সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-দেশ চলবে কার কথায়? by আবু সাঈদ খান

এটি ধ্রুব সত্য যে, পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কাছে নতজানু হয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে না। আমাদের নিজস্ব নীতি ও পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। সরকার এমন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে তা যুক্তিগ্রাহ্য। তবে কোনো বিপ্লবীপনা সমর্থনযোগ্য নয়। আর আজকের বিশ্বব্যবস্থায় সরকারের নিজস্ব নীতি গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ পশ্চিমা মুরবি্বদের প্রেসক্রিপশন বহু দেশ অনুসরণ করে না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক দাতাদের সাহায্য অগ্রাহ্য করার যুক্তি নেই, আবার ক্ষতিকর শর্তে সাহায্য গ্রহণও যৌক্তিক নয়

আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে_ তা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থানে, সংঘাত-সংঘর্ষও দৃশ্যমান_ এরই মধ্যে ঢাকা ঘুরে গেলেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও' ব্লেক। তার ঢাকায় উপস্থিতি, রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা, ক্ষমতার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রতি উপদেশ বিতরণ_ কারও কাছে আশাজাগানিয়া মনে হতে পারে, আবার কারও কাছে তা মর্মপীড়ারও কারণ। ব্লেকের মিলেমিশে চলার উপদেশকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন সত্য, কিন্তু তার মন্তব্যের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এক সময়ের বাম রাজনীতিক, আওয়ামী লীগ নেতা ও রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, 'ব্লেক সাহেবদের কথায় বাংলাদেশ চলে না। তাদের কথায় যদি বাংলাদেশ চলত, তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বাংলাদেশ চলে বাংলাদেশের কথায়, বাংলাদেশের জনগণের কথায়।' সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্য হাততালি পাওয়ার মতোই। এ ক্ষেত্রে তালি দিতে কারও কার্পণ্য থাকাও উচিত নয়।
এটি ভুলে যাওয়ার বিষয় নয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে বাংলার মুক্তিকামী মানুষের ওপর আঘাত হানতে চেয়েছিল। তাদের সব ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায় ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃঢ় অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক তৎপরতায়। সব প্রতিকূলতার মুখেও আমরা একাত্তরে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছি।
অতি সম্প্রতি ১/১১-এর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারতসহ সব দেশের কূটনীতিকরা কী চেয়েছিলেন, তা কারও অজানা নয়। তবে সেই বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়াকে রুখে দিয়েছিল বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা। এমন আরও নজির তুলে ধরা যেতে পারে। তাতে প্রমাণিত হবে যে, বাংলাদেশ কারও কথায় চলে না, চলেছে জনগণের আকাঙ্ক্ষায়, স্বাধীন চিন্তায়। তবে কথাটি কি সর্বৈব সত্য?
আমরা বহু ক্ষেত্রে বিদেশিদের খবরদারিতে চলছি, তাদের হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিয়েছি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই আমরা নতজানু পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছি। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তাদেরই হুকুমে আমাদের রাজনীতি-অর্থনীতি পরিচালিত হয়েছে। পরবর্তীকালে বাইরের হস্তক্ষেপের প্রবণতা বেড়ে গেছে বহুগুণ। সুযোগটি তৈরি করে দিয়েছে ভ্রান্ত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাজনীতি, হানাহানির রাজনীতি। যখন রাজনীতিকরা কলহ করবেন, ল্যাং মারামারি করবেন, সংঘাতের পথে পা বাড়াবেন, তখন বিদেশিরা উপদেশ দিতে আসবেন_ সেটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কেও সরকার বিদেশিদের কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের পরিণতিতেই সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল; কিন্তু আদালতের দোহাই পেড়ে গত বছর তা রহিত করা হলো। এটি না করা হলে রাজনীতিতে এ কলহ সৃষ্টি হতো না। বিদেশিদের নাক গলানোর প্রশ্নই দেখা দিত না। শুধু এবার নয়, বাইরের শক্তিকে ডেকে এনে মধ্যস্থতার আহ্বান জানানো হয়েছে অতীতেও। তাদের কাছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি যে কতবার কত ইস্যুতে ধরনা দিয়েছে, একে অপরের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে, তাদের সালিশও মেনেছে তার ইয়ত্তা নেই। তবে নালিশ ও সালিশ করার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের চেয়ে বিরোধী দলই বেশি উৎসাহী থাকে। সরকারি দল মাঝে মধ্যে বিদেশ বিরোধিতার ছদ্ম-বিপ্লবীপনাও দেখায়। এই যখন পরিস্থিতি, তখন ব্লেক সাহেবদের দোষ দিয়ে কী লাভ!
বাইরের খবরদারির বিরুদ্ধে জনমনে একটা সুস্পষ্ট প্রতিরোধ ক্রিয়াশীল। ফলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার মন্তব্যের জন্য অনেক বাহবা পাচ্ছেন। তার সাবেক বাম সহকর্মীরা হয়তো বলছেন, আমাদের সুরঞ্জিতদার বিপ্লবী জোস এখনও রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উক্তি মহাজোট সরকারের নীতিকে কি প্রতিফলিত করে? যে সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে সদা তৎপর, মার্কিন কূটনীতিকদের আবদার রক্ষা করতে গিয়ে অতি সম্প্রতি কনকো-ফিলিপসের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থবিরোধী বঙ্গোপসাগরের গ্যাস উত্তোলন চুক্তি করেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও মার্কিননীতির সমর্থক হিসেবেই হাজির হয়েছে, তখন সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কি কথার কথা বলেছেন, নাকি এর অন্য তাৎপর্যও আছে?
অবশ্য কেবল আওয়ামী লীগ সরকার নয়, এ যাবৎকালের সব সরকারই সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের পাহারাদার হিসেবে কাজ করেছে। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের নীতি বেদবাক্যের মতো মেনে চলেছে। এই নীতি মেনে একদা ব্যাপকভাবে বিরাষ্ট্রীয়করণ আর কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাত থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহারের আত্মঘাতী পদক্ষেপ নিয়েছে, যদিও জনগণের প্রবল বিরোধিতায় সে নীতি থেকে খানিকটা সরে এসেছে। কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটেরাদের হস্তগত হয়েছে। দেদার লুটপাট চলছে এখনও। প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনে বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তিতে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে ৫০ বছরের গ্যাস মজুদ রাখার নীতি এবং উন্মুক্ত কয়লা উত্তোলন না করার সিদ্ধান্ত জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে সরকারের যৌক্তিক অবস্থান। এ অবস্থানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে কনকো-ফিলিপসের সঙ্গে সমুদ্রবক্ষে গ্যাস উত্তোলনের যে চুক্তি হয়েছে, সে অনুযায়ী কোম্পানিটির গ্যাস রফতানির সুযোগ রয়েছে। এটি ৫০ বছরের গ্যাস মজুদ রাখার পূর্বঘোষিত নীতির লঙ্ঘন।
অতি সম্প্রতি পদ্মা সেতু ইস্যুতেও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ছাড়াই আমরা পদ্মা সেতু করব। এতে পুলকিত হয়ে কোনো বামপন্থি বন্ধুও বিশ্বব্যাংককে একহাত দেখিয়ে দিচ্ছেন। বলাবাহুল্য, সরকারের এই অবস্থান কোনো নীতিগত ব্যাপার নয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে অনেক প্রকল্পই কার্যকর রয়েছে। কেবল আপত্তি পদ্মা সেতুকে নিয়ে কেন?
বিশ্বব্যাংক সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে যে, তার নিজস্ব ঠিকাদারি ফার্ম কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আন্তর্জাতিক দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এ কথা যদি সত্য হয়, তবে দুটি স্বার্থের প্রস্তাব থাকতে পারে_ বিনিময়ে অর্থ কিংবা মন্ত্রীর নিজস্ব ঠিকাদারি ফার্মের জন্য সাব-কন্ট্রাক্ট। এ ঘটনার পরই সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা বলতে শুরু করেন যে, না এমন কিছু ঘটেনি, মন্ত্রী দুর্নীতি করেননি, ঘুষ চাননি ইত্যাদি। অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত করে জানিয়েছে যে, না এতে মন্ত্রীর কোনো দুর্নীতি নেই। এ প্রসঙ্গে একটি কথা উঠতে পারে_ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিককে যোগাযোগমন্ত্রী, আমদানি-রফতানিকারককে বাণিজ্যমন্ত্রী করায় কোনো আইনগত বাধা নেই, কিন্তু সেটি কতটুকু নীতিনিষ্ঠ? এ ক্ষেত্রে পক্ষপাতের সুযোগকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সে যা-ই হোক, বিশ্বব্যাংক তাদের বক্তব্যে অটুট। সঙ্গত কারণে বিশ্বব্যাংকের উচিত হবে তথ্য-প্রমাণ হাজির করা।
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের পর সরকার মন্ত্রীকে সরিয়ে দিয়েছে। এখন বিশ্বব্যাংকের সহায়তা নেওয়ার পথে বাধা কোথায়? কিন্তু সেদিকে না গিয়ে সরকার এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। এখন প্রশ্ন, মালয়েশিয়া কি বিশ্বব্যাংকের চেয়ে সহজ শর্তে চুক্তি করবে? যেখানে বিশ্বব্যাংকের সুদ হচ্ছে ০.৭৫%, সেখানে মালয়েশিয়ার বিনিয়োগের সুদ ৫%-এর নিচে হবে না। ইতিমধ্যে পত্রিকান্তরে খবর এসেছে, মালয়েশিয়া, দুবাই থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে, প্রযুক্তি নেবে চীনের কাছ থেকে। এর মানে তাদের কাজ ব্যবস্থাপনা, অর্থাৎ ঠিকাদারি। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া এই চুক্তি যদি হয়, তা কতটুকু জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে হবে সে প্রশ্ন সহজেই তোলা যায়।
আসলে বিশ্বব্যাংকের সাহায্যের বিকল্প মালয়েশিয়ার সাহায্য নয়। এর বিকল্প হচ্ছে জাতীয় সক্ষমতা। সেটি হচ্ছে, আমাদের প্রকল্প আমরাই করব। সেই নীতিগত অবস্থান সরকারের নেই, এমনকি যেটুকু ছিল স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারেরও। যমুনা সেতুর জন্য এরশাদ আমলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সারচার্জ তোলা হয়েছিল। সেই অর্থের কতটুকু সদ্ব্যবহার হয়েছে, জানা নেই। তবে বৃহৎ প্রকল্পে এভাবে জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
এটি ধ্রুব সত্য যে, পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কাছে নতজানু হয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে না। আমাদের নিজস্ব নীতি ও পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। সরকার এমন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে তা যুক্তিগ্রাহ্য। তবে কোনো বিপ্লবীপনা সমর্থনযোগ্য নয়। আর আজকের বিশ্বব্যবস্থায় সরকারের নিজস্ব নীতি গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ পশ্চিমা মুরবি্বদের প্রেসক্রিপশন বহু দেশ অনুসরণ করে না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক দাতাদের সাহায্য অগ্রাহ্য করার যুক্তি নেই, আবার ক্ষতিকর শর্তে সাহায্য গ্রহণও যৌক্তিক নয়। কিন্তু এসব ব্যাপারে স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটির নেই। তাই মাঝে মধ্যে যে বিষোদ্গার তারা করেন তা স্বার্থের সংঘাত থেকেই সৃষ্ট।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি কী হবে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধই তা নির্ধারণ করেছে। সংবিধানে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সে অনুযায়ী সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাম্য প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্রকে জনগণের ভাত, কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় সহায়তা কমিয়ে নয়, বরং তা উত্তরোত্তর বাড়াতে হবে। এটিই জনগণের আকাঙ্ক্ষা, জনগণের কথা।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথায় ফিরে আসি, তিনি বলেছেন_ দেশ চলবে জনগণের কথায়। সরকার দেশের শোষিত-নিপীড়িত জনগণের প্রাণের দাবিকে সামনে রেখে যদি পদক্ষেপ নেয়, কেবল তখনই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথা আর কথার কথা থাকবে না। তা হয়ে উঠবে ১৪ কোটি মানুষের প্রাণের আকুতি।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.