পাকিস্তান-বাড়াবাড়ি ও ভুল হিসাব by নাজাম শেঠি

পাকিস্তানি রাজনীতির সবচেয়ে ক্ষমতাধর খেলোয়াড় হিসেবে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখার যে প্রবল প্রয়াস দেশটির সামরিক বাহিনী চালিয়ে আসছে, গত কয়েক বছরে তা বেশ বড় রকমের মার খেয়ে গেছে এবং সেই মারের ক্ষতিটা আর পূরণযোগ্য নয়। এটা ঘটেছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলে কতগুলো নতুন বিষয় যুক্ত হতে শুরু করেছে বলে; ওই বিষয়গুলোর ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে এ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের গতিমুখ কী হবে।


এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী বৈশিষ্ট্য অনুধাবনে এবং এর সঙ্গে নির্বিঘ্নে খাপ খাইয়ে নিতে সামরিক নেতৃত্বের ইচ্ছা ও সামর্থ্যের অভাবেরও প্রতিফলন রয়েছে। দেয়ালের লিখন জেনারেলরা কীভাবে পড়ছেন এবং কীভাবে সেটা গ্রহণ করছেন, তার ওপরই নির্ভর করছে একটা টেকসই জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ।
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাম্প্রতিক কতগুলো ব্যর্থতার ফলে এ দেশের জনগণের মধ্যে এর মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-বিদ্বেষী মনোভাব ছড়ানোকে একটা সুবিধাজনক কৌশল হিসেবে ব্যবহারের নীতির ফল হয়েছে উল্টো, ফলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আটকা পড়েছে এক নো ম্যানস ল্যান্ডে। সামরিক বাহিনী অপ্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ না করে পারে না, আবার প্রকাশ্যে আমেরিকাকে আলিঙ্গনও করতে পারে না ‘গাইরাত’ ব্রিগেডের উগ্র ইসলামপন্থী জাতীয়তাবাদীদের কারণে; সামরিক বাহিনীই এই উগ্রপন্থীদের মগজ ধোলাই করেছে, তাদের বিকাশ ঘটিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, গোপনে আফগান তালেবানকে লালনপালন করা আর প্রকাশ্যে পাকিস্তানি তালেবানকে শান্ত ও নিরস্ত্র করার যে কৌশল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী অবলম্বন করে আসছিল, তা-ও ব্যর্থ হয়েছে। আফগান তালেবানরা এখন সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি করছে, আর পাকিস্তানি তালেবানরা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে তৎপর হয়েছে।
তৃতীয়ত, সরকার, বিরোধী দল ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে খারাপ হয়েছে। সরকার প্রতিটি বিষয়ে সামরিক বাহিনীর সামনে নমনীয়ভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, কিন্তু সামরিক বাহিনীর উদ্ধত, অনধিকার চর্চামূলক আচরণ ও ক্লান্তিহীন সরকারবিরোধী প্রচারণায় সরকারের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে গভীর ক্ষোভ। মার্কিন বাহিনীর চালকবিহীন যুদ্ধবিমান (ড্রোন) থেকে গোলাবর্ষণ করে মানুষ হত্যা, রেইমন ডেভিস ও সাম্প্র্রতিক পত্র কেলেঙ্কারি বা ‘মেমোগেট’ নিয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কারসাজিপূর্ণ আচরণে এ দেশের সংবাদমাধ্যমও ক্ষুব্ধ হয়েছে। (রেইমন ডেভিস যুক্তরাষ্ট্র সেনবাহিনীর একজন সাবেক সেনা, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর কর্মী; পাকিস্তানে মার্কিন কনস্যুলেটে কর্মরত থাকা অবস্থায় ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি তিনি গুলি করে দুজন সশস্ত্র পাকিস্তানি ব্যক্তিকে হত্যা করেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার দাবি করে, ডেভিস যুক্তরাষ্ট্রের লাহোর কনস্যুলেটে কর্মরত কূটনীতিক হিসেবে আইনি সুরক্ষা ভোগ করেন, হত্যার অভিযোগে তাঁর বিচার করা যাবে না। কিন্তু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাঁর বিচারের ব্যবস্থা করে এবং ডেভিস দুই ব্যক্তিকে হত্যা করা ও অবৈধ অস্ত্র বহনের দায়ে পাকিস্তানের আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হন এবং তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু নিহত দুই ব্যক্তির দুই পরিবারকে মোট ২৪ লাখ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে ডেভিস কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান ছেড়ে চলে যান। আদালত তাঁকে সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দেন।— অনুবাদক) ওসামা বিন লাদেনের বিষয়ে সামরিক বাহিনীর তৎপরতায় দক্ষতার অভাব অথবা লাদেনকে সহযোগিতা করা প্রসঙ্গেও প্রশ্নের শেষ নেই। বিশেষ করে আইএসআইএর সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউদ্দিন বাট সম্প্রতি যখন ফাঁস করে দিলেন যে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ওসামা বিন লাদেনকে অ্যাবোটাবাদে ‘লুকিয়ে রেখেছিলেন’, তার পর থেকে নানা প্রশ্নের ঝড় ওঠে। এ ছাড়া স্বাধীনচেতা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হুমকি আসার পরই সাংবাদিক সালিম শাহজাদের নিহত হওয়ার ঘটনার পেছনেও আইএসআইএর হাত আছে বলে সন্দেহ করা হয়। সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর, আইএসআইয়ের কার্যালয়, সেনাদের মেস, মেহরান নৌঘাঁটি ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ওপর সন্ত্রাসবাদীরা যে রকম অনায়াসে হামলা করতে পেরেছে, তা-ও সংবাদমাধ্যমের একটা ক্ষোভের উৎস। আর শেষ পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে এখন বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারকর্মীদের গুম হয়ে যাওয়া ও তাঁদের ওপর নির্যাতনের বিষয়গুলোয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ও রাষ্ট্রবহির্ভূত মহলগুলোর ভূমিকা নিয়েও খোলামেলা লেখালেখি হচ্ছে। অর্থাৎ সংবাদমাধ্যম আর আগের মতো যেকোনো বিষয়ে সামরিক বাহিনীর ‘পথ’ অন্ধভাবে অনুসরণ করতে রাজি নয়। আর নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম তো চূড়ান্ত কথা বলে ফেলেছে; দলটি প্রকাশ্যে দাবি করেছে, রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর অনুপ্রবেশ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, সেনাবাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ছেঁটে ফেলতে হবে।
যদি এটা সত্য হয়, সামরিক বাহিনীর অবস্থান নিম্নগামী হচ্ছে, তাহলে সন্দেহজনক নানা মতলবে রাজনীতিতে নানা ধরনের কারসাজি করার ক্ষমতাও সামরিক বাহিনীর কমে যাচ্ছে। অতীতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সেনাপ্রধানের এক ধরনের জোটবদ্ধতার কারণে শাসকত্রয়ীর (রুলিং ত্রোইকা) মধ্যে সেনাপ্রধানই হতেন সবচেয়ে ক্ষমতাধর সদস্য। এখন প্রেসিডেন্টে ভূমিকার পরিবর্তন ঘটেছে এবং ক্ষমতার সমীকরণে আবির্ভাব ঘটেছে নতুন ও ক্ষমতাধর দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর। প্রধান বিচারপতি ইফতিখার চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিচার বিভাগ সামরিক বাহিনীকে জবাবদিহির মুখে ফেলে এমনই কোণঠাসা করে ফেলেছে, যেমনটি এর আগে কখনো ঘটেনি। (১৯৯০ সালে মেহরান নৌঘাঁটিতে হামলার ঘটনা, বেলুচিস্তানের লোকজনের হত্যা ও গুম হয়ে যাওয়া, বন্দী অবস্থায় তালেবান সদস্যদের হত্যার শিকার হওয়া ইত্যাদি প্রশ্নে।) আর পাকিস্তানের সম্প্রচার গণমাধ্যম এখন কোটি কোটি সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে, সাহসিকতার সঙ্গে তারা জনসাধারণের সচেতনতা বাড়িয়ে তুলছে। রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ধরনের হস্তক্ষেপই এখন আর কেউ অনুমোদন করবে না।
সামরিক বাহিনীর অহংকারে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, জেনারেল আশফাক কায়ানি তা সারানোর জন্য সম্প্রতি একটা চেষ্টা নিয়েছেন। প্রতিরক্ষা বাজেটের আকার নিয়ে তিনি আপত্তি তুলেছেন এবং বেলুচিস্তানের অস্থিরতা নিরসনে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তাঁর এসব কথাবার্তা খুব কম লোকের কাছেই গ্রহণযোগ্য। সেনাপ্রধান কায়ানি বলেছেন, প্রতিরক্ষা বাজেট জাতীয় বাজেটের ১৮ শতাংশ; কিন্তু সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বেতন-ভাতা, পেনশন ও আনুষঙ্গিক সব ব্যয় যোগ করলে প্রকৃতপক্ষে তা দাঁড়ায় ২৫ শতাংশের কাছাকাছি। আর বেলুচিস্তানের অস্থিরতা নিরসনের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা নেই বলে যে দাবি তিনি করেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, বেলুচিস্তানে ‘আইনশৃঙ্খলা’ রক্ষার দায়িত্বে সামরিক বাহিনীর যে রেঞ্জার ও ফ্রন্টিয়ার কর্পস মোতায়েন রয়েছে, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করছে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা পরিচালিত হচ্ছে সেনা কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় এবং সেই সেনা কর্মকর্তারা জবাবদিহি করেন সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তরের কাছে। আর সরকারি বিভিন্ন পদে ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে সেনা কর্মকর্তাদের বিরাট উপস্থিতিও কম প্রশ্নের সৃষ্টি করেনি।
সেনা নেতৃত্বের বর্তমান সমস্যাগুলোর অনেকটাই সৃষ্টি হয়েছে সামরিক বাহিনীর প্রবল মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতালিপ্সা ও ভুল হিসাব থেকে। অতীতের দিনগুলোয় পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতিকে চালিয়ে দেওয়া যেত বিজয় ও অর্জন হিসেবে, অভ্যুত্থানকারী জেনারেলরা নিজেদের হাজির করতে পারতেন জাতির রক্ষক বা ত্রাণকর্তা হিসেবে। কারণ তখন সহজে বা অবাধে তথ্য পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন আর ওসব করা সম্ভব নয়। যুবসমাজের পক্ষ থেকে ‘পরিবর্তনের’ প্রচণ্ড দাবির যে ঝড় উঠেছে, তার মুখে পড়ে আজ সরকার, বিরোধী দল, সংবাদমাধ্যম, বিচার বিভাগ—সবাই নিজেকে তুলে ধরতে চাইছে ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ হিসেবে, কারণ প্রতিষ্ঠান হলো বিদ্যমান অবস্থার (স্টেইটাস কৌ) আরেক নাম। আরব বসন্তের পর তৃতীয় বিশ্বে এখনকার আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও সামরিক প্রাধান্যের বিরুদ্ধে।
পাকিস্তানের জন্য বিপর্যয়কর পরিণতির সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ৬৪ বছরের ‘জাতীয় নিরাপত্তাভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামোর ভাবনা’ও ধসে পড়েছে। এখনই সময় তাদের চিরতরে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার, যেন দেশের স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্য বেসামরিক নাগরিকেরা বিকল্প একটা ‘সামাজিক নিরাপত্তাভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো ভাবনা’র বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে পারে। যদি তারা তা না করে, তবে এক ভয়ংকর পরিণতি আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
নাজাম শেঠি: পাকিস্তানের সাংবাদিক। সাপ্তাহিক দ্য ফ্রাইডে টাইমস-এর সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.