গ্যাসের নতুন মজুদ-স্বস্তি ও আত্মবিশ্বাসের নাম রশিদপুর

মৌলভীবাজারের রশিদপুরের গ্যাসক্ষেত্রে নতুন সোয়া তিন ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ পাওয়ার ঘোষণা পেট্রোবাংলা এমন সময় দিল, যখন দেশব্যাপী এ জ্বালানির তীব্র সংকট চলছে। সরবরাহ ঘাটতির কারণে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও গ্যাসভিত্তিক শিল্প উৎপাদনের পাশাপাশি গৃহস্থালি কাজেও সম্প্রতি নানা বিঘ্ন চলছে।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ এখনই উত্তোলনযোগ্য এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ সে কাজে স্বভাবতই বিলম্ব করা হবে না। ফলে প্রাকৃতিক গ্যাসের দৈনন্দিন চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ৫০০ এমএমসিএফের যে ব্যবধান রয়েছে, নতুন মজুদ থেকে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ শুরু হলে তা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে বলে প্রত্যাশা। আমরা জানি, রশিদপুর রাষ্ট্রীয় খাতের সেই পুরনো পাঁচ গ্যাসক্ষেত্রের একটি যেগুলোর স্বত্ব ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় একক সিদ্ধান্তে মাত্র ৪৫ লাখ পাউন্ডে বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে কিনে রেখেছিলেন। প্রায় দুই দশক ধরে প্রতিদিন সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের পর সেখানে আবারও বিপুল পরিমাণ নতুন মজুদ আবিষ্কার তার দূরদর্শিতার কথাই আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন মজুদ থেকে আগামী ৫৭ বছর ধরে গ্যাস উত্তোলন করা যাবে। সব মিলিয়ে রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্র আমাদের জাতীয় জীবনে নিঃসন্দেহে এক স্বস্তিকর নাম হয়ে থাকবে। তবে নতুন মজুদপ্রাপ্তির এ সংবাদের তাৎপর্য কেবল জ্বালানি সরবরাহে সীমাবদ্ধ নয়। দেশের ইতিহাসে রশিদপুরেই প্রথম রাষ্ট্রীয় কোম্পানি নিজস্ব উদ্যোগে থ্রিডি বা ত্রিমাত্রিক জরিপ চালাতে সক্ষম হয়েছে। জরিপ দলটিও ছিল বাপেক্সের তরুণ প্রযুক্তিকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত। বাপেক্সের পক্ষে এখনই হয়তো সমুদ্রবক্ষে জরিপ চালানো সম্ভব নয়; কিন্তু স্থলভাগে যে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা খ্যাতিমান বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, আমাদের তরুণরা যে বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারে, রশিদপুরে নতুন মজুদ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণ হয়েছে। পেট্রোবাংলার সময়োপযোগী ও দূরদর্শী পদক্ষেপের কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হবে। আমাদের মনে আছে, গ্যাস সরবরাহ সংকটের কারণে ২০০৮ সালে পুরনো ক্ষেত্রগুলোর মজুদ নতুন করে নিরূপণের সিদ্ধান্ত নেয় রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিটি। এ জন্য সিলেট গ্যাসফিল্ডস লিমিটেডের তিনটি এবং বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ডস কোম্পানির দুটি ক্ষেত্রে বাপেক্সকে দিয়ে ত্রিমাত্রিক সার্ভে করার উদ্যোগ নেয় তারা। ওই বছর অক্টোবরে সরকার ১৬৪ কোটি টাকার তহবিলও অনুমোদন করে। সে সময় এর সাফল্য নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলেও, রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের সাফল্য প্রদর্শনের মাধ্যমে আমাদের প্রযুক্তিবিদরা তাকে অমূলক প্রমাণ করেছেন। আমরা আনন্দিত যে, রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস কোম্পানির আত্মবিশ্বাস বিফলে যায়নি। ইতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি এই জরিপের সাফল্য অন্যান্য অনুসন্ধান কাজেও প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে। বিদেশি কোম্পানিগুলো এর আগে জরিপ শেষে তাদের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম বিদেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। রশিদপুরে ব্যবহৃত বাপেক্সের যন্ত্রপাতি অন্যান্য গ্যাসক্ষেত্রেও কাজে লাগবে। নতুন মজুদ পেতে রাষ্ট্রীয় অর্থের বিপুল সাশ্রয়ের বিষয়টিও স্পষ্ট। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পরিচালিত সব ত্রিমাত্রিক জরিপের মধ্যে সবচেয়ে কম খরচ হয়েছে এখানে। বিদেশি কোম্পানির জরিপে যেখানে ২০০৮ সালে মৌলভীবাজারেই বর্গকিলোমিটারপ্রতি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে, সেখানে বাপেক্স খরচ করেছে মাত্র সাড়ে ১১ লাখ টাকা। পেট্রোবাংলা, বাপেক্স ও তরুণ জরিপ দলটিকে আমরা অভিনন্দন জানাই। তাদের আত্মবিশ্বাস ও সাফল্য নিশ্চয়ই খনিজ জ্বালানি অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
 

No comments

Powered by Blogger.