বহে কাল নিরবধি-প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের উদ্বেগ ও মার্কিন গেস্টাপোদের উৎপাত by এম আবদুল হাফিজ

স্টিফেন কিঞ্জার বিবৃত 'মার্কিন গেস্টাপো' উক্তিটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান। এই পদবাচ্য ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর অনেক ক্ষমতাপ্রাপ্তি এবং তা দিয়ে বহির্বিশ্বে নাশকতার শক্তি বৃদ্ধিতে তিনি অত্যন্ত শঙ্কিত হয়েছিলেন।


ব্রিটেন ইরানীয় জ্বালানির সন্ধান পেয়েছিল, যখন দেশটির এক ফোঁটা তেল ছিল না। তৎকালীন ব্রিটেনের ফার্স্ট লর্ড অব অ্যাডমিরালটি উইন্সটন চার্চিল ব্রিটেনের জন্য এই সংবাদটিকে অকল্পনীয়ভাবে শুভ অভিহিত করেছিলেন। এরও কয়েক যুগ পর ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক এই সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে তুলে নিতে তা জাতীয়করণ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একটি ক্লান্ত এবং অবসাদগ্রস্ত ব্রিটেন মোসাদ্দেককে ঠেকানোর কাজটি কঠিন ভেবে যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানে একটি সরকার বদলে (জবমরঁস ঈযধহমব) সাহায্য করতে অনুরোধ জানায়। ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ার সিআইএকে ইরানে একটি ক্যু ঘটিয়ে সরকার উৎখাতের নির্দেশ দেন। এখন বেশ কিছু দেশের দুর্ভাগ্য যে যুক্তরাষ্ট্রের গুণ্ডা প্রকৃতির গেস্টাপোরা যাদের সংখ্যাধিক্যও ভীতিপ্রদ_এ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট দেশের অনুকূলেও সেখানকার রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজিক দৃশ্যপটের অংশে পরিণত হয়েছে। সিআইএর নানা কার্যকলাপ, সর্বব্যাপী উপস্থিতি ও বহুমুখী তৎপরতা ট্রুম্যানের শঙ্কাকেই সত্যে পরিণত করেছে এবং বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্যকেই বিস্তৃত ও সংহত করেছে। সংস্থাটিকে এখন যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা পূরণের মারাত্মক একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারযোগ্য করা হয়েছে, যা মার্কিনিদের আন্তর্জাতিক নীতির লক্ষ্য অর্জনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তি।
পাকিস্তানের আইএসআই প্রধানের সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কোনো নির্দিষ্ট দাবিদাওয়া পেশ করেননি। তিনি তাঁর দেশ থেকে সিআইএর কোনো লোকবল প্রত্যাহারের দাবিও উত্থাপন করেননি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ড্রোন হামলা নিয়েও কোনো আলোচনা হয়নি বা সেসব হামলার সংখ্যা হ্রাসের কোনো অনুরোধ জানানো হয়নি। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে শুধু সিআইএ সদস্যদের অনানুপাতিক সংখ্যায় আমেরিকান দূতাবাস বা কনস্যুলেটে সংযুক্তির কথাই শুধু বলা হয়েছে। অবশ্য উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনারও বেশি কিছু ছিল না, যখন সিআইএ প্রধান লিও পানেটা তাঁর অতিথিকে জানিয়েই দিয়েছেন যে তাঁর সংস্থার তো আফগানিস্তানে মার্কিনিদের রক্ষা করার একটা দায়িত্ব আছে। জেনারেল সুজা পাশার ওপর পানেটার অ্যাফেক্ট যাতে বলবৎ হয়, তাই আইএসআই প্রধানের ভ্রমণের ক্লান্তি শেষ হওয়ার আগেই দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে দ্বিতীয় হামলাটির কথাও তিনি তাঁকে জানিয়ে দেন। ইতিমধ্যে নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে যে পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্ক আসলেই ত্রিশঙ্কু অবস্থায়_বিশেষ করে লাহোরের মার্কিন কনস্যুলেটে সিআইএ এজেন্ট রেমন্ড ডেভিসের সব কীর্তি-কাহিনী প্রকাশ পাওয়ার পর। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ডেভিস এপিসডকে ঘিরে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াকে বাড়াবাড়ি ভাবছে এবং বলেছে যে হয়তো আবার পাকিস্তানকে দ্বিতীয় একটি আলটিমেটাম দেওয়ার সময় এসেছে। উল্লেখ্য, প্রথমটি ছিল জেনারেল মোশাররফকে কলিন পাওয়েলের টেলিফোন বার্তার মাধ্যমে। তবে যৌথ গোয়েন্দা অপারেশনে তো কিছু সাফল্যও আছে, ফলে কিছু কুখ্যাত সন্ত্রাসীকে হত্যা অথবা গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এমন সহযোগিতা প্রায়ই পাকিস্তানে সিআইএর অনেক এজেন্টের কারণে নস্যাৎ হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেস প্রায়ই পাকিস্তানের সমালোচনা করেছে 'কোয়েটা শুরার' ব্যাপারে অগ্রগতি না হওয়ায়। কারণ কোয়েটা শুরাকে মোল্লা ওমরের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র মনে করা হয়। কিছু ব্যর্থতা কোথাও থাকলেও আমেরিকানরা কখনো তাদের যুদ্ধে পাকিস্তান আর্মির এক লাখ ৪৭ হাজার সৈন্য মোতায়েন এবং তার বিশাল আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দেয়নি, যদিও তারা এমন একটি সংঘর্ষে সম্পৃক্ত_যা পাকিস্তানে জনমতের বিরুদ্ধেই শুধু নয়, অত্যন্ত অপ্রিয়। জেনারেল কায়ানির প্রেসিডেন্ট জারদারি, প্রধানমন্ত্রী গিলানি বা মোশাররফের মতো কারো কাছে কোনো জবাবদিহিতা নেই। যেখানেই পাকিস্তানের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রশ্ন জড়িত, তিনি তা একাই করতে সক্ষম_এমনকি তিনি তা পেন্টাগনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক রাউন্ড গলফ খেলার সময়ও তাঁর হাতে পাকিস্তানের স্বার্থ নিরাপদ।
তাই এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে তিনি মার্কিন মিডিয়ায় তাদের প্রত্যাশার অগ্রগতি না দেখাতে পেরে সমালোচিত। প্রথমবারের মতো দাতাখেল-এ ড্রোন আক্রমণে কায়ানির অসন্তোষ পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমা লঙ্ঘনের জন্য যতটা, তার চেয়ে বেশি আইএসআই এবং সিআইএর গোয়েন্দা তথ্যের আদান-প্রদানে ব্যর্থতায় তাঁর ব্যক্তিগত বিরক্তি। তবে কিছু আশাবাদের ঝিলিক সম্প্রতি পরিদৃষ্ট হয়েছে। ড্রোন আক্রমণের কৌশল নিয়ে পেন্টাগন ও ওয়াশিংটনের মতপার্থক্য শেষ পর্যন্ত একটি ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে, যাতে ইসলামাবাদের একটি সম্মানজনক ভূমিকা থাকবে। তবে সে ব্যবস্থাটি কী হতে পারে এখনো তা অজ্ঞাত। তবে তালেবান টার্গেটে আইএসআইয়ের কোনো সিআইএ সহযোগিতায় দ্বিধা নেই। কিন্তু যখন আফগান তালেবান বা পাকিস্তানের 'স্ট্র্যাটেজিক এসেটে'র প্রশ্ন আসবে, এমন ইস্যুগুলো নিষ্পত্তির জন্য অবশ্যই কোনো প্রক্রিয়া থাকতে হবে। আবারও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রায় গত তিন যুগ ধরে তিন মিলিয়ন উদ্বাস্তুর বোঝা বহন করার কোনো স্বীকৃতি দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের কাছে শুধু আরো কিছু করার অপেক্ষায়ই আছে। যুক্তরাষ্ট্র তার স্ট্র্যাটেজিক পশ্চাদ্-ভূমিতে একটি ক্ষুদ্র কিউবাকে নিয়ে স্নায়ু-বৈকল্যে ভোগে, যদিও এ কথা বোঝা কঠিন যে স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তিতে এই কিউবা এক দানবসদৃশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কি এবং কোন নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করতে সক্ষম। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্রই পাকিস্তানকে ভারত সম্পর্কে নিরুদ্বেগ থাকতে উপদেশ দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই পাকিস্তানকে তার ক্ষমতার খেলার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে।
এর মধ্যেও কাবুলে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক উচ্চপর্যায়ের আলোচনা কিছু আশার সঞ্চার করেছে। আফগানদেরই প্রস্তাবিত শান্তি্ত ও সমঝোতার প্রক্রিয়া একটি ইতিবাচক ঘটনা, যা সব পক্ষেরই সমর্থনযোগ্য। দুর্ভাগ্যক্রমে এই নাজুক সময়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং দুর্বল আফগান সরকার এমন একটি সমস্যা, যা ড্রোন আক্রমণ বা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত সিআইএ উপস্থিতি ও তাদের উৎপাতের চেয়েও বৃহৎ। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের দ্বিতীয় আলটিমেটাম সম্পর্কে পরামর্শ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো ফল বয়ে আনবে না। জার্নালটির পাকিস্তানে জনগণের ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। সিআইএর হঠকারিতার সঙ্গে এর মিশ্রণ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। তাই তাদের উসকে না দিয়ে ক্ষমতায় মদমত্ত ও স্থূলদৃষ্টিসম্পন্ন মার্কিন গেস্টাপোদের সামলানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হলেও সাফল্য রয়েছে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক,
বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.