হাজরা মুমতাজ-সেই শাসকদের সঙ্গে পার্থক্য কী

পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মধ্যে মাত্র কয়েকজনের নামোল্লেখ করা যেতে পারে। নির্লিপ্তভাবে করাচিতে সরফরাজ শাহকে রেঞ্জাররা গুলি করে হত্যা করে। সংবাদ প্রকাশের দায়ে সৈয়দ সেলিম শাহজাদকে রাষ্ট্রীয় সংস্থা নির্যাতন করে হত্যা করে বলে অভিযোগ আছে।


ব্লাসফেমি আইনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় শাহবাজ ভাট্টি এবং সালমান তাসিরকে হত্যা করা হয়। গত তিন বছরে বেলুচিস্তান প্রদেশে ৩০ জন শিক্ষককে হত্যা করা হয়। তাঁদেরই একজন বেলুচিস্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাবা দস্তিয়ারি। অপরাধের অভিযোগে বিনা বিচারে রক্তপিপাসু বিক্ষোভকারীরা হাফিজ মুনিব এবং হাফিজ মুঘিসকে হত্যা করে।
এঁদের একেকজনকে একেক পরিস্থিতিতে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সব হত্যার মধ্যে একটি বিষয় অভিন্ন। তাঁরা সবাই মানবাত্মা ধ্বংসকারী নিষ্ঠুরতার শিকার। এ মুহূর্তে আমি এ মানুষগুলোর নাম মনে করতে পারছি। কিন্তু এঁরা হলেন অসংখ্য মৃত্যুর ক্ষুদ্র একটি অংশ, যাঁদের মৃত্যুর বেলায় সরকারি-বেসরকারি_কেউই বিচারের অংশ হিসেবে মানবাধিকারের ধার-ধারেনি।
এই মানুষগুলোর পরিবার এবং তাঁদের বন্ধুদের যাতনার কথা কল্পনা করুন। এ চিত্র পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে কী বলে, তা কল্পনা ও চিন্তা করে দেখুন। এর পরও রয়েছে অসংখ্য, লাখ লাখ মানুষ, যাদের ভোগান্তির কথা আমরা জানি না। একটি হিসাবে দেখা গেছে, ৩৫ হাজার মানুষ আত্মঘাতী এবং সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছে। বেলুচিস্তান এবং দেশের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী এবং জঙ্গিদের মাঝখানে পড়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে এক কাপড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, যেই অসংখ্য মানুষ বন্যা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ঘরবাড়ি ছেড়েছে, তাদের এক বছর পরও রাষ্ট্র পুনর্বাসন করতে পারেনি। অসংখ্য মানুষ ক্ষুধা ও রোগাক্রান্ত হয়ে ক্যাম্পে পড়ে আছে। যেসব মানুষ অদৃশ্য হয়ে গেছে, তাদের পরিবার বৃথাই কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছে। রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে নিরাপত্তা বাহিনী লোক তুলে নিয়ে যাচ্ছে যাদের আর কখনোই আদালতের সামনে হাজির করা হচ্ছে না।
আরো অনেক দুখী মানুষ আপনি, আমি চোখের সামনে দেখেও তা গায়ে মাখছি না, অসুস্থ, বৃদ্ধ এবং মৃত্যুশয্যায় শায়িত, সুতোর সঙ্গে ঝুলে থাকা শিশুর জীবন, অঙ্গহানি হওয়া, প্রতিবন্ধী ও বিকলাঙ্গ-বঞ্চিত মানুষ। সমাজে এদের নিজেদের ভাগ্য নিজেদেরই দেখতে হয়। এদের কোনো অধিকার নেই। অধিকার শুধু ক্ষমতাবানদের। আর ক্ষমতা আসে শুধু অর্থসম্পদ থাকলেই। সুতরাং কারো যদি টাকা না থাকে তাহলে তার কোনো ক্ষমতা নেই।
সুতরাং আপনি যদি মনে করেন যে ক্ষমতাই আপনার অধিকার তাহলে বলতে হয় পাকিস্তান দুর্বল মানুষের কোনো জায়গা নয়। এ দেশের প্রকৃত চিত্র দেখলে তা পাগল করে দেওয়ার মতো। এ দেশে তারাই ভাগ্যবান, যারা নিজেদের পিরামিডের ওপর তুলে বর্মাবৃত হয়ে থাকতে পারে। পাকিস্তান তার স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে এই পরিস্থিতিও অর্জন করেছে। সে তিক্ততার কথাই আমার মনে আসছে।
কেন প্রাক-দেশ বিভাগ সময়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারত জেগে উঠেছিল? আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির পেছনে উত্তপ্ত করে তুলেছিল একটি সমস্যা, কোটি কোটি মানুষের একটি দেশ শাসন করে বিদেশিরা যাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। আগাগোড়া সরকার পরিচালনা ছিল প্রায়ই নিষ্ঠুর এবং রাস্তার সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তারা খুব বেশি কিছু করেনি (শুধু রেলওয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাসপাতাল ছিল ব্যতিক্রম)। সাদা চামড়ার এলিট শাসক এবং তাদের দেশীয় সহায়তাকারী বাদামি চামড়ার সিভিল সার্ভেন্টরা জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে আয়েশে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করত। ওইসব পিরামিডের ওপর বসা এলিটরা উপমহাদেশের সম্পদ নিজেদের দেশে তুলে নিয়ে যেত এবং ভারতীয়দের জন্য থাকত উচ্ছিষ্ট।
আজকের পাকিস্তানের কথাই বলি, আপনি কি সে ঘটনার সঙ্গে পাকিস্তানের মিল খুঁজে পান? জনবিচ্ছিন্ন সামরিক ও বেসামরিক এলিট শাসকগোষ্ঠী তাদের চারপাশের দুঃখ ও বেদনার কিছুই দেখতে পায় না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের কাছ থেকে পাওয়া চিন্তার আধুনিক পাকিস্তানি এলিটরা সব সম্পদ কুক্ষিগত করার কাজে নিমগ্ন। তাঁদের একটিই লক্ষ্য, পিরামিডের ওপর বসে তাদের ক্ষমতাকে স্থায়ী রূপ দেওয়া।
দেশ বিভাগের সময় এগিয়ে এলে কিছু উপনিবেশবিরোধী মানুষ অহিংস ও শান্তিপূর্ণ পথে পরিবর্তন চেয়েছিলেন। জিন্নাহ, গান্ধী, নেহেরুসহ আরো অনেক, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা আলোচনার মাধ্যমে, কনফারেন্স রুমে বসে পরিবর্তন চেয়েছিলেন। কিন্তু এখনকার মতো তখনো নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কিছু মানুষ ছিল, যারা জনগণের হতাশা আর বঞ্চনাকে উস্কে দিয়ে শত শত বছর ধরে শান্তিতে একত্রে বসবাস করা মুসলমান, হিন্দু এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দিয়েছিল। সে সময়ে, দেশভাগের সময় আমরা তাই গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ দেখতে পেয়েছিলাম।
আজও শাসকশ্রেণী এবং জনসাধারণের মধ্যে ব্যবধান অনেক বড় হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করছে কিছু শক্তি।
পাকিস্তান এখন কী প্রত্যাশা করে? পাকিস্তানের ক্ষমতাশালীদের মাইন্ডসেটে যতক্ষণ পরিবর্তন না হবে, সব কিছু একই রকম থাকবে। আমি দেখতে পাচ্ছি, পরিস্থিতি এমন অবস্থায় রয়েছে, যা ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল।

লেখিকা : পাকিস্তানের ডন পত্রিকার সাংবাদিক।
ডন থেকে ঈষৎ সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.