রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন-ইমারত নির্মাণ বিধিমালার কঠোর প্রয়োগ চাই

পাশে গভীর গর্ত খুঁড়ে বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ চলছিল। গত ১১ জুন সকালে বৃষ্টির সময় হঠাৎ করেই পাশের ছয় তলা ভবনের দেয়াল মাটিসহ গর্তের ভেতরে ধসে পড়ল। এই শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনাটি ঘটেছে অভিজাত এলাকা গুলশানে। গত মাসে নাখালপাড়ায়ও একইভাবে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়া বিশাল গর্ত খুঁড়ে নির্মাণকাজ চালানোর কারণে পাশের দুটি টিনশেড বাড়ি ধসে পড়েছিল। সেই সঙ্গে কয়েকটি ভবনে ফাটলও ধরেছিল।


গত বছর জুন মাসের প্রথম দিনে রাজধানীর বেগুনবাড়ীতে একটি সাত তলা ভবন কাটা গাছের মতো কাত হয়ে কয়েকটি টিনশেডের ওপর গিয়ে পড়েছিল। দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল ২৫ জন। একই মাসে শান্তিনগরে একটি ১৫ তলা ভবনে এবং নাখালপাড়ায় একটি চার তলা ভবনে ফাটল দেখা দেয়। এর তিন মাস পর অক্টোবরে দক্ষিণখানে একটি নির্মাণাধীন ভবন কাত হয়ে পড়ে। ঠিক তার পরের মাসেই কাঁঠালবাগান ঢালের পুকুরপাড় এলাকায় একটি সাত তলা ভবন কাত হয়ে পাশের একটি ১৬ তলা ভবনের গায়ে গিয়ে পড়ে। এ ধরনের ভবনধস, হেলে পড়া আর ফাটল ধরার ঘটনা রাজধানীতে আকসারই ঘটে চলেছে। একটি-দুটি নয়, ঘটেছে একের পর এক, অনেক। এর আগে ঘটে যাওয়া তেজগাঁও কিংবা সাভার ট্র্যাজেডির কথাও মানুষ ভুলে যায়নি। এ পর্যন্ত কয়েক শ মানুষ হতাহত হয়েছে এসব ভবনধসে। কোনো ঝড় নয়, ভূমিকম্প নয়, এমনি এমনি ধসে যাচ্ছে ভবনগুলো। কিন্তু কেন? জবাব একটাই। আর তা হলো, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বা নিয়মনীতি না মেনে যেনতেনভাবে ভবন নির্মাণ করা।
রাজধানীতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার বাস্তবায়ন তথা ভবন তৈরির নকশা অনুমোদন থেকে নির্মাণকাজ সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের। দুর্ঘটনাকবলিত ভবনগুলোর ক্ষেত্রে রাজউক যে সেই দায়িত্বটি পালন করেনি, তা এক রকম নিশ্চিতই।
রাজউক এ রকম আরো কত ভবন তৈরির ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব পালন করেনি, তার প্রকৃত হিসাব কে রাখে! তবে রাজউকেরই তথ্য মতে, রাজধানীতে এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। ১০ তলার অনুমোদন নিয়ে ১৫ তলা করা, অনুমোদিত নকশা না মেনে বাড়ি নির্মাণ, মাটি পরীক্ষা করে যথাযথ ফাউন্ডেশন না দেওয়া, মানসম্মত নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার না করাসহ অন্যান্য অনিয়ম তো আছেই। অবাক ব্যাপার, সেই ভবনগুলো এখনো ঝুঁকি নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে এবং তাতে মানুষ বসবাস করছে। এ পর্যন্ত অল্প কিছু বাড়ির মালিককে বাড়ি ভাঙার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশ কার্যকর হয়েছে আরো কম বা অতিনগণ্যসংখ্যক। যে বেগুনবাড়ীতে ২৫ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, কেবল সেখানেই আরো ৭২টি ভবন রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে।
স্বাভাবিক অবস্থায়ই যেখানে এত ভবনধসের ঘটনা ঘটছে, সেখানে উচ্চ-মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে_তা ভাবতে গা শিউরে ওঠে। কাজেই সমস্যাটিকে এখনই অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখতে এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কথা উঠলেই রাজউক বলে, তাদের জনবল কম। কিন্তু নিয়ম না মেনে তৈরি করা একেকটি বাড়ি থেকে রাজউকের কিছু অসৎ কর্মকর্তা কয়েক দফা ঘুষ নেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনও অভিযোগ আছে, অর্থের বিনিময়ে রাজউক থেকে ২০ বছর আগের অর্থাৎ বিধিমালা প্রণয়নের আগের তারিখে নকশা পাস করানো যায়। রাজউকের এসব অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। তাই ঝুঁকিপূর্ণ ও বিধিমালা-বহির্ভূত ভবনগুলো চিহ্নিত করতে প্রয়োজনে আউটসোর্সিং করা দরকার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের লোকজন নিয়ে সে কাজটি করা যেতে পারে। নকশা যে তারিখেই পাস করা হোক না কেন, বিধিমালা প্রণয়নের পর যেসব বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে, সেসব বাড়ির ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রয়োগ করা হবে। সেই সঙ্গে বাড়ির মালিকদেরই বাধ্য করতে হবে, সেগুলো যাতে ভেঙে ফেলা হয়। আমরা আর কোনো ভবনধসের মর্মান্তিক ঘটনা দেখতে চাই না।

No comments

Powered by Blogger.