প্রেরণা ভাষা ও সাহিত্য by হারুনুর রশিদ শাহীন

মাগধি অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। আর্য বা বৈদিক কথ্য ভাষা থেকে প্রাকৃত ভাষার জন্ম। এ প্রাকৃতকে বলা হতো প্রাচ্য অঞ্চলের কথ্য ভাষা। পরে এ প্রাকৃত থেকে জন্ম হয় মাগধি-প্রাকৃত এবং মাগধি-প্রাকৃত থেকে জন্ম হয় মাগধি-অপভ্রংশের। আর মাগধি-অপভ্রংশ থেকেই সৃষ্টি হয় বাংলা ভাষা।


সে মতে প্রায় ১১০০ বছর আগে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা ভাষায় স্কুলের পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়। ১৯৪০-এর পর বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালু হয়। এ দীর্ঘ সময়ে দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করে নিজস্ব কাঠামো গড়ে তোলার চর্চা করা হয়েছিল। প্রত্যেক জাতির যেমন একটা নিজস্ব ভাষা আছে, তেমনি আমাদেরও আছে। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, রাষ্ট্রভাষা। এ ভাষার প্রতি অনুরাগ থাকা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি। এ ভাষার ভেতর দিয়েই মানসিক উৎকর্ষ সাধিত হবে। বিশ্বের অনেক দেশ তাদের মাতৃভাষাকে অনেক বেশি প্রাধান্য দেয়। আপন ভাষাকে অনুশীলনে, সৃষ্টিকে বড় করে তুলতেই পৃথিবীর বড় বড় জাতি জ্ঞানে-গৌরবে ভাস্বর হতে পেয়েছে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি ইংরেজি ভাষা চর্চা করে সাফল্যের শিরোত্তোলন করতে পারেননি। অবশেষে বাংলা ভাষা চর্চার মাধ্যমে তিনি বিখ্যাত হয়েছেন। তাই তো তিনি লিখেছিলেন_ 'হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিধিত রতন/তা সবে অবহেলা করি।'
অনেকে মনে করেন, বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার দুর্বল। এর মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা সম্ভব নয়। কথাটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কিছু শব্দ ধার করে এ দৈন্য কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। যে শব্দ যে ভাষায় নেই অন্য ভাষা থেকে তা ধার করতে আপত্তি নেই। কারণ পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ভাষার মধ্যে কোনো ভাষাই নিরঙ্কুশ নয়।
আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা এবং ইংরেজি উভয় মাধ্যমে পড়াশোনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দেখা যায়, একটি বিষয়ের ওপর বাংলা মাধ্যমে বড়জোর দু'একটি ভালো বই আছে। অথচ অন্য মাধ্যমে বেশ কয়েকটি রেফারেন্স বই আছে। এ ক্ষেত্রে অনুবাদ পরিভাষা সৃষ্টির জন্য তৎপর হলে এটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এতে আমাদের ভাষা পরিপুষ্ট হবে। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমী সচেষ্ট রয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি উদ্যাগী হবে।
উন্নত জাতি নিজ নিজ ভাষায় জ্ঞানচর্চা করেই নিজেদের সমৃদ্ধিশালী করতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে প্রাচীন গ্রিস ও বর্তমান চীনের কথা উল্লেখ্য। ফরাসি বিপ্লবের প্রেরণা-শক্তি ছিল সে দেশের সাহিত্য। তারা তার মাধ্যমেই নিজেদের ভাবধারাকে ফুটিয়ে তুলেছিল।
অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা যে ভাষা অর্জন করেছি এর যথাযথ ব্যবহার আজ আমাদের সময়ের দাবি। তাই বাংলাকে সর্বজনীনভাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে ছাত্রছাত্রীদের উপযোগী পুস্তক রচনা, অনুবাদ, রচনা ও প্রকাশনার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, অফিস আদালতে ও চাকরির পরীক্ষায় বাংলাকে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অফিস-আদালতে ব্যবহৃত ও চালু প্রতিশব্দগুলো একত্র করে পরিভাষা কোষ তৈরি করা এবং প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে চাপ সৃষ্টি অব্যাহত থাকলে দ্রুত বাংলা ভাষা চালু সম্ভব।
বাংলা ভাষাকে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রচলনের মধ্যেই নিহিত আমাদের গৌরব। আমাদের ভাষার মধ্যে বিবিধ রতন থাকা সত্ত্বেও আমরা পরভাষার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা করতে গিয়েই শুধু পণ্ডশ্রম দিচ্ছি। ফলে শিক্ষা আমাদের সুফল দিচ্ছে না। আমরা আমাদের স্বকীয়তা হারাতে বসেছি। অবিলম্বে এ সহজ সত্যটি উপলব্ধি করে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
harunoor rashid @yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.