সৌরবিদ্যুৎ-আঁধার থেকে আলোর পথে by এম ফাওজুল কবির খান

‘আঁধার থেকে আলোয় এখন সারা বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে আমরা ২০০৩ সালে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) সৌরবিদ্যুৎ কার্যক্রম শুরু করি। এই কার্যক্রমের অধীনে এখন পর্যন্ত ১৩ লাখ বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সৌরবিদ্যুৎ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।


সর্বমোট সুবিধাভোগীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্দ্বীপ উপজেলায় এ প্রকল্পের অধীনে স্থাপিত ১০ লাখ সোলার হোম সিস্টেমের উদ্বোধন করেন। জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক, যেকোনো মানদণ্ডেই পরিমাপ করা হোক না কেন, ইডকলের সৌরবিদ্যুৎ কার্যক্রমের অগ্রগতি বিস্ময়কর।

সূচনাপর্বের কথা
বিশ্বব্যাংক-সমর্থিত এই প্রকল্পের শুরুতেই প্রকল্পের নকশা নিয়ে আমাদের সঙ্গে তাদের দুটি বিষয়ে মতভেদ হয়। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব ছিল ইডকল নিজে সোলার হোম সিস্টেম কিনবে। ফলে একসঙ্গে অনেক বেশি সিস্টেম সস্তায় কেনা যাবে। আমাদের বক্তব্য ছিল, এটি ইডকলের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়; বরং ইডকলের সহযোগী সংস্থাগুলো যারা বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে, তাদের এ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। বিশ্বব্যাংক এই শর্তে আমাদের পরামর্শ মেনে নেয় যে দুই বছর পর সোলার হোম সিস্টেমের মূল্য-বিষয়ে সমীক্ষা চালানো হবে। পরে সমীক্ষায় দেখা যায়, ইডকলের কর্মসূচির আওতায় ব্যবহূত সোলার হোম সিস্টেমের মূল্য বিশ্বব্যাংক-সমর্থিত সব সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচির মধ্যে সর্বনিম্ন। আমাদের দৃঢ় অবস্থানের কারণে বিশ্বব্যাংক গ্রামীণশক্তি এবং ব্র্যাকের অংশগ্রহণের বিষয়ে সম্মতি প্রদান করে। বিশ্বব্যাংকের অন্যান্য প্রকল্পের মতো যথারীতি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পেও একজন বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। এই ইউরোপীয় পরামর্শক আমাদের কাজে সহায়তার পরিবর্তে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে থাকলে আমরা তাঁকে প্রত্যাহার করার জন্য বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ জানাই। বিশ্বব্যাংক বিকল্প পরামর্শক দিতে চাইলে বলি, আমরা যদি প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারি, তাহলেই কেবল পুনরায় বিদেশি পরামর্শক গ্রহণ করব। তার আর প্রয়োজন হয়নি। আমাদের দেশীয় বিশেষজ্ঞরাই সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পকে সফল করেছেন। পরে ইডকলের কর্মকর্তারা বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তাদের সৌরবিদ্যুৎ-বিষয়ে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন।
প্রথমে আমি নিজেও সৌরবিদ্যুতের কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম না। তাই ব্যক্তিগত অর্থে সন্দ্বীপে নিজের বাড়িতে দুটি সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হই। সন্দ্বীপে ১০ লাখতম সোলার হোম সিস্টেম এই কারণেও তাৎপর্যবহ। প্রথম দিকে গ্রামে সোলার হোম সিস্টেমের প্রদর্শনীকালে কেউ কেউ মনে করতেন সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ কেবল জাদুকররাই দেখাতে সক্ষম।

মধ্যবর্তী সংকট
২০০৪ সালে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের অতি দ্রুত অগ্রগতি এর সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রকল্পের জন্য ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেলেও এ জন্য ভর্তুকির অভাব দেখা দেয়। এ সময় আমি বার্লিনে একটি সভায় নিমন্ত্রিত হই। অক্টোবর মাসে রোজার মধ্যে বার্লিনে যেতে আমি এই শর্তে রাজি হই যে ইডকল সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচি সম্পর্কে আমাকে একটি ভিডিও প্রদর্শনের সুযোগ প্রদান করা হবে। অনুষ্ঠানের কর্মসূচি পূর্বনির্ধারিত ছিল; তাই মূল অনুষ্ঠানের পরিবর্তে আমাকে মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে ভিডিও প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়।
প্রায় ২০ মিনিটের ভিডিও চিত্রটির ছয়-সাত মিনিট দেখানোর পরই অনুষ্ঠানের সভাপতি আমাকে থামতে বলেন। আমি অপমানিত বোধ করি এবং সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হই। কাজ শেষে যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত ধুচ্ছিলাম, হঠাৎ কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছনে তাকালাম। পরিচিতির পর জার্মান সরকারের কর্মকর্তা আমাকে এভাবে থামিয়ে দেওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, প্রকল্প চালিয়ে যেতে ভর্তুকির জন্য আমার কত অর্থ প্রয়োজন হবে। আমি বললাম, প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার। তিনি আমাকে দিনের শেষে দেখা করতে বললেন। বিস্তারিত শুনে তিনি বললেন, তিনি কোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন না, তবে চেষ্টা করবেন। পরে জার্মান-সহায়তা পাওয়া যায়। এখন ইডকল আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর কাছে একটি পছন্দের সহযোগী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

সাফল্যের কারণ
ইডকলের সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচির সাফল্যের কয়েকটি প্রধান কারণ উল্লেখযোগ্য। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইডকলের নৈতিক অঙ্গীকার ও দায়িত্ববোধ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, সহযোগী সংস্থাগুলোর তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গতিশীলতা ও স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের কারিগরি জ্ঞানকে এ প্রকল্পে একত্র করা হয়েছে। এ ছাড়া ইডকলের তরুণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রমাণ করেছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বা অদক্ষতা অনতিক্রম্য নয়।
অনেক সরকারি কর্মকর্তার মতো ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের মনেও প্রশ্ন ছিল। সৌরবিদ্যুতায়নের ক্ষেত্রে, একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে, এসব সংস্থার কর্মীদের কাজ দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছে। কর্মীরা নির্দ্বিধায় মই দিয়ে ঘরের চালে ওঠেন, সৌর প্যানেল স্থাপন করেন, ফুপু-খালা-চাচি-মাসি-পিসি বলে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেন। রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে সিস্টেম রক্ষণাবেক্ষণ ও কিস্তির টাকা আদায় করেন। তাঁরা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং নিবেদিতপ্রাণ।
উল্লেখ্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০৫ সালে ভূ-উপগ্রহ যোগাযোগের মাধ্যমে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্র থেকে এ প্রকল্পের অধীনে ফেনীতে স্থাপিত ৫০ হাজার সোলার হোম সিস্টেমের উদ্বোধন করেন। ওই সময় দেওয়া এক বাণীতে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফুল প্যাটেল লিখেছিলেন, ‘যেকোনো প্রকল্পেরই নির্ধারিত সময়ের তিন বছর আগে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন একটি বিরল ঘটনা। ২০০২ সালে যখন প্রকল্পটি তৈরি করা হয়, তখন মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরে বাংলাদেশের পল্লি অঞ্চলে ৫০ হাজার সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের ধারণাটি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী মনে হয়েছিল। কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে এবং তা করা হয়েছে সর্বোত্তম উপায়ে। কীভাবে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিরা একটি ভালো সাংগঠনিক পরিবেশে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারেন, এ প্রকল্পটি তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।’
ইডকলের সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচির সাফল্যের একটি প্রধান কারণ হলো, বিভিন্ন সময়ে সরকার বিশেষ করে অর্থমন্ত্রীরা ইডকলকে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দিয়েছেন, একইসঙ্গে তাঁরা প্রতিষ্ঠানটিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তও রেখেছেন। সচরাচর আমাদের দেশে দুই নেত্রীকে একসঙ্গে ধন্যবাদ জানানোর উপলক্ষ ঘটে না। ধন্যবাদ দুই নেত্রীকে, সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচিতে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান ও ইডকলকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য। আশা করি, ভবিষ্যতেও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত থাকবে, ইডকলকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা হবে এবং সৌরবিদ্যুৎ কার্যক্রমের আরও প্রসার ঘটবে।
এম ফাওজুল কবির খান: সাবেক বিদ্যুৎসচিব ও প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইডকল।

No comments

Powered by Blogger.