকে রাজনীতিবিদ_সবার স্থান রয়েছে এতে। ৬১০ সালে মক্কা নগরীর উপকণ্ঠে হেরা পর্বতের গুহায় জিব্রাইল এসেছিলেন মুহাম্মদ (সা.) সদর্শনে। আল্লাহর বাণী শিখিয়ে দিয়ে পৃথিবীব্যাপী প্রচারের দায়িত্ব সঁপেছিলেন।


বক্তৃতামালার এই পুস্তিকায় প্রিয় নবীর ভাষণের শেষ দুটি পঙ্ক্তি হচ্ছে 'ঙুব যিড় ফড় নবষরবাব, seek aid from patience and from prayer, verily, God is with the patient.' ঈশ্বর প্রার্থনা ও ধৈর্যের সঙ্গে আছেন, এই হচ্ছে মূল কথা।
দুই. আজকের পৃথিবী কি এ সত্য বা বাস্তবতার সঙ্গে আছে? আছে কি কোনো যোগসূত্র? ধর্ম বনাম রাজনীতি, এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ এবং আমেরিকার অবদানে পুষ্ট সভ্যতাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আজ যে গণতন্ত্র বা বহুদলীয় শাসন, মানুষের মৌলিক অধিকার, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এমনকি মানবাধিকার_এই সচেতনতাও ইউরোপের দান। আমাদের দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করেছেন, নোবেলপ্রাপ্তির ভাষণে খেদ জানিয়েছিলেন ৫০ বছর অবধি ইউরোপমুখী হননি বলে, শুধু দর্শন বা মনস্তত্ত্বই বা বলি কেন, সমাজবাদ, শ্রেণীহীন জীবনব্যবস্থা, সাম্যবাদী রাষ্ট্রের ধারণার বিস্তারও হয়েছে ইউরোপে। সে সময়কাল অবধি মানুষের আস্থায় চিড় ধরেনি। কাঁধে কাঁধ রেখে চলেছে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের মানুষ। এশিয়ার বিপ্লবে ইউরোপের সমর্থন, আফ্রিকার সহায়তা, আফ্রিকার দুর্দিনে এশিয়ার প্রসারিত হৃদয়, ইউরোপের শক্তি মিলে গড়ে তুলেছিল আশ্চর্য এক অন্য বলয়। সে স্বপ্ন দোলা দিয়েছিল বলেই আমাদের দেশের ঘরে ঘরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল 'মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য' জাতীয় গান। সে গানের শিল্পী কেমন হোঁচট খেয়ে পড়ে লাইনচ্যুত হয়েছেন, দিক হারিয়ে পথভ্রান্ত, তেমনি আদর্শ ঐক্য, সম্ভাবনাও আজ হয় হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে অথবা উধাও।
তিন. আফগানিস্তানের ব্যাপারে এত লেখালেখি, এত কথা, এত আলোচনা, অথচ বিষয় জলের মতো পরিষ্কার। আমাদের যৌবনেই কাবুলিওয়ালার দেশে সদার্থক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। সৈয়দ মুজতবা আলী ঠাট্টা করে লিখেছিলেন, 'এক ডাকাত গেল তো অন্য ডাকাত কুড়িয়ে মাথায় পরল রাজার মুকুট।' বলাবাহুল্য সৈয়দ মুজতবা আলী কাবুলে ছিলেন, সে দেশের মানুষ ও জনজীবনকে প্রবলভাবে বুঝতে পারতেন, আর পারতেন বলেই 'ইনহাস্তে ওয়েতেনামে'র মতো কঠিন শব্দবন্ধ ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন বাঙালির মগজে। আজ যাদের ভয়ে মার্কিনিদের ঘুম হারাম, তাদের সৃষ্টি আমেরিকার হাতে। ওই সময়ে নিজের প্রয়োজনে গড়ে তোলা তালেবান আজ তার ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। আমেরিকা যদি ইউরোপ ও এশিয়াকে ছাড়িয়ে দীর্ঘ আর প্রতাপশালী হয়ে না উঠত, মুসলিম দেশ নামে পরিচিত রাষ্ট্রগুলোর পুতুল সরকার আর ভুল নীতি তাকে সমর্থন না জোগাত, পৃথিবীর ইতিহাস অন্য রকম হওয়াটাও বিচিত্র কিছু ছিল না।
চার. ভিয়েতনামের কথাই ধরা যাক, আমাদের দেশে যাঁরা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করেন তাঁরা ধর্মের নামে জোব্বা, টুপি বা পৈতে চড়ালেও মূল শাস্ত্র অন্ধগামী নন। এক বিশিষ্ট লেখকের কথা জানি, তাঁর চোখে বঙ্গবন্ধু ও সিরাজ সিকদারের মৃত্যুতে খুব একটা তফাৎ নেই। শুনি ইরাকে শিশুহত্যা, নারী হত্যার প্রতিবাদে সেলাই করা পোশাক পরেন না, সাধু! সাধু! কিন্তু এই সংবেদনশীলতা বা মানবিকতটা কি তামিল গণহত্যা বা অন্য জাতির বেলায় দেখানোটাও ফরজ নয়? জন্মগতভাবে আমি অমুসলমান, কিন্তু ইরাকযুদ্ধের পর থেকে কোকা-কোলা পানে আমার কোনো আগ্রহ নেই। এর মানে এই নয়, আমি ইসরায়েলের ঘোর বিরোধী। সে দেশের জনগণ বা নিরীহ মানুষ নিয়ে আমার কোনো উৎকণ্ঠা বা নিরাসক্তি নেই। আছে যুদ্ধ ও অস্ত্রের প্রতি ঘৃণা। বললাম এই কারণে, ভিয়েতনামের ব্যাপারেও আমরা উচ্চকিত হতে পারিনি। একসময় দেশের দেয়ালে দেয়ালে স্লোগান থাকত, 'বাংলা হবে ভিয়েতনাম।' অর্থাৎ কোনো অন্যায় বা অপরাধ সংঘটিত হতে দেখলে সাবধান বাণী উচ্চারিত হতো, দেশকে ভিয়েতনামের মতো রক্তগঙ্গায় প্লাবিত হতে হবে। কী মুশকিল! আজ যখন ভিয়েতনাম এগোচ্ছে, দেশি-বিদেশি, এমনকি মার্কিন ইনভেস্টররাও সে দেশে ছুটছেন। আমরা কিন্তু বলছি না, 'বাংলা হবে ভিয়েতনাম'। সব কিছুকে ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেখি বলেই কি এই বৈষম্য? সম্ভবত সে কারণে আমেরিকাপ্রীতিও যায় না, আমাদের ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে যত তফাৎ বা পার্থক্য থাকুক না কেন; এক জায়গায় তারা সহমত। যেনতেন প্রকারে মার্কিনিদের মনোতুষ্টি। এ ব্যাপারে পাকিস্তানিদের চেয়ে বড় ও জ্বলন্ত উদাহরণ দ্বিতীয়টি নেই, আমেরিকার মনোরঞ্জন করলে সে দেশের পরিণতি বরণ ব্যতীত অন্য কোনো পথ থাকে না। আর যদি নেহরু-গান্ধীর মতো আদর্শিক সরলতা ও নিষ্ঠা থাকে, একসময় আমেরিকা নিজেই এসে ধরা দেয়।
পাঁচ. মুশকিলটা আরো ব্যাপক ও ঘনীভূত হয়েছে ধর্মবিশ্বাস আর রাজনীতি একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে। আমেরিকা তার নিজের বেলায় এবং তার সত্যিকার মিত্র ও সহযোগী দেশ যেমন_অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন বা ইউরোপের ক্ষেত্রে ধর্মকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখে, জীবনকে রাখে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর। আমাদের মতো দেশগুলোকে ধরিয়ে দেয় ধর্মের নামে নতুন নতুন ইস্যু। শান্তি ও সহমর্মিতার পথে তখন আরো এক ধাপ পিছিয়ে পড়ি আমরা। মনে রাখা প্রয়োজন, পৃথিবীর বড়-ছোট সব ধর্মের উৎপত্তি এশিয়ায়। এর কারণ ত্যাগ, এর কারণ সহিষ্ণুতা আর ধৈর্য। আমেরিকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন চোখধাঁধানো হলেও কেনেডি বা মার্টিন লুথার কিং বাঁচতে পারেননি। নেই ত্যাগ বা আদর্শের শিক্ষা, নেই সরে দাঁড়ানোর মতো দৃঢ়তা। শুরুতে যে ধৈর্য ও প্রার্থনার কথা বলছিলাম, আমাদের রাজনীতিকে সেই মুখো হতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করতে হবে, বিদেশ ঘুরে অভিযোগ ও শক্তির সাহায্য কামনার পরিবর্তে জাগতে হবে আদর্শে। যেমনটি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন_'তারই পানে প্রাণ মেলে দিয়ে জাগো'। নইলে এ আঁধার ঘুচবে না। আমাদের শক্তি মানুষ, আমাদের জয় ধৈর্যে।
লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.