স্বদেশ ভাবনা-শেয়ার-সীমান্ত-যোগাযোগ এবং আমাদের দায়ভার by ফারুক যোশী

গত বছরের জানুয়ারিতে বিএসএফের গুলিতে ফেলানীর নির্মম লাশ হওয়া এবং পরে ঝুলন্ত চিত্র প্রতিটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। ফেলানীকে নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। দু'দেশের কথা বিনিময়ও হয়েছে। কিন্তু মাত্র একটি বছর যেতে না যেতেই আরেক বাংলাদেশি হাবিবুরের ওপর নির্যাতনে আবারও মানবিক বিবেক স্তম্ভিত হয়ে গেল।


তার পরপরই রাশেদুলের হত্যার মধ্য দিয়ে ভারত আবারও নৃশংসতাকে জানান দিল একটা উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণী স্বপ্নের বীজ রোপণ করেছিল। পরিকল্পনাহীন এগিয়ে চলা কিংবা টাকা উপার্জনের একটা মওকা পেয়ে আমাদের মধ্যবিত্তের একটা অংশ ছুটেছিল শেয়ার মার্কেটের দিকে। সেই শেয়ার মার্কেট বলতে গেলে ধ্বংস হয়ে গেছে বাংলাদেশে। তারই সঙ্গে সঙ্গে যেন নিঃশেষ হচ্ছে একটি দেশের এক বিরাট অংশ। সুতরাং আবারও বেকার, আবারও কষ্ট। এই কষ্ট কিংবা হারানো কোটি টাকার কারণেই ঢাকার যুবরাজ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। বেছে নিয়েছেন চট্টগ্রামের আরেক ব্যবসায়ী। শেয়ার মার্কেট সারা পৃথিবীতেই এক ধরনের জুয়ার মতো। নব্বইর দশকের মাঝামাঝি কিংবা তার দু'এক বছর পরে লন্ডনে দেখেছি, বন্ধুদের অনেকেই শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করছে এবং সত্যি কথা বলতে কি উপার্জনও করছে। অনেককেই বলতে শুনেছি তখন, সারা সপ্তাহ রেস্টুরেন্টে কাজ করে দুশ' পাউন্ড রোজগার করার কোনো মানে হয় না, যেখানে একদিনেই শত পাউন্ড কামানো যায়। তারপরও সবাই তার কাজের ফাঁকেই এই শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করত এবং বানিয়েও নিত পাউন্ড। কিন্তু পরিবর্তন আসে। সাধারণ মানুষের বিশ্ব-অর্থনীতি না-বোঝার কারণেই হয়তো সে সময়ের আমার অনেক পরিচিত জন এক সময় ধপাস করে পড়ে গেল। কেউ কেউ ঋণের জালেও আটকা পড়ল। এ নিয়ে অর্থনীতিবিদ কিংবা জাতীয় নেতাদের বাদানুবাদ চলতেই পারে। কিন্তু ইস্যু হয়নি রাজপথে নামার। কারণ যারা যা কিছুই করেছে তখন, নূ্যনতম ধারণা নিয়ে পত্রপত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করেই করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যাপারটা সেভাবে নয়। তাড়াতাড়ি অর্থ তৈরির একটা জায়গা ভেবে এখানে সবাই টাকা ঢেলেছে কিছু না জেনেই। তবে যারা জানার, তারা জেনেছে। আর সেজন্যই এখানে শেয়ার মার্কেটটা লুট করা হয়েছে।
এই লুটপাটে রাজনৈতিক ইনফ্লুয়েন্স যে সরাসরি কাজ করেছে তা প্রমাণিত। আর সে কারণেই সরকার দায়ভার এড়াতে পারে না, পারবেও না।
২. সম্প্রতি বাংলাদেশের এলজিআরডিমন্ত্রীর কিছু কথাবার্তা আমাদের মনোযোগ কেড়েছে। মনে করিয়ে দিয়েছে জোট সরকারের মন্ত্রীদের পুরনো কিছু কথাবার্তা। বিএনপির মন্ত্রী ছিলেন এক সময় আলতাফ হোসেন চৌধুরী। সে সময়েও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এভাবেই অবনতি ঘটেছিল। এ রকমই এক নৃশংস ঘটনায় এক শিশুর নির্মম মৃত্যুকে তিনি বলেছিলেন_ আল্লার মাল আল্লায় নিছে। তাতে আমাদের করার কী আছে? ঠিক সেভাবেই আমাদের মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ এখন বলছেন নতুন নতুন কথা। আমাদের মনে হচ্ছে, আমরা যেন মহাজোট নয়, জোট সরকারের সময়টাই এখনও পাড়ি দিচ্ছি। তা না হলে কি মন্ত্রী ইংরেজিতে অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট বলতে পারেন?
বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘর্টনা যেন এক মহামারী! এ দেশে বছরের ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায় বিভিন্ন দুর্ঘটনা কিংবা দুর্যোগে। লাখো মানুষ বেঁচে থাকেন এই দুর্ঘটনার ক্ষত নিয়ে। এই দুর্ঘটনাগুলোকে আসলে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না। এগুলো মনুষ্যসৃষ্ট। প্রকারান্তরে বলতে হয়, এসব দুর্ঘটনা সরকার সৃষ্ট। এটা আওয়ামী লীগের হোক কিংবা বিএনপির সরকারেরই হোক। সড়ক যোগাযোগের বেহাল অবস্থা দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে দিনের পর দিন। অদক্ষ বলা ভুল হবে। আনাড়ি, লাইসেন্সবিহীন কিংবা ভুয়া লাইসেন্সধারী গাড়িচালকদের ব্যাপারে নেই কোনো ভালো আইন। বরং নৌপরিবহনমন্ত্রী তার শ্রমিক-ভালোবাসার (মাসলম্যান পালনের) প্রয়োজনে এদের তেল দিয়ে কথাবার্তা বলেছেন। এতে বেপরোয়া হয়ে উঠছে প্রতিদিন ওই সব অদক্ষ-আনাড়ি চালক। সেজন্যই বাড়ছে অ্যাক্সিডেন্ট । অথচ হত্যার এই দায় তারা না নিয়ে মন্ত্রী বলছেন, অ্যাক্সিডেন্ট তো অ্যাক্সিডেন্টই। এই মন্ত্রীর ইংল্যান্ডের নাগরিকত্বও আছে। ইংল্যান্ড সম্পর্কে তাকে অবহিত করার প্রয়োজন নেই। লাখো-কোটি গাড়ির এই দেশে একজন ড্রাইভারকে গাড়ি চালনার সনদ পেতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়, তিনি নিশ্চয়ই জানেন। রোড-সেফটির ব্যাপারে প্রচুর নিয়ম-কানুন সব দেশেই মেনে চলে চালকরা। বছরে মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড কামানো ফুটবল খেলোয়াড় বেকহাম থেকে শুরু করে পদস্থ রাজনীতিকদেরও আদালতে জরিমানা গুনতে হয়েছে স্পিডিং করার দায়ে এই ব্রিটেনে। জেলদণ্ড হয় অনেকেরই। আর জরিমানা তো নিত্যদিনের ব্যাপার। এখানেও দুর্ঘটনা আছে। কিন্তু দুর্ঘটনা রোধে আছে সরকারের নতুন নতুন উদ্যোগ। বাংলাদেশে এখন নামিদামি গাড়ির ছড়াছড়ি। আমরা বিশ্বাস করি, সরকারকে ট্যাক্স পরিশোধ করার নিয়ম আছে ওই গাড়ির মালিকদের। গাড়ির মালিকদের ট্যাক্স পরিশোধ একটা বড় ধরনের জাতীয় আয়। শুধু সরকারকে সব ব্যাপারেই কেন বিদেশে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে? রোড ট্যাক্স দিয়েই বছর বছর সরকার কিছু কাজে হাত দিতে পারে। সেজন্যই প্রয়োজন ট্যাক্স আদায়ে স্বচ্ছতা ও কঠোর নীতি প্রয়োগ।
৩. গত বছরের জানুয়ারিতে বিএসএফের গুলিতে ফেলানীর নির্মম লাশ হওয়া এবং পরে ঝুলন্ত চিত্র প্রতিটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। ফেলানীকে নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। দু'দেশের কথা বিনিময়ও হয়েছে। কিন্তু মাত্র একটি বছর যেতে না যেতেই আরেক বাংলাদেশি হাবিবুরের ওপর নির্যাতনে আবারও মানবিক বিবেক স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার পরপরই রাশেদুলের হত্যার মধ্য দিয়ে ভারত আবারও নৃশংসতাকে জানান দিল। নির্যাতন আর লাশ_ খুব স্বাভাবিকভাবেই দেশ-বিদেশের বাঙালিরা একে সরকারের চরম ব্যর্থতা হিসেবেই আখ্যায়িত করছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিন বছরের মাথায় বিদেশ ভ্রমণে সেঞ্চুরি করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী কিংবা মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে গর্বের কথাবার্তা উচ্চারণ করেন। অথচ সীমান্তের হত্যা-নির্যাতন বন্ধ করতে কেনই যেন বারবার ব্যর্থ হন। আমাদের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সম্প্রতি বিএসএফের ওই সব অমানবিক আচরণকে যেভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন, তাতে মনে হয়েছে মন্ত্রী ওই সব মানুষের হত্যা-নির্যাতন নিয়ে উদাসীন। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ভারতকে খুশি করতে লাফ দিয়ে বলে উঠছেন_ হত্যা-নির্যাতন সে আর কী? এতে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়। ভারতের হাইকমিশনারের মতোই যেন তারও সেই একই উচ্চারণ_ বিএসএফ তো ক্রিমিনালদেরই শিক্ষা দিয়েছে। আর সেজন্যই শুধু বিরোধী দল বিএনপির রাজনীতি এটা নয়, সাধারণ মানুষের প্রশ্ন আসতেই পারে_ রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে বিদেশ ভ্রমণ করে কিসের এসব কূটনৈতিক তৎপরতা?
৪. যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ৫ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, দুর্ঘটনা নিয়ে সৈয়দ আশরাফ যা বলেছেন, তা আওয়ামী লীগের কিংবা সরকারের কথা নয়। তার নিজস্ব কথা। আমরা মেনে নিলাম_ এ কথাটা তার মুখ থেকেই বেরিয়েছে। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ দেশের ১৬ কোটি মানুষের মতোই সাধারণ মানুষ নন। তিনি বাংলাদেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে জনসমক্ষে তিনি বেফাঁস মন্তব্য করতে পারেন না। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ইস্যু কিংবা সীমান্ত ইস্যুর সঙ্গে কোটি কোটি মানুষের আবেগ সরাসরি জড়িত। আমরা মনে করি, সৈয়দ আশরাফ সরকারের কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন। যদি সরকার তা মনে না করে, তাহলে প্রকাশ্যে সরকারের মুখপাত্রের বলা উচিত, সৈয়দ আশরাফের এ কথা বলা ঠিক হয়নি। কারণ সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ যা-ই ভাবেন না কেন, বাংলাদেশের চাটুকার রাজনীতিবিদ ছাড়া সৈয়দ আশরাফের এ রকম উক্তিকে সাধুবাদ জানাতে পারেন না কেউই।

ফারুক যোশী : যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক
faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.