সেই সময়ের নায়কদের জন্য by আসিফ আহমেদ
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষার্ধে এক ঝাঁক তরুণ কাঁপিয়ে তুলেছিল গোটা প্রদেশ, যার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু তাদের কারণে অচিরেই তা হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। এর পেছনে ছিল স্বপ্ন ও অসম সাহসের অনুপম প্রদর্শনী। তাদের সবার ভূমিকা অভিন্ন ছিল না, বরং হেরফের থাকা স্বাভাবিক।
যেমন হেরফের থাকে হাতের পাঁচ আঙুলে কিংবা মানুষের আকৃতিতে। নারী-পুরুষের প্রভেদের কথাও বলা যায়। আপনি তাদের মধ্য থেকে এক বা দু'জনকে কিংবা অল্প কিছু লোককে বিশেষ অবদানের কথা বলে চিহ্নিত করতে পারেন না। কারণ সবাই মিলেই এক অভিন্ন সত্তা। একে অপরের পরিপূরক হিসেবে তারা কাজ করেছে। যেখানে যা কিছু ঘাটতি ছিল সেটা পূরণ করেছে সম্মিলিত আয়োজনে। কেউ তাদের বলতে পারে নিবেদন-পাখি, দেশের স্বার্থের চেয়ে বড় আর কিছুই ছিল না তাদের কাছে। এ জন্য পড়াশোনা অনেকের কাছে কখনও কখনও গৌণ হয়ে পড়ে। সকালে বটতলা থেকে মিছিল নিয়ে প্রায় গোটা শহর প্রদক্ষিণ, তারপর কোনো রকমে পেটে কিছু দিয়ে ইকবাল হল কিংবা মধুর ক্যান্টিনে শলাপরামর্শ শেষে পরের দিনের কর্মসূচি সফল করে তোলার কাজ_ এই তো ছিল দিনের পর দিনের রুটিন। এমন নিবেদিতপ্রাণ তরুণদের জন্য শিক্ষকদেরও ছিল বিশেষ সহানুভূতি। ক্ষমতার রাজনীতির অলিন্দে তাদের বিচরণ ছিল না। কিন্তু রাজনীতির জন্যই তারা জীবন উৎসর্গ করে রেখেছিলেন। পাকিস্তানি শাসকরা গণতন্ত্রের দুয়ার বন্ধ করে রেখেছে এবং তা ভেঙে ফেলতে হবে। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ রুদ্ধ করে দিতে চায় তারা এবং এ অপচেষ্টা ছিন্ন করে শত ফুল ফুটতে দিতে হবে। কোথাও প্রকৃতি রুদ্র রোষে হানা দিয়েছে এবং শাসকদের দ্বারা উপেক্ষিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে ছাত্রছাত্রীরা এবং তারা সংখ্যায় স্বল্প নয়, অগণিত। তাদের দেখা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে নয়, মিলেছে এই শহরের অলিগলিতে এবং জেলা-থানার স্কুলে ও কলেজে। বয়সে নবীন তারা, কিন্তু ভরসা রেখেছে এমনকি প্রবীণরাও। তখন রাজনীতি বিষয়টি হেয়, অশ্রদ্ধেয় এং অসম্মানজনক হয়ে ওঠেনি। বয়সে প্রবীণ ও নবীন অনেকের আইয়ুব খান-মোনায়েম খানের রোষে পড়ে কারাগারে কিংবা হুলিয়া মাথায় চলেছে ছন্দহীন জীবন। তাদের শূন্য স্থান পূরণ করেছে ছাত্ররা।
কিন্তু এ কঠিন সময়েও হতাশায় ভেঙে পড়েছে কমজনেই। কারও মধ্যে এমন সামান্যতম প্রবণতা দেখা গেলে ভরসা দিতে এগিয়ে এসেছে জনে জনে, বহু জনে। পাকিস্তানের অন্ধকার জগৎ থেকেই উৎসারিত হবে অসাম্প্রদায়িক আদর্শের বাংলাদেশ। এ বিশ্বাসেও তারা ছিলেন অটল।
এই নিবেদিত রাজনীতি এবং সমাজকর্মে অবিচল আস্থা রেখেছিলেন যারা তাদের প্রতি জাতিগতভাবেই আমাদের সশ্রদ্ধ হতে হবে। এ ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত হয়েই মিলবে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। ফ্যাশনে চে গুয়েভারাকে স্থান করে দেওয়ার মতো করে নয়, বরং চে-চেতনার প্যাশন চাই। একালের দারুণ প্রযুক্তির ডাটাবেজে প্রবেশ করুক আত্মত্যাগী নিবেদিত রাজনীতির মানুষগুলোর জীবন-তথ্যপুঞ্জ।
২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখে ৪৯ বছর বয়স্ক কাজী আকরাম হুসেন আমাদের মাঝ থেকে অকালেই চলে গেলেন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন তিনি জিয়াউর রহমানের নিষ্ঠুর সামরিক শাসনামলে। পরে ক্ষেতমজুর সমিতির প্রতিষ্ঠাতা নায়কদের একজন ছিলেন। ঘুরেছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চ বিচারালয় পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে সেনাদুর্গের বড় রকমের মাথাব্যথা ছিল। ওই দুটি প্রান্তরকে বাগে আনার জন্য আইয়ুব-ইয়াহিয়া-জিয়া-এরশাদ জেনারেলরা কম করেননি। জিয়া তার শাসনামলের সূচনায় বেরিয়েছিলেন একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিজয়ে। তিনি হাঁটছিলেন জেনারেলের অমিত তেজে। তার পথযাত্রা রুখে দিয়েছিলেন কাজী আকরাম একদল সঙ্গী নিয়ে জেনারেলের চলমান রোডম্যাপে শুয়ে পড়ে। আকরামের বক্তৃতায় আগুন ঝরত। তার নিবেদন-ভঙ্গি ছিল অনন্য। ছাত্র আন্দোলনকে মসিলিপ্ত করার জন্য সামরিক শাসকদের চেষ্টা আকরাম-প্রজাতির ছাত্রনেতারা রুখে দিতে চেয়েছেন। বর্তমান ছাত্ররাজনীতির মন্দ বলতে গিয়ে অনেকে ভালো অতীতকে বিস্মৃত হয়ে যান। ছাত্র রাজনীতিকে ধ্বংস করার 'সেনাদুর্গ-রোডম্যাপের' প্রসঙ্গে কার্যত নিশ্চুপ থাকেন এসব জ্ঞান মহাজনেরা। কাজী আকরাম হুসেন একদিন স্লোগান নির্মাণ করেছিলেন সেনাদুর্গের জেনারেলদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সখ্যের জটিল মুহূর্তে। স্লোগান ছিল নিম্নরূপ : 'বাংলাদেশী আজব চিজ, জিয়ার কাঁধে শাহ আজিজ।' জিয়া-রাজনীতির মুখোশ খুলে দেওয়ার এমন স্লোগান-পদ্য নির্মাতা আকরামকে স্মরণের অর্ঘ্য অর্পণ করি ২০১২ সালের এই ফেব্রুয়ারি-প্রহরে। একাত্তরে একটি দেশের স্বাধীন আত্মপ্রকাশে প্রবল প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছিল যারা তাদের পুনর্বাসনে সত্তর ও আশির দশকের সামরিক শাসকরা প্রাণপাত করেছে এবং বলা যায় সাময়িকভাবে তারা সফলও হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা এটাও তো দেখতে পাই যে, নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকে এই নবীন প্রজন্মই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে এবং এখন দৃঢ়কণ্ঠেই বলতে পারি_ অপরাধীরা রেহাই পাবে না।
ষাটের দশকের শেষভাগের ছাত্র আন্দোলনের অগণিত নেতাকর্মীকে কাজী আকরাম হোসেনের প্রয়াণের এক যুগ পূর্তি উপলক্ষে স্মরণ করি, প্রণতি জানাই।
No comments