কল্পকথার গল্প-মন যখন পরশ্রীকাতর by আলী হাবিব

মন জিনিসটা কী? মানুষের মন আছে। কোনো একসময় মানুষের মন নামে একটা ছায়াছবিও নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু মানুষের মন নামক জিনিসটা কোথায় থাকে? সেই মনের কাজ কী? মনের ইচ্ছা আছে, অনিচ্ছাও। মনের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়। শুধু আকাঙ্ক্ষা কেন, আমাদের শখ, আমাদের সাধ-আহ্লাদ_সবই মনের ব্যাপার।
আবার মন চাইলেও আমরা অনেক কিছু করতে পারি না। তবে একটা কাজ বোধ হয় আমরা করতে পারি। মনের ওপর একটা খোলস পরিয়ে দিতে পারি। মনের ওপর খোলস পরিয়ে দিয়ে যেমন ইচ্ছা তেমন কিছু করতে পারি। আমাদের মন চায় নিজেদের সবকিছু সুন্দর দেখতে। নিজেদের শ্রীবৃদ্ধিতে আমাদের মনে নানা কল্পনা ও পরিকল্পনা থাকে। কিন্তু অন্যের শ্রীবৃদ্ধি আমরা অনেকেই মন থেকে মেনে নিতে পারি না। মনের এই অবস্থাটা ঠিক ঠিক বোঝানোর মতো ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায় কোনো প্রতিশব্দ আছে কি না, জানা নেই। সম্ভবত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। কিন্তু বাংলা ভাষায় বেশ পরিষ্কারভাবে আছে। একেবারে চাঁছাছোলা কিন্তু নিখুঁত শব্দ, পরশ্রীকাতরতা। মনের এই দৈন্যের কারণেই তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হয়েছিল। দুর্যোধন পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন। তাঁর সে ঈর্ষার আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার লোকেরও অভাব হয়নি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সর্বস্ব হারাতে হয়েছিল দুর্যোধনকে।
আমাদের সমাজে পরশ্রীকাতর লোকের অভাব নেই। অন্যের ভালো আমরা দেখতে পারি না। কেউ ভালো কোনো কাজ করলে সেটাকে বাঁকা চোখে দেখাটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পরশ্রীকাতরতা আমাদের চোখের ওপর 'ভালো না দেখার' লেন্স বসিয়ে দেয়। ফলে আমরা অন্যের সব ভালোকে মন্দ দেখতে থাকি। একটা গল্প দিয়েই উদাহরণ দেওয়া যাক। গল্পটি সবারই জানা। সেটা দিয়েই শুরু করা যাক।
এক গ্রামে থাকত দুই লোক। একজন আরেকজনকে দেখতে পারত না। এদের একজন ছিল বেশ সম্পদশালী। তার অনেক মোসাহেব ছিল। এই সম্পদশালী লোকের বাড়ির বৈঠকখানায় মোসাহেবদের নিয়মিত আড্ডা জমত। সেই আড্ডায় অন্যজন সম্পর্কে নানা কথা হতো। তার তেমন টাকা-পয়সা ছিল না। তো, দুজনই যথাসময়ে যথানিয়মে বিয়ে করে বউ ঘরে আনল। সম্পদশালী লোকটি বলল, বিয়ে করেছে ঠিকই, কিন্তু ওর বউ দেখতে সুন্দরী হবে না নিশ্চয়। মোসাহেবরা সমস্বরে তার কথায় সায় দিল। কয়েকদিন পরে খবর পাওয়া গেল, ওই লোকটির স্ত্রী সুন্দরী।
যা হোক, এভাবে চলছিল। দুজনই পুত্র সন্তান লাভ করল। একটু একটু করে বেড়ে উঠল দুই শিশু। স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো দুজনকে। সম্পদশালী লোকের মোসাহেবরা এই স্কুলে ভর্তি হওয়া নিয়ে আলোচনা তুলল। সম্পদশালী লোকটি মোসাহেবদের জানাল, ওর ছেলে স্কুলে ভর্তি হলেও পরীক্ষায় পাস করতে পারবে না। স্কুলে ভালো ফল করে সম্পদহীন লোকটির ছেলে একটার পর একটা ক্লাস পেরিয়ে যেতে লাগল। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা এসে গেল। মোসাহেবরা আবার সম্পদশালী লোকটির বৈঠকখানায় হাজির। তাদের প্রশ্ন, এটা কী হলো? ওই লোকটির ছেলে তো স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে যাচ্ছে। সম্পদশালী লোকটি বলল, পরীক্ষা দিলেও পাস করতে পারবে না। পরীক্ষা শেষে ফল প্রকাশ হওয়ার পর দেখা গেল, ছেলেটি পরীক্ষায় ভালো ফল করেই পাস করেছে। মোসাহেবরা আবার বৈঠকখানায় হাজির। সম্পদশালী লোকটি বলল, স্কুলের পরীক্ষায় পাস করলেও কলেজে সে ভর্তি হতে পারবে না। কলেজে ভর্তি হয়ে গেল ছেলেটি। অনেক কষ্টে কলেজের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠও চুকল তার। মোসাহেবরা পিছু ছাড়ে না। সম্পদশালী লোকটির বৈঠকখানায় হাজির তারা। এটা কী হলো? ছেলেটি তো বিশ্বদ্যিালয়ের পাঠ চুকিয়ে ফেলেছে। সম্পদশালী লোকটির জবাব, পরীক্ষায় পাস করলেও চাকরি পাবে না সে। এক দিন শহর থেকে খবর এল, ছেলেটি একটি চাকরি পেয়েছে। মোসাহেবরা একযোগে সম্পদশালী লোকটির বৈঠকখানায় হাজির। না, এটাকে তারা মেনে নিতেই পারছে না। ছেলেটি চাকরি পেয়ে গেল। এটা কেমন করে সম্ভব? সম্পদশালী লোকটি বলল, চাকরি পেলেও মাস গেলে বেতন পাবে না সে। ছেলেটি বেতন পেল। বেতনের কিছু টাকা বাড়িতেও পাঠাল সে। খবর গেল মোসাহেবদের কাছে। মোসাহেবরা যথারীতি ছুটল সম্পদশালী লোকটির বাড়িতে। খবর দিতে হবে। সম্পদশালী লোকটিকে জানানো হলো যে ছেলেটি বেতন পেয়েছে। সম্পদশালী লোকটি আয়েশ করে তার গড়গড়ায় টান দিতে দিতে বলল, বেতন পেলেও ওই বেতনে তার সংসার চলবে না। টানাটানি লেগেই থাকবে।
এই হচ্ছে পরশ্রীকাতরতার ফল। অন্যের ভালো কখনো চোখে পড়ে না। যেমন পড়েনি সম্পদশালী এই লোকটির। গ্রামের একটি ছেলে স্কুলে ভর্তি হয়েছে, এটা তার ভালো লাগেনি। গ্রামের ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে, এটা তার ভালো লাগেনি। ছেলেটি চাকরি পেয়েছে, এটাও তার ভালো লাগেনি। ছেলেটি চাকরি করে যে বেতন পাবে, তাতে তার সংসারের খরচ মেটানো কষ্টকর হবে, এই ভেবে সে তুষ্ট হতে চায়।
এমন গল্প আরো আছে। অনেক আগের গল্প। এই গল্প সেই সময়ের যখন দেব-দেবতারা মর্তে নেমে আসতেন। মর্তের মানুষের সঙ্গে মিশতেন। সুখে-দুঃখে সঙ্গী হতেন। সেই সময়ে এক গ্রামে পাশাপাশি থাকত দুই লোক। এদের একজনের আছে অনেক সম্পদ। আরেকজন নিতান্তই গরিব কাঠুরিয়া। গ্রামের অদূরে যে বন, সেই বনে কাঠ কেটে সংসার চালায় সে। একদিন কাঠ কাটতে গিয়ে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ায় বনের পাশের নদীতে পানি পান করতে গেল। পানি পান করার সময় অসাবধানে হাতের কুড়াল নদীতে পড়ে গেল। লোকটি সে কুড়াল আর খুঁজে পেল না। কেমন করে দিন কাটবে তার_এই ভেবে নদীর ধারে বসে কাঁদতে শুরু করল লোকটি। এমন সময় নদী থেকে উঠে এক দেবতা লোকটির কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। লোকটি জানাল, তার উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ছিল কুড়াল, সেটা পানিতে পড়ে গেছে। সে খুঁজে পাচ্ছে না। মানুষরূপী দেবতা নদীতে ডুব দিয়ে তুলে আনলেন একটি সোনার কুড়াল। লোকটিকে দেখিয়ে জানতে চাইলেন এটা তার কুড়াল কি না। লোকটি জানাল, এটা তার কুড়াল নয়। সোনার কুড়াল হাতে দেবতা আবার পানিতে ডুব দিলেন। এবার ভেসে উঠলেন একটা রূপার কুড়াল হাতে। লোকটাকে কুড়ালটি দেখিয়ে জানতে চাইলেন, এটা তার কুড়াল কি না। লোকটি জানালো এ কুড়ালটি তার কুড়াল নয়। দেবতা আবার পানিতে ডুব দিলেন। এবার আসল কুড়াল হাতে উঠে এলেন। কুড়ালটি সামনে ধরতেই লোকটি আনন্দে লাফিয়ে উঠে জানাল এটাই তার কুড়াল। দেবতা এবার নিজ রূপ ধরে লোকটিকে জানালেন, তার এই সততায় স্বর্গের দেবতারা খুব খুশি হয়েছেন। তিনি লোকটিকে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। লোকটি বাড়িতে ফিরে তো আর নিজের বাড়ি খুঁজে পায় না। তার জীর্ণ কুটিরের জায়গায় বেশ বড় একটা রাজসিক বাড়ি। দেবতা আবার তার সামনে এসে হাজির। বললেন, এটাই তার বাড়ি। সততার পুরস্কার হিসেবে এটা পেয়েছে সে। পাশের বাড়ির দরিদ্র কাঠুরিয়াকে বিশাল প্রাসাদের মালিক হতে দেখে পাশের বাড়ির ধনী লোকটি যথারীতি ঈর্ষান্বিত। সে জানতে চায় এই সম্পদপ্রাপ্তির গোপন রহস্য। কাঠুরিয়া সরল বিশ্বাসে জানিয়ে দেয় সবকিছু। ধনী লোকটি দেবতাদের মন পেতে উঠে-পড়ে লেগে যায়। দেবতারা এগিয়ে আসেন। ধনী লোকটির কাছে জানতে চান, সে কী চায়। লোকটি জানায়, কাঠুরিয়ার যা হবে, তার যেন তা দ্বিগুণ হয়। যেমন ইচ্ছে, তেমন কাজ। কাঠুরিয়ার হয়েছিল দোতলা বাড়ি, ধনী লোকটির বাড়ি চারতলা হয়ে গেল। একদিন ঘটে গেল দুর্ঘটনা। একটা আঘাতে কাঠুরিয়ার একটা চোখ অন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ধনী লোকটির দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেল।
এই হচ্ছে পরশ্রীকাতরতার ফল। অন্ধ করে দেয়। পরশ্রীকাতর হলে কোনো কিছুই আর ভালো দেখা যায় না। তখন সব ভালোতে কেবল না বলা শুরু হয়ে যায়। না বলতে বলতে একসময় পরশ্রীকাতরদের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে যায়। নিজেরাই নিজেদের বিলুপ্ত করে ফেলে।
লেখক : সাংবাদিক
habib.habib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.