জ্বালানি খাত-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে অর্থায়ন by ম. তামিম

আমাদের দেশে অনেক রাজনীতিবিদ, আমলা ও বিশেষজ্ঞ এমন ভাষায় কথা বলেন, যাতে ধারণা হয় টাকা কোনো সমস্যা নয়। সরকার ইচ্ছা করলেই সবকিছু করতে পারে, বিশেষ করে হিসাবটা যখন টাকায় দেওয়া হয়, তখন এই ধারণাটা আরও জোরালো হয়। এক হাজার কোটি টাকা ১২৫ মিলিয়ন ডলারের চেয়ে সহজলভ্য মনে হয়।


সম্প্রতি পদ্মা সেতু নির্মাণ অথবা রাস্তাঘাট ঠিক করতে টাকার স্বল্পতা এ ব্যাপারে অনেকেরই ঘুম ভাঙিয়েছে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে টাকার তারল্যের অভাব, ব্যাংকগুলোর উচ্চসুদে টাকা সংগ্রহের প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে টাকা জোগান দেওয়ার সীমাবদ্ধতার চিত্রটাকে প্রকট করেছে। প্রায় সাত মাস আগে স্বাক্ষরিত একটি আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থায়ন এখন অবধি ঝুলে থাকায় এটা প্রতীয়মান যে বেসরকারি অর্থায়নেও বেশ নাজুক অবস্থা বিদ্যমান।
ওপরের এই প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অবকাঠামো এবং জ্বালানি সরবরাহের প্রকৃত অর্থায়নের চিত্রটা তুলে ধরা দরকার। বর্তমানে ডলারের মূল্য ৮৫ টাকায় ঠেকেছে, তবে হিসাবের সুবিধার জন্য ৮০ টাকা ব্যবহার করা হবে। অর্থাৎ এক বিলিয়ন ডলারের জন্য আট হাজার কোটি টাকা বা ১০০ মিলিয়নের জন্য ৮০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। নিচের সব হিসাবই রক্ষণশীল।

জ্বালানি আমদানি
তেল: বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য বছরে তিন মিলিয়ন টন ডিজেল বা ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে হচ্ছে। ডিজেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১১০ ডলার ধরলে এক মিলিয়ন টন তেলের জন্য (৭ দশমিক ৫ ব্যারেল/টন) প্রয়োজন ৮২৫ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ তিন মিলিয়ন টনের জন্য দরকার ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার (২০ হাজার কোটি টাকা/বছর)।
কয়লা: বুড়ো আঙুলের নিয়ম হলো প্রতি এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বছরে তিন মিলিয়ন টন কয়লার প্রয়োজন। বড়পুকুরিয়া বা ফুলবাড়ীর মানের কয়লা অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনতে গেলে ন্যূনতম খরচ পড়বে ১৫০ ডলার/টন (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা এই মূল্য দিচ্ছে)। হিসাবে এক হাজার মেগাওয়াটের জন্য বছরে প্রয়োজন ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের কয়লা। প্রস্তাবিত সাত হাজার মেগাওয়াট আমদানিনির্ভর কয়লার জন্য বছরে দরকার হবে তিন বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ২৪ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের কয়লা আমদানির অবকাঠামো তৈরির হিসাব ধরলে কয়লার মূল্য ১৭০ ডলার/টনে গিয়ে ঠেকতে পারে।
তরল গ্যাস: তরল গ্যাস বা এলএনজির আন্তর্জাতিক মূল্য স্বল্পকালীন বাজারে প্রতি হাজার ঘনফুটে ছয় থেকে ২৪ ডলার পর্যন্ত ওঠানামা করে। বছর দুয়েক আগে জাপান কাতার থেকে ২০ বছরের একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ১০ দশমিক ৭৫ ডলার/হাজার ঘনফুটের স্থির মূল্যে। বাংলাদেশ এখন যদি একটি মধ্যমেয়াদি চুক্তিও করে তাতে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের মূল্য ১২ ডলারের নিচে হবে না। প্রতিদিন প্রস্তাবিত ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট তরল গ্যাস আমদানিতে বছরে খরচ পড়বে ৩৬৫x৫০০x১২x১০০০=২.২ বিলিয়ন ডলার (১৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা)।
আমাদের যেকোনো একটি বা একাধিকের মিশ্র জ্বালানি আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে শুধু বিদ্যুৎ খাতেই বছরে অন্তত তিন থেকে চার বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে (ছয় হাজার মেগাওয়াট ধরে)। জ্বালানির মূল্য খুবই ওঠানামা করে এবং সেই বিবেচনায় আমাদের পাঁচ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তুতি থাকতে হবে। দেশি কয়লা উৎপাদনে খরচ পড়বে ৭০-৯০ ডলার/টন এবং আইওসি উৎপাদিত গ্যাসের বর্তমান মূল্য (বাংলাদেশের লভ্যাংশ ধরে) ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৭ ডলার/হাজার ঘনফুট।

অবকাঠামো বিনিয়োগ
প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি ছাড়াও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদনের অবকাঠামোতেও ভবিষ্যতে প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। স্থলভাগে প্রতি হাজার ঘনফুট নতুন গ্যাস আবিষ্কারের জন্য এক ডলার ব্যয় করার প্রস্তুতি থাকতে হবে। অর্থাৎ এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে খরচ হবে এক বিলিয়ন ডলার। সমুদ্রে এই খরচ আরও বেশি হবে। প্রস্তাবিত ভাসমান তরল গ্যাস পুনঃগ্যাসকরণের অবকাঠামোতে খরচ হবে অন্তত এক বিলিয়ন ডলার। উন্মুক্ত কয়লাখনির জন্য তিন থেকে পাঁচ বছরে তিন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে (১০-১৫ মিলিয়ন টন/বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরে)। বড়পুকুরিয়ায় প্রাথমিক প্রাক্কলন ছিল ১২৫ মিলিয়ন ডলার, যা পরে ২০০ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছিল। এর বার্ষিক উৎপাদন এক মিলিয়ন টন।
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। সাধারণ কয়লা, সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা, সাধারণ গ্যাস, কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস ইত্যাদি নানা ধরনের পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণের খরচ ১ দশমিক শূন্য থেকে ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার/মেগাওয়াট হতে পারে। অর্থাৎ প্রতি এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে গড়ে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। বুড়ো আঙুলের নিয়ম বলে এর সঞ্চালন ও বিতরণের বিদ্যুৎ লাইনের জন্য আরও এক বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। যদি আমরা বর্তমান অবকাঠামোর কিছু অংশ ব্যবহার করি, তাহলে এই খরচ ৬০০ মিলিয়নে নামতে পারে। তাহলে প্রতি এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে অবকাঠামো খরচ হবে অন্তত ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্য এক হাজার মেগাওয়াটে পাঁচ থেকে সাত বছরে অন্তত তিন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে শুধু কেন্দ্রের জন্য।
মোদ্দা কথা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার প্রয়োজন হবে। ওপরের হিসাবে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি, তবে দীর্ঘদিন তেলনির্ভর উৎপাদনে অর্থনীতিতে ধস নামবে। কারণ তেলভিত্তিক কেন্দ্রের উৎপাদন খরচ সর্বোচ্চ। আগামী পাঁচ বছরে যদি পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ করার পরিকল্পনা করা হয়, তাহলে শুধু অবকাঠামোতেই লাগবে (৫x১.৮) নয় বিলিয়ন ডলার। নিজস্ব জ্বালানি অনুসন্ধান ও উৎপাদনে লাগবে চার বিলিয়ন ডলার (কয়লা দুই, গ্যাস দুই)। যদি আমরা আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করি, তাহলে পুরোটাই কয়লার জ্বালানি খরচ লাগবে বছরে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন এবং পুরো তেলে লাগবে ছয় বিলিয়ন ডলার (পঞ্চম বছরে)। এ দুটোর মিশ্রণে লাগবে বছরে ন্যূনতম চার বিলিয়ন ডলার। এই হিসাব বর্তমানের জ্বালানি আমদানির অতিরিক্ত।
দেশীয় জ্বালানি (কয়লা বা গ্যাস) ব্যবহার করে এই খরচ বছরে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব, যা কিনা দীর্ঘমেয়াদি সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়ক হবে। অবকাঠামোতে ১০ বিলিয়ন ডলার ধরলেও আগামী পাঁচ বছরে ৮০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে অর্থাৎ বছরে ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি খরচ বছরে ২০ হাজার কোটি থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে এই অঙ্কগুলো অসম্ভব মনে হচ্ছে, কিন্তু পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে এটাই কঠিন বাস্তবতা। বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া কোনো সরকারের পক্ষেই এই বিপুল বিনিয়োগ ও অর্থায়ন সম্ভব নয়। সুতরাং কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব না করে অনতিবিলম্বে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ম. তামিম: অধ্যাপক, বুয়েট, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানিউপদেষ্টা।
mtamim@buet.ac.bd

No comments

Powered by Blogger.