কণ্ঠস্বর-উইকিলিকস ও বাংলাদেশের রাজনীতি by রাহাত খান

বাংলাদেশের রাজনীতি একটু বিচিত্র। রাজনৈতিক দল ও নেতানেত্রীরা তাদের ব্যর্থতা ও অপরাধ স্বীকার করতে চান না। কিন্তু অন্ধ হলেই তো প্রলয় বন্ধ হয় না। একটা মিথ্যাকে হাজারবার বলেও সত্যে পরিণত করা যায় না কিছুতেই। আমরা বলি, উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যগুলো ভিত্তিহীন বলে নিজেদের রাজনৈতিক কর্তব্য শেষ করলে সেটা হিতে বিপরীত


হয়ে দেখা দেওয়া বিচিত্র নয়। রাজনীতিতে যারা ক্ষমতায় আছেন এবং যারা ক্ষমতায় নেই, তাদের উভয় দলের উচিত আত্মসংশোধনে ব্রতী হওয়া


উইকিলিকসের ফাঁস করা খবর যার বা যাদের বিরুদ্ধে যায়, তিনি বা তারা এর প্রতিবাদ জানান। খবরটাকে ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূলক বলে তারা অভিহিত করেন তীব্র ভাষায়।
আর উইকিলিকসের কোনো তথ্য যদি কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের পক্ষে যায়? তাহলে ভারি খুশি হন তিনি বা তার দল। এমন মজা (খবর) হয় না, গায়ে সোনার গয়না ধরনের অভিব্যক্তি তাদের মধ্যে। উইকিলিকসের এ ধরনের স্বপক্ষীয় তথ্য বা খবরকে তারা কাজে লাগান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বিপক্ষে।
তবে মুশকিল হলো, উইকিলিকস কখন যে কার বা কাদের বিপক্ষে গোপন বার্তা ফাঁস করবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই সংস্থাটি যেন অন্ধ। আর বিষয়-আশয়ের বিবেচনায় একটু 'বোকা'। ফাঁস করা তথ্য বা খবরের জন্য উইকিলিকস নাকি কোনো রাষ্ট্র, গোষ্ঠী, সংবাদপত্র কিংবা সংবাদ এজেন্সির কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেয় না। বিষদুষ্ট রাজনীতি এবং অঙ্কের ব্যবসাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে বিনাপয়সায় তথ্য ফাঁস করা এই প্রতিষ্ঠানটিকে অবৈষয়িক এবং নির্বোধ ছাড়া আর কী বলা যায়?
উইকিলিকস সত্যের সাধক নাকি বিশ্বে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির কোনো নেপথ্য শয়তান, তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। হয়তো তা জানাতে পারব অ্যাসাঞ্জের বিচারের পরপরই। অথবা হয়তো সত্য উদ্ঘাটিত হবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আদালতের রায় পরোয়া না করে আরও কয়েক বছরের মধ্যে।
প্রতিটি মানুষের যে কোনো তথ্য জানার অধিকার যে তার জন্মগত, একদিন অ্যাসাঞ্জ হয়তো হবেন সেই সংগ্রামের যুগ প্রবর্তনকারী পুরুষ। যারা দুনিয়া পাল্টে দিয়েছেন, ইতিহাসের সেই মহানায়কদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন হয়তো অ্যাসাঞ্জ। বিপরীত কিছু হওয়াও বিচিত্র নয়। হয়তো দেখা যাবে, গোপন সত্য-অসত্য তথ্য ফাঁস করে দিয়ে আগামী বিশ বা পঁচিশ বছরের মধ্যে বিশ্বে একটা ভয়াবহ অস্থিতিশীল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির এবং সেই পরিস্থিতি থেকে গোপন কোনো এক শক্তির ফায়দা লোটার যে ষড়যন্ত্রের অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, অ্যাসাঞ্জ হচ্ছেন সেই ষড়যন্ত্রেরই এক খেলোয়াড়। অ্যাসাঞ্জ যে সত্যেরই সাধক কিংবা তিনি যে দূরবর্তী কোনো মেগা-ষড়যন্ত্রের প্রথম দৃশ্যমান খেলোয়াড়_ এর কোনোটাই এখনও সঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে কৌতূহলী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় একটি বিষয়ে অতি সহজেই। অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস এ পর্যন্ত কয়েক লাখ গোপন নথি উদ্ধার করতে পেরেছে। এসব নথির ৯৯.৯ ভাগই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা সংক্রান্ত। চীন ও রাশিয়ার কি গোপন নথি নেই, যা ফাঁস করে দিলে মানুষের উপকার হয়? থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে? না, উইকিলিকস আজ পর্যন্ত তেমন কোনো তথ্য ফাঁস করেনি।
উইকিলিকসের চীন ও রাশিয়া এবং আরও দু'একটি রাষ্ট্র সম্পর্কে নিশ্চুপতা সাধারণ মানুষকে একটু বিস্মিত করে বৈকি! এক হতে পারে, চীনের বা রাশিয়ার গোপন নথিপত্র হাতানোর ব্যাপারে উইকিলিকস এখনও কৃতকার্য হতে পারেনি। হয়তো এতদূর পেঁৗছাতে পারেনি তাদের নেটওয়ার্ক। আর এক হতে পারে, তথ্য ফাঁস করার তালিকা থেকে সুকৌশলে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। এই ধারণার কোনটা যে সত্যি, তা বলা কঠিন।
তবে উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাসাঞ্জের প্রাথমিক ঘোষণাটি খুবই চিত্তাকর্ষক। শতকরা একশ' ভাগ সত্য বলে অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করি। প্রাথমিক ঘোষণায় অ্যাসাঞ্জ বলেছেন : বিশ্বের তাবৎ প্রতিষ্ঠান কিছু না কিছু গোপনীয়তার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তার মতে, গোপনীয়তা মানেই মানুষকে সত্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। অ্যাসাঞ্জ বোধহয় এও বলতে চান, সব রকম গোপনীয়তা ফাঁস হলে সেখান থেকে যোগ-বিয়োগ করে যে খবরটি নির্ণীত হয়, সেটিই মানুষের জন্য কল্যাণকর ও সত্য।
অ্যাসাঞ্জ সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। বর্তমানে 'মারাত্মক' ও 'বিপজ্জনক' কিছু তথ্য ফাঁসের জন্য তিনি ব্রিটেনে গৃহবন্দি। সুইডেনে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে মানবাধিকার রক্ষার আইন অত্যন্ত শক্তিশালী বলে। সুইডেনের হাইকোর্ট অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার রায় দিয়ে দিয়েছেন। সেটা গেছে অ্যাসাঞ্জের বিপক্ষে। তবে অ্যাসাঞ্জ সুপ্রিম কোর্টে যেতে চান শেষ আইনি লড়াইয়ের ফলাফল দেখতে।
বিচারে অ্যাসাঞ্জ নিরপরাধ না দোষী সাব্যস্ত হবেন সেটা দেখা সময়ের ব্যাপার। তবে একটা ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত যে, নানা দেশের নানা গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে বিশ্বের তথ্য ও সংবাদের জগৎকে একটা প্রবল ধাক্কা দিতে সমর্থ হয়েছেন অ্যাসাঞ্জ। সংবাদমাধ্যমকে খানিকটা নতুন অধিকার ও শক্তি জুগিয়েছেন। গোপন তথ্য চালাচালির চিরাচরিত কূটনৈতিক প্রক্রিয়াকে দাঁড় করানো হয়েছে একটা প্রশ্নের ওপর। এও বলা যায়, চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে কূটনীতির এই গোপনে তথ্য চালাচালিকে।
অথচ যে ব্যক্তিটি সংবাদ ও তথ্যের জগতে বিশাল আলোড়নটি ঘটিয়েছেন সেই অ্যাসাঞ্জ কিন্তু সত্যের কথিত সাধক হয়েও বিচরণ করেন এক রহস্যময় জগতে। বিশ্বের নানা দেশের বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করেন তার পরিচিত, প্রায় অপরিচিত বান্ধবীরা। বয়স চলি্লশ পেরিয়েছে। এরই মধ্যে মাথার বেশিরভাগ চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে। আবার দেখতে ভারি সুদর্শন। সুগঠিত মজবুত শরীর-স্বাস্থ্য। যেন রহস্যময় তথ্য ফাঁসের জগতে এক পারঙ্গম জেমস বন্ড।
উইকিলিকস সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতিক এবং নতুন অস্ত্র নির্মাণের গোপনীয়তাকে। উইকিলিকসের উদ্দেশ্য থাকুক না থাকুক এতে লাভবান হবে আমেরিকাসহ পশ্চিমা শক্তি বলয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিপক্ষ দেশ ও গ্রুপগুলো।
বাংলাদেশে উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য যে ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক এই বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একমত পোষণ করে। এমনিতে তারা নিজেদের গণতান্ত্রিক দল বলে জাহির করে। তবে সত্য বয়ান হলো, তারা এমনকি কোনো জাতীয় ইস্যুতেও আলোচনায় বসে না। যে যখন বিরোধী দলে থাকে, পার্লামেন্টে যায় না। বিরোধী দলে থাকার সময় তবু আওয়ামী লীগ মাঝে মধ্যে পার্লামেন্টে গেছে। বিরোধী দলে থাকার সময় ্বিএনপিও পার্লামেন্টে যায়, তবু সেটা যায় পার্লামেন্টের সিট রক্ষা এবং সাংসদদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধাগুলো অক্ষুণ্ন রাখতে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১১_ এ বিশ বছরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজনীতির কোনো বিষয়ে একমত হতে পারেনি। এমনকি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুই দলের কিংবা দুই দলের দুই নেত্রীর কখনও একসঙ্গে বসে আলোচনা করার রেকর্ড নেই। দুই নেত্রী বাংলাদেশে গণতন্ত্র বজায় রেখেছেন শুধু দুই ঈদ ও পহেলা বৈশাখে একে অপরকে শুভেচ্ছা ও প্রীতি জানানোর মধ্যে। বলতে হয়, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!
বাংলাদেশের বেলায় উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য দুই নেত্রীর এই সম্পর্কের বিষয়টি তো নানাভাবেই এসেছে। এ ছাড়া এসেছে মার্কিন কূটনীতিকদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, জঙ্গি উত্থান ইত্যাদি বিষয়েও নানা তথ্য। বাংলাদেশের জনগণ অবশ্য এসব বিষয়ে সবই জানে। তবে বলতেই হয়, এসব জানা কথাকে একটা সত্যের ভিত্তি দিয়েছে উইকিলিকস। আন্তর্জাতিক বিশ্বে উইকিলিকসের ভূমিকা যা-ই হোক।
উইকিলিকস 'নায়ক' না 'ভিলেন', সত্যের সাধক নাকি ষড়যন্ত্রকারী শয়তান_ সেই বিতর্কে এ মুহূর্তে যেতে চাই না আমরা। শুধু বলব, বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে উইকিলিকসের বরাতে যা যা বলা হয়েছে সবই সত্য। ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, গুপ্তহত্যা, জঙ্গিবাদের উত্থান_ সবই সঠিক কিছু জ্ঞানপাপী এ নিয়ে তর্ক করতে পারে। তবে দেশের যারা সচেতন নাগরিক, তারা উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া প্রতিটি তথ্যই সঠিক বলে মনে করে।
এই যেমন মার্কিন সূত্র থেকে বলা এবং উইকিলিকসের ফাঁস করা পদ্মা ব্রিজ নিয়ে জনৈক মন্ত্রীর দুর্নীতির ব্যাপারে দেওয়া তথ্যটি। যেমন বর্তমান সরকারের একজন সিনিয়র উপদেষ্টার দুর্নীতিতে লিপ্ত থাকা। যেমন ১/১১-এর আমলে দুই অপরাধী পুত্রের মুক্তির বিনিময়ে জনৈক প্রধান নেত্রীর দেশ ও রাজনীতি ত্যাগে রাজি হওয়া। মার্কিন সূত্রেই বলা যে, খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুল হচ্ছে নিজের কুখ্যাত পুত্রকে দলের পরবর্তী নেতা নির্বাচন করা। খালেদা জিয়ার দুই পুত্রই যে দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড ইত্যাকার অপরাধের সঙ্গে যুক্ত, তা ফাঁস করে দেওয়া সত্যেরই নামান্তর।
আবার বলি, উইকিলিকস নায়ক না ভিলেন, তা সময়েই যথারীতি প্রমাণিত হবে। তবে বাংলাদেশের রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, দুর্নীতি, জঙ্গি উত্থানে সর্বাত্মক সহযোগিতা জোগানো ইত্যাদি বিষয়ে উইকিলিকস যা যা এ যাবৎ ফাঁস করেছে সেগুলো ভিত্তিহীন তো নয়ই, বরং বর্ণে বর্ণে সত্য।
বাংলাদেশের রাজনীতি একটু বিচিত্র। রাজনৈতিক দল ও নেতানেত্রীরা তাদের ব্যর্থতা ও অপরাধ স্বীকার করতে চান না। কিন্তু অন্ধ হলেই তো প্রলয় বন্ধ হয় না। একটা মিথ্যাকে হাজারবার বলেও সত্যে পরিণত করা যায় না কিছুতেই। আমরা বলি, উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যগুলো ভিত্তিহীন বলে নিজেদের রাজনৈতিক কর্তব্য শেষ করলে সেটা হিতে বিপরীত হয়ে দেখা দেওয়া বিচিত্র নয়। রাজনীতিতে যারা ক্ষমতায় আছেন এবং যারা ক্ষমতায় নেই, তাদের উভয় দলের উচিত আত্মসংশোধনে ব্রতী হওয়া। জেদ করার ফল রাজনীতিতে অনেক সময় ভয়ঙ্কর পরিণতির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।

রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.