জনপ্রশাসন-সাম্প্রতিক পদোন্নতি হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করবে by আলী ইমাম মজুমদার

জনপ্রশাসনের উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে সম্প্রতি যে বড় ধরনের পদোন্নতি দেওয়া হলো, তা নিয়ে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এ পদোন্নতির পুরোটাই কোনো পদ ব্যতিরেকে দেওয়া হয়েছে, এ হিসেবে সুস্পষ্টভাবে দেখা দেয়।


বরং পদোন্নতির আগেও কিছুসংখ্যক পদে উদ্বৃত্ত কর্মকর্তা ছিলেন এটাও সুস্পষ্ট। আরও অভিযোগ আসছে অনেকটা দলীয় বিবেচনায় এ পদোন্নতি তালিকা তৈরি হয়; বাদ পড়েছেন অনেক যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে পদোন্নতিজট কর্মকর্তাদের মনোবলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিল। পদোন্নতি পাওয়ার ফলে প্রশাসনের কাজের গতি বৃদ্ধি পাবে। আরও বলা হচ্ছে, স্বীয় পদের মান উন্নীত করে এবং বেশ কিছু নূতন পদ সৃজন করে এসব কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হবে। যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে সরকারি চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর ফলে পদোন্নতিপ্রত্যাশী কর্মকর্তাদের হতাশা বেড়ে চলছিল। উল্লেখ্য, এই কর্মকর্তাদের চাকরির মেয়াদও দুই বছর বেড়েছে। তাই তাঁদের আরও রয়েসয়ে ধাপে ধাপে পদোন্নতি দিলে এমন কোনো ক্ষতি হতো না।
স্বাধীনতার পর থেকেই জনপ্রশাসনে নিয়োগে সুদূরপ্রসারী কোনো লক্ষ না রেখে তাৎক্ষণিক চাহিদার নিরিখে বিভিন্ন সময় ভিত্তিস্তরে খুব বেশিসংখ্যক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। যেমনটি ঘটেছে ১৯৭৩, ১৯৮৩, ১৯৮৪, ১৯৮৫ ও ১৯৮৬ সালে। সময়ান্তরে তাদের পদোন্নতি বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করবে—এটা বিবেচনায়ই নেওয়া হয়নি। পিরামিড আকৃতির প্রশাসনে ওপরের দিকে পদসংখ্যা ক্রমেই কমে আসে। তাই এসব অবিবেচনাপ্রসূত নিয়োগ আর শূন্য পদের বিপরীতে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ওপরের স্তরে পদোন্নতির যথাযথ নিয়মনীতি না থাকায় সময় সময় এসব পদোন্নতিতে জট সৃষ্টি হয়েছে। সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এ ধরনের পদোন্নতি দিয়ে। যা সমস্যাটিকে আরও ঘনীভূত করে চলছে। বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল একটি দক্ষ, মেধাবী ও একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত জনপ্রশাসন গড়ে তোলা। তারই আলোকে সিভিল সার্ভিস আইনের একটি খসড়াও প্রকাশিত হয়। কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সংশোধন বা সংযোজন সাপেক্ষে এটা গ্রহণ করা হলে সে স্বচ্ছ প্রক্রিয়াটি চালু হওয়ার সুযোগ পেত। অন্তত যুগ্ম সচিব স্তর পর্যন্ত পদোন্নতিতে দলীয় বিবেচনার অভিযোগ কমে যেত। মেধা ও যোগ্যতা প্রাধান্য পেত দলীয় সমর্থকদের আড়ালে থাকা অযোগ্য ও মেধাহীনদের চেয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে খসড়াটিও অনিশ্চিত গন্তব্যে চলছে।
এ ধরনের পদোন্নতির জট কাটাতে গত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে (২০০৭-০৮ সময়কাল ব্যতীত) দফায় দফায় নির্ধারিত পদসংখ্যার অতিরিক্ত পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো স্তরেই কোনো শূন্যপদ ব্যতীত এত অধিকসংখ্যক কর্মকর্তার পদোন্নতির নজির খুবই কম। ২০০১-০৬ সময়কালের সরকার বিদায়লগ্নে উপসচিব স্তরে এ ধরনের একটি পদোন্নতি দিয়ে সিনিয়র সহকারী সচিবের পদ প্রায় শূন্য করে ফেলে। ২০০৭ সালে সিনিয়র সহকারী সচিবের প্রায় ৩০০ পদ (কিছু কমবেশি হতে পারে) সুপারনিউমারারি উপসচিব পদে উন্নীত করে কর্মহীন উপসচিবদের পদায়নের ব্যবস্থা করা হয়। বহুসংখ্যক উপসচিবকে বেশ কিছুকাল অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে বহাল রাখা হয়। এটা ছিল সমস্যার অস্থায়ী ও সাধারণ বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য একটি সমাধান। অনেকটা ডকট্রিন অব নেসেসিটি বলা যেতে পারে। কিন্তু সুপারনিউমারারি উপসচিবেরা তাঁদের প্রাধিকার অনুসারে সহায়ক কর্মকর্তা বা কর্মচারী ও অফিসকক্ষ পাননি। জেলা প্রশাসনে একাধিক উপসচিব থাকায় সমন্বয়ে বেশ কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হয়। আশা করা হয়েছিল, এ ধরনের বিষয় থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। তাই ২০০৭-০৮ সময়কালে উপসচিব পদে আদালতের নির্দেশে দেওয়া দু-চারটি ব্যতিক্রম ব্যতীত কোনো পদোন্নতিই দেওয়া হয়নি। কিন্তু সময়ান্তরে পরিস্থিতি পাল্টে দফায় দফায় পদোন্নতি ও শেষ দফায় বেশুমার পদোন্নতি সমস্যাটিকে গভীরতর করল।
যাঁরা ভাবছেন এ পদোন্নতিতে সরকারের কাজে গতি আসবে, তাঁরা সহসাই হিসাবটির ভুল ধরতে পারবেন। অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবদেরও উপসচিবদের ন্যায় সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করে মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করলে কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ে কোনো অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম সচিব মিলে ১০-১৫ জন কর্মকর্তা সরাসরি সচিবের নিয়ন্ত্রণে আসবেন। সংবিধানের ক্ষমতা বলে রাষ্ট্রপতি প্রণীত রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবেরা উইং প্রধান এবং সরাসরি সচিবের অধীনে কাজ করবেন। জানা যায়, কোনো কোনো মন্ত্রণালয় আগে থেকেই এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে যুগ্ম সচিবদের অতিরিক্ত সচিবের অধীনে কাজ করানো হচ্ছে। এখন হয়তো এটা আরও বাড়বে। বাড়বে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা এবং লঙ্ঘিত হতে থাকবে রুলস অব বিজনেস। নূতন পদোন্নতিপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিবেরা তাঁদের প্রাধিকার অনুসারে পরিবহন পুল থেকে সার্বক্ষণিক ব্যবহারের গাড়ি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কেননা এ ধরনের পদোন্নতি বিবেচনায় নিয়ে গাড়ি কেনা হয় না এবং তা সম্ভবও নয়। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের বাইরে খুবই গৌণ ধরনের পদে পদায়ন, অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম সচিবদের পদের মান অবনতি ঘটাবে। এর পরও অনেককে ওএসডি রাখতে হবে—সে পাল্লা আরও ভারী করে। তাই যে গতি বৃদ্ধির আশায় এ পদোন্নতি, তা বরং অচিরেই হতাশা ও ক্ষোভেরই সৃষ্টি করবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত অনেকের মাঝে। সঙ্গে থাকবে যাঁরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি পাননি অথচ চাকরিতে রয়ে গেলেন, তাঁদের ক্ষোভ। তাহলে গতিটা আসবে কী করে?
যেটা ঘটার ঘটে গেছে। তা ফেরানো যাবে না। তবে জনপ্রশাসনের যাঁরা কর্ণধার, তাঁদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে এর সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। যেখানে সুপারনিউমারারি পদ সৃজন করা সম্ভব, সেখানে সহসাই তা করে পদোন্নতিপ্রাপ্তদের পদায়ন করা দরকার। তাঁদের প্রাধিকার অনুসারে সুবিধাদি দেওয়ার বিষয়টিও যথাসম্ভব বিবেচনা করা যেতে পারে। যেসব জেলা প্রশাসক যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন, তাঁদের পদোন্নতিকৃত পদে নিয়ে আসাই যৌক্তিক। কেননা জেলা প্রশাসকের পদটি উপসচিবদেরই প্রাপ্য। আর এ পদে অপেক্ষাকৃত তরুণদেরই ভালো করার কথা। যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিব পদে যাঁরা মন্ত্রণালয়ে কাজ করছেন বা করবেন, তাঁদের আওতায় নিষ্পত্তিযোগ্য নথি অযাচিতভাবে ওপরের দিকে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করা দরকার। এতে সচিব বা মন্ত্রী অকারণ ভারাক্রান্ত হবেন না। নীতিনির্ধারণী বিষয় ব্যতীত অন্য বিষয়গুলো যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিব স্তরে নিষ্পত্তিযোগ্য। এ স্তরগুলো প্রশাসনের সিনিয়র পর্যায়ের পদ বলে বিবেচিত। মন্ত্রণালয়গুলো প্রয়োজনে তাদের ক্ষমতা অর্পণ পুনঃপর্যালোচনা করে দেখতে পারে। আর যেসব সৎ, যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন, (অনেকে হয়েছেন বারংবার) তাঁদের বিষয়টিও ন্যায়নীতি ও জনপ্রশাসনের স্বার্থে অচিরেই পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
পরিশেষে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রতিবছর নিয়োগের ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়াটিও বিবেচনায় আনা সময়ের দাবি। জনপ্রশাসনের ওপর অকারণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এর দক্ষতা ও মনোবলকে অনেকাংশেই নিচে নামিয়েছে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার কথা আমাদের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা হামেশাই বলে থাকেন। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান এর অন্যতম উপাদান একটি শক্তিশালী জনপ্রশাসন। মেধাবী, দক্ষ ও দলীয় প্রভাবমুক্ত একটি জনপ্রশাসন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সে আকাঙ্ক্ষা পূরণে অন্যতম সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করতে পারে। এটা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে সব দলই উল্লেখ করে। কিন্তু কারও কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ দেখা যায় না। বরং দেখা যায়, সবারই যাত্রা উল্টো পথে। হয়তো বা এটা তাঁদের অঙ্গীকারের ঘাটতি নয় বরং ঘাটতি রয়েছে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির। আর এতে অবদান রাখছে শীর্ষ স্তরের কাছাকাছি থাকা নেতৃত্বের একটি অর্বাচীন অংশ এবং জনপ্রশাসনে অন্যান্য সুবিধাভোগী ও প্রশ্নবিদ্ধ সততা বা যোগ্যতার অধিকারী কিছু কর্মকর্তা।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

No comments

Powered by Blogger.