সময়ের প্রতিধ্বনি-তার পরও আলোচনার কোনো বিকল্প নেই by মোস্তফা কামাল

বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা খোঁজা দরকার। এখানকার গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে, সংঘাত আর বিরোধপূর্ণ রাজনীতির ক্যারিক্যাচার! গণতন্ত্র মানে দলতন্ত্র ও ব্যক্তিতন্ত্র! নিজের ও দলীয় লোকদের স্বার্থ দেখভালই হচ্ছে এখানকার গণতন্ত্রের মূল কথা! সংসদ যেহেতু সব দলমতের প্ল্যাটফর্ম, সেহেতু ওখানে যাওয়া যাবে না।


আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলি তা কেবল বইপুস্তকে, পত্রিকার পাতায় কিংবা সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের আলোচনার টেবিলেই শোভা পায়। এই গণতন্ত্রের চর্চা থেকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো অনেক দূরে। প্রধান দুই দলের নেতা-কর্মীরা বলে থাকেন, নেত্রী যা বলবেন সেটাই গণতন্ত্র। জনগণের শাসনব্যবস্থা কায়েম করা আমাদের রাজনীতিকদের উদ্দেশ্য নয়। গণতন্ত্রে পরমতসহিষ্ণুতা ও সমঝোতার রাজনীতির রীতি-রেওয়াজও একেবারে পাল্টে গেছে।
আমরা সবাই জানি, গণতন্ত্রে নানা মত থাকবে; সেসব মত একীভূত করার ভেতরেই এর সৌন্দর্য নিহিত। এমন কোনো সমস্যা নেই, যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায় না। আর সংসদ হচ্ছে সব সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দু। এটা যত দিন নিশ্চিত করা না যাবে তত দিন গণতন্ত্র ব্যক্তিতন্ত্র আর দলতন্ত্রের মধ্যে ঘুরপাক খাবে। আলোচনা না করলে রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। সমঝোতার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যেন সেই পথেই হাঁটছেন। সরকার পক্ষ থেকে বারবার আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আলোচনায় বসতে রাজি নয়। সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের আস্থার সংকট মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে মোটেই বিশ্বাস করে না। সহ্যও করতে পারে না। সরকার যতই তাদের আলোচনায় ডাকছে তারা ততই যেন শক্ত হয়ে যাচ্ছে। বিএনপির ধারণা, আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেছে। সেই ফাঁদে তারা পা দিলেই বিএনপি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে!
সংসদে যাওয়ার ব্যাপারেও বিএনপির বড় আপত্তি! সংসদ অধিবেশনে যোগ দিলে কি বিএনপির মান-ইজ্জতের হানি হবে? হরতাল করলেই কি আন্দোলন সফল হবে? বিএনপি নেতারা হয়তো ভাবছেন, হরতাল করেই সরকারকে হটাতে সক্ষম হবেন। মানুষ বিরক্ত হয়ে সরকারের প্রতি অনাস্থা জানাবে। আগে এটা সম্ভব ছিল। এখন এই ধারণা ঠিক নয়। নতুন প্রজন্ম হরতালের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি মোটেই গ্রহণ করছে না। সাধারণ মানুষও এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা বলছে, আওয়ামী লীগ জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পেরে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। আর হরতাল করে বিএনপি জনপ্রিয়তা হারাবে। তা ছাড়া এত আগেভাগে হরতালের মতো কর্মসূচি দেওয়া ঠিক হয়নি। বরং হরতালের বিকল্প কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি মাঠে নামতে পারে। বিএনপির যেকোনো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির প্রতি সাধারণ মানুষেরও সমর্থন থাকবে। তবে তা অবশ্যই সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হতে হবে। খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি কিংবা পুত্রদ্বয়কে নিয়ে রাজনীতি করলে তাতে মানুষের সমর্থন থাকবে না। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিলেও বিএনপি সাধারণ মানুষের সমর্থন হারাবে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই বিএনপি নেতাদের আন্দোলনের ছক তৈরি করতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ করছি, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নিয়ে রাজনৈতিক খেলায় মেতে উঠেছে। বিএনপিও নানা ছুতায় রাজনীতির মাঠ গরমের চেষ্টা চালাচ্ছে। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে দেশের রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে। অন্য ইস্যু বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কর্মসংস্থান, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সমস্যা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। বিরোধী দল এসব ইস্যুতে সংসদে ও সংসদের বাইরে কথা বলতে পারে। তা না করে তারা আন্দোলন করছে কিভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ মসৃণ হবে সে ইস্যুতে। সরকারি দলও এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। সরকার একটি ইস্যুর মধ্যে বিএনপিকে আটকে রেখেছে। তা ছাড়া সরকারি দলের পক্ষ থেকে এ কথাও বলা হচ্ছে, বিএনপি জামায়াতের ফাঁদে পা দিয়েছে। জামায়াত বিএনপির কাঁধে সওয়ার হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় হরতাল পালন করছে। এ বিষয়ে বিএনপি নেতারা কী বলবেন?
এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে আলোচনা করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন। পরে তিনি বললেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর এ ব্যবস্থা বহাল রাখার কোনো সুযোগ নেই। বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে বিএনপিকে আলোচনায় বসতে হবে। এখনো তিনি বিএনপিকে আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু বিএনপির দিক থেকে বলা হচ্ছে, সরকারি দল যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চায় না, সেহেতু আলোচনা করে কোনো লাভ নেই। আন্দোলন করেই দাবি আদায় করতে হবে। সরকারি দল তাদের অবস্থান থেকে সরে গেলেও বিএনপির অবস্থানের কোনো নড়চড় হচ্ছে না। বিএনপির এই অনড় অবস্থান গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য ক্ষতিকারক। দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা বহাল রাখতে চাইলে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো জাতীয় ইস্যুতে সমঝোতায় পেঁৗছতেই হবে। এ জন্য আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।
হরতালের মতো নেতিবাচক কর্মসূচি দিয়ে কোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। বরং হরতাল মানুষের দুর্ভোগ বাড়ায়। হরতাল বিত্তবানদের অবকাশযাপনের সুযোগ করে দিলেও সাধারণ মানুষের জন্য এ এক কঠিন বোঝা। এই বোঝা বহন করার মতো শক্তি ও সামর্থ্য আমাদের নেই। বিএনপির প্রতি অনুরোধ, হতদরিদ্র বাংলাদেশের মানুষের ওপর দুর্ভোগের বোঝা আর চাপিয়ে দেবেন না।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কোনো রকম পিকেটিং ছাড়াই যেহেতু হরতাল হয়েছে সেহেতু মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হরতাল পালন করেছে। বিএনপি নেতার এই বক্তব্য কতটা সত্য তা কেবল ভুক্তভোগীরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে মানুষ এ প্রশ্নও করছে, তাহলে হরতালের আগের দিন এত গাড়ি পোড়ানো হলো কেন? মানুষ এ-ও বলছে, বিএনপি টানা ৩৬ ঘণ্টা হরতাল দিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভবিষ্যতে হরতাল দিলে ৪৮ কিংবা ৭২ ঘণ্টার হরতাল দিতে হবে। অর্থাৎ ৩৬ ঘণ্টার কম দিতে পারবে না। বিএনপি নেতারা অবশ্য বলছেন, প্রয়োজনে তাঁরা এক সপ্তাহ হরতাল দেবেন।
আমাদের এখনো মনে আছে, হরতাল না করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। উভয় দলের শীর্ষ নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া বেশ কয়েকবার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিরোধী দলে থাকলেও তাঁরা হরতালের মতো কর্মসূচি দেবেন না। অথচ সেই প্রতিশ্রুতি উভয় নেত্রীই বারবার ভঙ্গ করেছেন। ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাঁরা ঠিকই উপলব্ধি করেন, হরতাল নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচি। এ কর্মসূচির কারণে দেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। এক দিনের হরতালে কোটি কোটি টাকার অপচয় হয়। এর ধকল সামলানো ক্ষুদ্র অর্থনীতির এই দেশের পক্ষে সম্ভব নয়।
তবে এ কথাও ঠিক, হরতালকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার নামে সরকার পুলিশকে দিয়ে বিরোধী দলকে হেনস্তা করে থাকে। এটা আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় সরকারের আমলেই হয়েছে। উভয়েই নিজেদের স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করেছে। এখনো পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা আগেও লিখেছি, হরতাল ডাকে বিরোধী দল। আর হরতাল সফল করে পুলিশ। এবারও অনেকটা তাই হয়েছে। রাজপথে বিএনপি নেতা-কর্মীদের পুলিশ দাঁড়াতেই দেয়নি। যাঁরা গতকাল এনটিভির হরতালের খবর দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই পুলিশের কর্মকাণ্ড দেখে হতবাক হয়েছেন! তা ছাড়া এবার হরতালে বেশি চোখে পড়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বাড়াবাড়ি। আইনকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে সরকার ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের শাস্তি নিয়ে সাধারণ মানুষও প্রশ্ন তুলেছে। সংকটাপন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করার জন্যই হয়তো সরকারের ভেতরের অতি উৎসাহী মতলববাজ কিছু লোক এই কাজ করেছে বলেই ধারণা করছি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত ক্ষমতাসীনদের জন্য বুমেরাং হতে পারে।
মনে রাখতে হবে, আজকে যাঁরা ক্ষমতায় কাল তাঁরাই আবার বিরোধী দলে থাকতে পারেন। তাঁদেরও দাবি আদায়ের জন্য মাঠে নামতে হতে পারে। তখন এই পুলিশের হাতেই তাঁদের হেনস্তা হতে হবে। ক্ষমতা কারো জন্যই চিরস্থায়ী নয়। আজ যিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন পরে তাঁর জীবনের জন্য সেটা কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। কী সরকারি, কী বিরোধী উভয় পক্ষেরই এ কথাটা স্মরণে রাখা দরকার।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.