আদিবাসী-নিজের ভাষা কেন খুন হয়ে যায়? by পাভেল পার্থ

কোনো এলাকা থেকে একটি পাখি হারিয়ে গেলে ওই এলাকার মানুষের ভাষা থেকেও ওই পাখিটি হারিয়ে যায়। ওই পাখি সম্পর্কিত সব বিশ্বাস-আচার-রীতি হারিয়ে যায়। এভাবেই একটি ভাষা তার পাখি নিয়ে গড়ে ওঠা শরীরে জখমপ্রাপ্ত হয়। বাহাস উঠতেই পারে_ আরেকটি নতুন পাখি এসে সেই পাখিটির জায়গা দখল করে যদি।


কিন্তু নয়া পাখি কি আগের পাখির অস্তিত্ব ও পরিসর পূরণ করতে পারে? ভাষার আপন অস্তিত্বের জখম সারাতে পারেবলা হয়ে থাকে_ 'ভাষা' যোগাযোগ বহাল রাখে। ভাষা বলতে যদি কেউ কিছু 'অক্ষর' আর কেবলি মুখের বুলিকে বোঝাতে চায় তাহলে আমাদের আজকের আলাপের 'ভাষার' সঙ্গে তার মেলা ফারাক রয়ে যাবে। ভাষা আমাদের চারপাশের বৈচিত্র্যময় প্রাণবৈচিত্র্যকে ধরেই বিরাজিত হয়। প্রাণবৈচিত্র্যের একটিরও নিশ্চিতকরণ বা নিরুদ্দেশ সরাসরি তা ভাষা পরিসরকেই আহত করে। প্রাণবৈচিত্র্যের একটি প্রাণের বিলুপ্তি মানে ভাষা থেকে তার সব আমেজ ও অস্তিত্ব মরে যাওয়া। যদিও বলা হয়ে থাকে, বিদ্যমান ভাষা মানেই ক্ষমতা কাঠামোর ভাষা, প্রতিষ্ঠানের চাপিয়ে দেওয়া ভাষা, পুরুষতান্ত্রিক ও ধলা চামড়ার ভাষা। কিন্তু তার বাদেও প্রতিটি যৌথ (পুস্তকি ভাষায় সরল) সমাজে সমগ্রের চৈতন্য ও প্রতিরোধ পুরোপুরি আড়াল না হয়েও ভাষা এক স্থানিক কায়দায় আপন পরিসরে বিরাজিত হয়। প্রাতিষ্ঠানিক জবরদস্তির বিরুদ্ধে যৌথ সামাজিক সে ভাষা স্বতঃস্টম্ফূর্ত প্রতিরোধগুলো নিরন্তর হাজির করতে চায়। আর তা বিরাজিত থাকে জনগোষ্ঠীর প্রান্তিক-স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য সংলগ্ন জনগণের জীবনেই। যা সেই জনগণের যারপরনাই যাপনের অংশ ও অবিচ্ছেদ্য। যেমন মধুপুরের মান্দিদের ভেতর মানুষের নামকরণের বিষয়টি। এককালে যখন ১৯৫৬ সালের আগ পর্যন্ত রাষ্ট্র দখল করে নেয়নি প্রাতিষ্ঠানিক কায়দায় গড় জঙ্গল, যখন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও দর্শন দখল করেনি মানুষের মনোজগৎ ও আচরণ, তখনকার দিনে মান্দিদের নামগুলো তার স্থানীয় প্রতিবেশ ও বৈচিত্র্যকে মেলে ধরত। যেসব সমাজে মানুষের নামের ধারণা আছে সেসব সমাজে এই মানুষের নামই ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। স্থানীয় কায়দায় ও সামাজিক রীতি অনুযায়ী গড়ে ওঠা একজন মানুষের নাম একই কায়দায় তার সমাজ-দর্শন-পরিসর-নিয়ম ও অভিজ্ঞতাকে জানান দেয়। এই যে মানুষের একটি নাম, যে নাম বলে দিচ্ছে সে কোন সমাজের, তার কী লিঙ্গীয় পরিচয়, সে কোন গোত্রের, তার জাতিগত অস্তিত্ব_ এ সবকিছুকেই চূড়ান্তস্নভাবে অস্বীকার করে বিনাশ করে গায়েব করে তুচ্ছ করে মধুপুরে মান্দিদের নামের ক্ষেত্রে পয়লা প্রাতিষ্ঠানিক বিধি আরোপ করে বাইরে থেকে আসা সংস্কৃতি।
প্রথম দিকে এক একজন মানুষের নাম পুরোটাই বদলে যেতে লাগল। যেমন, একজন মান্দি নারীর নাম ছিল খাঞ্জি মৃ। মিশনারিরা তার নয়া নাম দিল বিভাবতী মৃ। আলফ্রেড-উইলিয়াম-আলবার্ট-মেরি কি তেরেসা_ এসব অস্থানীয় পশ্চিমা শব্দ মানুষের নামের মাধ্যমে মধুপুরের মান্দি ভাষার পরিসরে ঢুকতে শুরু করল। চলতি সময়ে আবার যখন নানা জায়গা থেকে আদিবাসী অধিকার বিষয়ে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণের শোরগোল উঠেছে, এখন দেখা যায় অনেক মান্দি পরিবার বাচ্চাদের নামকরণ করছেন সরাসরি আ.চিক শব্দের মাধ্যমে। তবে এক্ষেত্রেও তারা আদি নামকরণের রীতি ও অস্তিত্বকে পাশ কাটিয়ে তথাকথিত 'আধুনিক' শব্দগুলোকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। যেমন সালগি, সালজং, তাতারা, সুষিমি, বিবাল, ওয়াল_ এসব নাম চলতি সময়ে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন। এই যে বাছাবাছির পালা, এই মনস্তত্ত্বও তৈরি করে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠান স্কুলের বই থেকে ঘুমের বিছানা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে। যে মনস্তত্ত্ব আধুনিকতা আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মানে শেখায়, শেখাতে বাধ্য করে।
কোনো এলাকা থেকে একটি পাখি হারিয়ে গেলে ওই এলাকার মানুষের ভাষা থেকেও ওই পাখিটি হারিয়ে যায়। ওই পাখি সম্পর্কিত সব বিশ্বাস-আচার-রীতি হারিয়ে যায়। এভাবেই একটি ভাষা তার পাখি নিয়ে গড়ে ওঠা শরীরে জখমপ্রাপ্ত হয়। বাহাস উঠতেই পারে_ আরেকটি নতুন পাখি এসে সেই পাখিটির জায়গা দখল করে যদি। কিন্তু নয়া পাখি কি আগের পাখির অস্তিত্ব ও পরিসর পূরণ করতে পারে? ভাষার আপন অস্তিত্বের জখম সারাতে পারে? আর এভাবেই মধুপুরে অগণিত প্রাণবৈচিত্র্য নিশ্চিহ্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মধুপুরের মান্দিদের ভাষা ও জীবনযাপন থেকে হারিয়ে গেছে অগণিত সব শব্দ ও সম্পর্ক। যেমন জেংগেম। এই উদ্ভিদ আগে মান্দিদের নকমান্দি (মান্দিঘর) তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। জেংগেম বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলতি মান্দি কুসুকে আর এটি ব্যবহৃত হয় না। জেংগেম দিয়ে নকমান্দির বেড়া দেওয়া হতো। এখন যেহেতু মাটির ঘরই মধুপুরে বেশি বা বাঁশ-ছন-টিন-ইট দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়; আমরা কি বলব 'বাঁশ-ছন-টিন-ইট' জেংগেমের স্থান পূরণ করে ঐতিহাসিকভাবে ভাষাকে শক্তিশালী করছে? আমরা কি বলব এটি সমাজ রূপান্তরে ভাষার ঐতিহাসিক পরিণতি? আমরা কি একটিবারও জেংগেমের হাহাকারের তলানি দিয়ে টিন-মাটির ঐতিহাসিক ক্ষমতা সম্পর্কে বিচার করব না? আমরা কি বারবার টিন-মাটির ভাষাকে মেনে নিয়ে চিৎকার করে উঠব 'আদিবাসী সংস্কৃতি বাঁচাতেই হবে?' মধুপুর জঙ্গলে এক সময় মংমা (হাতি), দুদি (ময়ূর), কাওয়াথি (বনরুই) ছিল। মংমা বললে মধুপুরের মান্দি শিশুরা এখন বোঝে না। ওরা চেনে 'হাতি'। কাওয়াথি ওরা জানে না। এভাবেই তো যে ভাষার লগে স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্যের সম্পর্ক, সে ভাষা আগাপাছতলা বদলে যায়, খুন হয় স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্যের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াতে। ভাষার এই ঐতিহাসিক বদল, রাজনীতিক রূপান্তর নিয়ে আমরা একটা ছক হাজির করছি। আমরা এখানে দেখাতে চাইছি মান্দি ভাষার আপন প্রাণবৈচিত্র্যের বদলে উপনিবেশ স্থাপনকারী নয়া কী কী বহিরাগত 'প্রাণসম্পদ' স্থানীয় এলাকায় প্রবেশ করেছে এবং কীভাবে তা চলতি সময়ে মান্দি ভাষার শব্দ ও মান্দি জীবনের 'সাংস্কৃতিক নিয়তি' হয়ে উঠেছে।
গাকগিল গাছের বিগিল (ছাল-বাকল) থেকে আগে লাল রঙ বের করা হতো। এই লাল রঙ ব্যবহৃত হতো কাপড় রাঙানোর কাজে। সালজং দুবকনিয়া আমুয়াতে লাল টকটকা দো (মুরগি) লাগে। অলিবক আমুয়ায় সাদা রঙের এক জোড়া কবুতর লাগে। ওয়ান্নার (জুম ফসল তোলার পরের বড় আয়োজনের উৎসব) সময় ঘরদরোজায় ওয়ানছি থক্কার সময় সাদা রঙের ওয়ানছি (জুম ধানের চালের গুঁড়া পানিতে গুলিয়ে তৈরি করা হয়) ব্যবহৃত হয়। এই যে রঙের নানা ধারণা ও ব্যবহার_ এ সবকিছু মিলেই তো ভাষার পরিসর। এই পরিসর বিপন্ন হয় বারবার রঙের মানে ও ব্যবহার যদি পাল্টে যায় বা নিখোঁজ হয়ে যায়। এই যে ভাষার নানা আমেজ ও বিস্তার, নানা ভঙ্গি ও প্রকাশ। এসবই তো স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্যকে ঘিরেই। স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্যই যদি নিরুদ্দেশ আর খুন-জখম হয়ে যায় তখন ভাষার আর থাকে কী? এক ফটফটা কঙ্কাল ছাড়া। আর ওই কঙ্কালে যতই চামড়া-মাংস লাগুক না কেন, তা কি আর আপন শরীর হয়? তার কি কোনো আত্মা থাকে, কোনো মন থাকে? তার কি কোনো নকবা (ঈশ্বর) থাকে? ভাষাকে অবশ্যই সব শ্রেণী ও রাজনৈতিক আপন জ্ঞান জাগতিক দুনিয়া থেকে দেখা দরকার। ভাষা যে কেবলি কিছু অক্ষর বা মুখের বুলি নয়, তা বারবার জানান দেয় নিম্নবর্গের ভাষা পরিসর।
বলা হয়ে থাকে, ইংরেজিসহ দাপুটে কতক ভাষার জন্য দুনিয়ার ছয় সহস্রাধিক ভাষার ৩শ'টি মাতৃভাষাও টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ। প্রতি দু'সপ্তাহে একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। গত ১০০ বছরে প্রায় চার হাজার ভাষা হারিয়ে গেছে। যে রাষ্ট্র বাংলা ভাষার লাগি উর্দু ভাষার রাষ্ট্রীয় দাপটের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল একদিন, সেই রাষ্ট্রেই আজ বাংলা বাদে অপরাপর মাতৃভাষা বিপন্ন ও প্রান্তিক। উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা_ যে রাষ্ট্র রাষ্ট্রের এই বাহাদুরিকে প্রশ্ন করে বুকের পাঁজরগুলো রাষ্ট্রের প্রতাপী বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে মাতৃভাষার মনস্তত্ত্ব ও বিশ্বাসকে হাজির করেছিল; সেই রাষ্ট্রই সাংবিধানিকভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করেছে। তাহলে রাষ্ট্র কি মনস্তাত্তি্বকভাবে মাতৃভাষার অধিকারের বিষয়টিতে স্পষ্ট নয়! রাষ্ট্র কি তাহলে জান দিয়ে মাতৃভাষাকে ভালোবাসে না? রাষ্ট্রের কলিজায় কি মাতৃভাষার জন্য একবিন্দু দরদও নেই। এই দরদ থাকাটা খুবই বিপজ্জনক। বিপজ্জনক এই জন্য, যদি কেউ তার মাতৃভাষার প্রশ্ন তোলে, তাহলে এই চলতি বহুজাতিক পণ্য বিশ্বায়ন নিয়ন্ত্রিত দাপুটে দুনিয়ার বিরুদ্ধে সে যায়। আজ মাতৃভাষার দাবি তোলা মানেই সব বাহাদুরিকে প্রশ্ন করা। সবকিছুকে প্রশ্ন করে সব বাহাদুরিকে ঘিরে দাঁড়ানো। আর তা না হলে মাতৃভাষার অধিকারের দাবির বিষয়টি একেবারেই দায়সারা, লোক দেখানো, অস্পষ্ট, অরাজনৈতিক হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রের সব জনগণের আপন ভাষার সুরক্ষা প্রশ্নে রাষ্ট্রকে অবশ্যই সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেই সবার মাতৃভাষার অধিকার নিশ্চিত করা দরকার।

পাভেল পার্থ : গবেষক
animistbangla@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.