সংশোধিত বাজেটে মঙ্গা দূর করার পরিকল্পনা চাই by এস এম আব্রাহাম লিংকন

অর্থমন্ত্রীর পেশকৃত বাজেটকে আমরা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টি থেকে মূল্যায়ন করছি। বিরোধীদলীয় নেতাও তাঁর দলের বাজেটসম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন। বাজেট নিয়ে ভালোমন্দ নানাবিধ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছি।
বাজেটে আইটি খাত প্রাধান্য পাবে না শিক্ষা, শিক্ষা না সামরিক খাত? কোনটি প্রাধান্য পাওয়া উচিত তা নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের মঙ্গা দূরের কথা বাজেটে নেই। চিরায়ত প্রথায় একবাক্যে বলা হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের কথা। দারিদ্র্য বিমোচন দেশের সামগ্রিক প্রতিরোধের কথা। মোটাদাগের কথা। বাজেটে অবশ্যই সে বিষয়ে নির্দেশনা থাকতেই হবে। কিন্তু বাজেটে উত্তরের মঙ্গা বিমোচনের কথা নেই। দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয় নাগরিকের জীবনমানের জাতীয় গড় হিসাব দ্বারা। মঙ্গা দারিদ্র্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও যখন গড় হিসাবের আওতায় একে নেওয়া হয়, তখন মঙ্গা বিমোচনের বিষয়টি হালকা হয়ে পড়ে। দারিদ্র্য এবং উত্তরের মঙ্গাকে পৃথকভাবে বিবেচনায় না নিলে মঙ্গার শিকার নাগরিক দারিদ্র্যের গড় হিসাবের প্যাঁচে উপেক্ষিত থাকবে। আমাদের বিভ্রান্তি আছে মঙ্গা এবং দারিদ্র্যের বিষয়ে। অনেক বিজ্ঞজন দারিদ্র্য বিমোচনের ওষুধ মঙ্গা দূরের চিকিৎসাপত্রে দিয়ে থাকেন, তাঁরা মঙ্গা আর দারিদ্র্যের পার্থক্য বোঝেন না। মঙ্গা দারিদ্র্যের ভয়াভয়তম উগ্র রূপ। বাংলাদেশের সব জেলায় গরিব আছে, দারিদ্র্য আছে, কিন্তু মঙ্গা নেই। রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর এবং নীলফামারী জেলা এর আওতাভুক্ত।
দেশের এই পাঁচ জেলায় যে বিপুল জনগোষ্ঠী, যাদের অধিকাংশই কৃষিশ্রমিক তারা প্রায় সবাই ইরি-বোরো মৌসুমের পর বেকার হয়ে পড়ে। তাদের এই বেকারত্ব চলে প্রায় টানা চার মাস। প্রতিদিনের খাদ্য জোগানের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা তাদের নেই। প্রথমদিকে কিছুদিন গচ্ছিত টুকিটাকির ওপর চললেও পরে কোনোভাবেই চলে না। দুই-তিন মাস বিশেষত আশ্বিন-কার্তিকে তারা বিশেষভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। খাদ্যাভাবের শিকার এসব মানুষের কথা বাজেটে নেই। এনজিওগুলো তাদের ঋণ কার্যক্রম বলবান করার জন্য দ্রুত ঋণ বাজারজাত করে। ঋণের এই বাজারজাতকরণের ফলে তারা কোনো বাছ-বিচার করে না। একজন ঋণী অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে কি না তার খোঁজখবর নেয় না। ফলে ওভারলেপিং গরিব মানুষকে অক্টোপাসের মতো গ্রাস করেছে। এতে ঋণ কার্যক্রম বলবান হয়েছে, ফলবান হয়নি। কারণ যিনি গরু কেনার ঋণ নিয়েছেন তিনি অভাবে খাদ্য কিনে জীবন রক্ষা করেছেন, ফলে প্রতিশ্রুত গরু কেনেননি। এতে ঋণের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। আরোপিত সুদের লাভ প্রতিষ্ঠানগুলো পেলেও গরিবি হঠাও উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তবে এ ঋণের সুফল যেটি রাষ্ট্র যখন কোনো খাবারের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি, তখন গরিব মানুষ যে তথ্য বা প্রতিশ্রুতি দিয়েই ঋণ গ্রহণ করে থাকুক সে সেই ঋণের টাকা দিয়ে তার খাদ্য কিনে জীবন রক্ষা করেছে, সে জীবন ধারণ করেছে ঋণের টাকায়, কিন্তু বেঁচেও থাকার সাধ মরেছে সেই ঋণেরই ফাঁদেই। ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে অনেকেই কর্মের নামে দেশের ভিন্ন জেলায় পাড়ি জমিয়েছে।
আজকে উত্তরের এই পাঁচ জেলার বিত্তহীন মানুষ, যাদের সরকারি হিসাবে ভূমিহীন আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, অন্তত সে মানুষগুলোকে বাঁচাতে হলে তাদের এনজিওর গৃহীত ঋণগুলো রাইট অফের ব্যবস্থা করা। চলতি বাজেটেই এ ধরনের সুবিধার কথা উল্লেখ থাকতে হবে। রাষ্ট্র অনেক সময়ই তার প্রজাকুলের মঙ্গলের জন্য নানাবিধ জনকল্যাণকর কাজ করে থাকে। আমাদের চলতি সংবিধানের দ্বিতীয় তফসিলের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৪ অনুচ্ছেদে 'কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি'র কথা বলা আছে। সেখানে উল্লেখ আছে, 'রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে_কৃষক ও শ্রমিকের_এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তিদান করা।' সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রকে এসব দাদনবন্দি প্রজাকুলকে শোষণ থেকে মুক্ত করতে হবে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষ যারা খাদ্যাভাবে আছে, খাদ্য কিনতে গিয়ে যারা দাদনের জালে বন্দি হয়েছে, তাদের মুক্ত করা রাষ্ট্রের আইন ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এখানে রাষ্ট্র নীরব থাকলে দরিদ্র নাগরিক ইতর জীবন থেকে মুক্তি পাবে না। উত্তরের কৃষি বা জল শ্রমিকরা আগাম শ্রম বিকোতে বাধ্য হয়। শ্রমের বাজার যখন চড়া থাকে, তখনো তাদের পৃথিবীর সবচেয়ে কম মজুরিতে কাজ করতে হয়।
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান মঙ্গা বুঝতেন না, কিন্তু বর্তমান অর্থমন্ত্রী এমনকি রংপুরের পুত্রবধূ যিনি রংপুর বিভাগের উন্নয়নের দায়িত্ব নিয়েছেন, সেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁরা তো বোঝেন মঙ্গার রূপ। মঙ্গা শেষ হয়নি। মঙ্গা তার প্রকাশ্য রূপ বদল করে গোপন রূপ পরিগ্রহ করেছে। আগে গরিবের তিন বেলাই খাবার ছিল না, এখন খায় একবেলা বা দেড়বেলা। উত্তরের উন্নয়ন হয়নি, তা বলছি না_তবে সেটি দক্ষিণ বা পূর্বের জেলাগুলোর তুলনায় অতিক্ষুদ্র। আমাদের প্রয়োজন টেকসই পরিকল্পনা, যেমন_দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য নদী শাসন থেকে শিল্পায়ন, গ্যাস, পর্যাপ্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। উত্তরের উৎপাদিত পণ্যের সহজ, স্বল্প ব্যয়ে পরিবহন ও বিপণন সুবিধা। এগুলো আমাদের সামগ্রিক দারিদ্র্যকে দূরে ঠেলে দেবে, সে জন্য বাজেটে উত্তরের জন্য বিশেষ বরাদ্দ ও অঙ্গীকার দরকার। একই সঙ্গে দরকার চলমান মঙ্গাকে প্রতিরোধের জন্য জরুরি প্যাকেজ। মঙ্গা প্রতিরোধে এনজিওর ঋণ রাইট অফ করা এবং সেসব রাইট অফের টাকা রাষ্ট্রকে নির্বাহ করা। নতুন ঋণের সুদ মওকুফ করা ও ঋণ পরিশোধের সময়কে বৃদ্ধি করা। শহরের শ্রমিক, গ্রাম ও চরের কৃষি মজুরদের ভর্তুকি দিয়ে চাল, তেল সরবরাহ করার জন্য রেশনিং চালু।
ভারতে যদি পশ্চিমবঙ্গ এবং তামিলনাড়ুর গরিবদের দুই টাকায় চাল দিতে পারে, আমরা কেন পারব না? যদি সংসদ সদস্যদের বিলাসবহুল গাড়ি আমদানিতে হাজার কোটি টাকা শুল্ক মওকুফ হতে পারে, তবে কেন নয় দরিদ্র মজুরের জীবন ধারণের জন্য গৃহীত সামান্য ঋণের মওকুফ? সংবিধান কৃষক-শ্রমিকের শোষণমুক্তির কথা বলেছে, তাহলে বাজেটে সে মুক্তির লক্ষ্যে কিছু পাঠ পরিকল্পনা জরুরি নয় কি?

লেখক : আইনজীবী, সাবেক ছাত্রনেতা ও উত্তর জনপদে বসবাসকারী
lincoln_bd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.