একান্ত সাক্ষাতকারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল by আব্দুল মুহিত

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ৬ জানুয়ারি সরকারের সঙ্গে সঙ্গে অর্থমন্ত্রী হিসাবে তাঁরও এক বছর মেয়াদ পূর্ণ করেছেন। দেশের এই কৃতী সনত্মান, প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও লেখকের জন্ম ১৯৩৪ সালে।
এক সময়কার অভিজ্ঞ আমলা এবং এদেশের পরিবেশ আন্দোলনের পুরোধা এখন মহাজোট সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসাবে নতুন জীবনের স্বাদ গ্রহণ করছেন। ইতোপূর্বে ১৯৮২-৮৩ সালে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেও একটি গণতান্ত্রিক সরকারের মন্ত্রিসভায় নীতিনির্ধারক হিসাবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন এবং ভিন্নতর। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই গত ২৫ জানুয়ারি তাঁর ৭৬তম জন্মবার্ষিকী অতিক্রম করলেন। সেই জন্মদিনেই দৈনিক জনকণ্ঠ মুখোমুখি হয় বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের। প্রায় দুই ঘণ্টার সাাতকারে তিনি তাঁর এই নতুন জীবনের অভিজ্ঞতা, সরকারের এক বছরের কর্মকা-ের মূল্যায়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে বাধাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। তাঁর সেই ব্যতিক্রমধর্মী সাাতকার গ্রহণ করেছেন দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়, বিশেষ প্রতিনিধি কাওসার রহমান এবং স্টাফ রিপোর্টার মিজান চৌধুরী। ছবি তুলেছেন আমাদের আলোকচিত্রী শেখ মামুন। নিচে অর্থমন্ত্রীর সাাতকারের পুরো বিবরণ দেয়া হলো-
স্বদেশ রায় : আজ আপনার জন্মদিন। আপনার জন্মদিনে মহাজোট সরকারেরও এক বছর পূর্ণ হয়েছে। জন্মদিনে বছরটি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
এএমএ মুহিত : ২০০৯ সাল ছিল আমার জন্য নতুন জীবন। আমি তো সরকার ছেড়েছি বহুদিন আগে। আমি সরকার ছেড়েছি ১৯৮৪ সালে। চুরাশি থেকে দুই হাজার আট পর্যনত্ম আমি সরকারের কোন কাজ কোন দিন করিনি। আমি আনত্মর্জাতিক কনসালটেন্সি করতাম। মাত্র ২টি কনসালটেন্সি দেশে করেছি আমার এই অবসর জীবনে। এর পর এভাবে সরকারের একটি গুরম্নদায়িত্ব পাওয়া ছিল অসাধারণ ব্যাপার। অসাধারণ সুযোগও বটে। আমি তখনই ঠিক করেছি, ভাগ্যে এমন সুযোগটা যখন পেয়েছি তার আমি সদ্ব্যবহার করবই। গত এক বছরে সেই সুযোগই কাজে লাগিয়েছি।
স্বদেশ রায় : কোন্ কোন্ েেত্র আপনি এই সুযোগটা বেশি কাজে লাগিয়েছেন?
এএমএ মুহিত : আমার দায়িত্ব ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের। এটার সঙ্গে আমার কিছুটা পরিচয় ছিল। কিন্তু যে অর্থনীতিটাকে আমি চিনতাম আগে, এটা এই বর্তমান অর্থনীতি নয়। তখন সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বাজেট ছিল। এসে দেখলাম এক লাখ কোটি টাকার বাজেট। তখন ব্যক্তিমালিকানা খাত বলতে কিছুই ছিল না। এখন ব্যক্তিমালিকানা খাত অত্যনত্ম গতিশীল এবং শক্তিশালী। ব্যক্তিমালিকানা খাতের সূচনা হয় বস্তুত ১৯৮২ সালে। আমি যখন সরকার ছাড়ি তখন ব্যক্তিমালিকানা খাতে ব্যাংক হয়েছে কিছু। সরকার ছাড়ার আগে মাত্র ২০ শতাংশ ব্যবসা তাদের হাতে ছিল। এখন ৬০ শতাংশ তাদের হাতে। যদিও বড় বড় ব্যাংক এখনও সরকারের হাতে। এখন সিদ্ধানত্ম গ্রহণের সংস্কৃতিও বদলে গেছে। এখন 'স্টেকহোল্ডার' অনেক বেশি। ব্যবসায়ী সমিতি, এ্যাসোসিয়েশন এত বেশি যে, বাজেট দেয়া পর্যনত্ম ছয় মাস সময় ছিল আমার জন্য তাদের সঙ্গে পরিচিতির পর্ব। ঐ সময়টি ছিল আমার জন্য প্র্রশিণের। আমি তখন অনেক শিখেছি। বাজেট দেয়ার পর এবং বাজেটটা যখন চূড়ানত্মভাবে তৈরি করছি তখন মনে হয়েছে, আমি এখন অর্থনীতিটাকে বুঝতে পারছি।
কাওসার রহমান : আপনি একাধিক দায়িত্ব পালনের কথা বলছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাইরে আপনি আর কোন্ কোন্ দায়িত্ব পালন করছেন?
এএমএ মুহিত : অর্থ মন্ত্রণালয় ছাড়াও বিভিন্ন কাজের সঙ্গে আমাকে সম্পৃক্ত থাকতে হচ্ছে। সেটা অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিলেন ঠিকই, সেই সঙ্গে অন্যান্য বিষয়ও ঢুকিয়ে দিলেন। এই মুহূর্তে আমি সাউথ এশিয়া গেমস নিয়ে ব্যসত্ম। এটাও ওনার জন্যই হয়েছে। আমি খেলাধুলার অঙ্গনে ছিলাম, সেটা সত্তরের দশকে শেষ হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চাশ ও ষাট দশক ছিল আমার খেলাধুলার যুগ। সেটা প্রধানমন্ত্রী বোধ হয় জানতেন। সেজন্য খেলাধুলার মধ্যেও আমাকে লাগিয়ে দিয়েছেন। আমি পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। আমার আইটিতে আগ্রহ তাঁর জানা। সেগুলোর সঙ্গেও আমাকে যুক্ত করলেন। এই সব মিলিয়ে আমার কাজের চাপ খুব বেশি। এটার কারণে বোধ হয় শারীরিক অসুবিধা হচ্ছে। আমি আগে রম্নটিন মেনে স্বাস্থ্যসেবার চেষ্টা করতাম। সাঁতার কাটতাম। ব্যায়াম করতাম। এটা করতাম, সেটা করতাম। এগুলো এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ওজন বেড়ে গেছে। ওজন বাড়লে কর্মশক্তি কমে যায়, মনে হয় বয়স বেড়ে গিয়েছে । আর একটি সমস্যা হচ্ছে আমার বাসস্থান। আমি যেখানে থাকি সেটি অফিসপাড়া থেকে অনেক দূরে। বাড়ি একটা বরাদ্দ হয়ে রয়েছে। কিন্তু যেতে পারছি না, সময় দিতে পারছি না। আশা করছি এ মাসে চলে যাব। জীবনে একটা শৃঙ্খলার অভাব পরিলৰিত হচ্ছে। সব কাজ শৃঙ্খলার মধ্যে আনলে মনে হয় চাপ নিয়ন্ত্রণে আসবে; সব ঠিক হয়ে যাবে।
কাওসার রহমান : এই দায়িত্বগুলো আপনি কেমন উপভোগ করছেন?
এএমএ মুহিত : চাপের মধ্যে থাকলেও আমি আমার কাজগুলো খুব উপভোগ করছি। গত এক বছরে আমরা অনেক সিদ্ধানত্ম নিয়েছি। সৌভাগ্যবশত সিদ্ধানত্মগুলো কাজ করেছে। প্রতিটি েেত্রই কাজ হয়েছে। যেখানে অসুবিধা হয়েছে সেখানে সিদ্ধানত্ম পরিবর্তন করেছি। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে সময় নির্ধারণ। আমরা ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে নিয়ে এসে সেটা অব্যাহত রাখছিলাম। কিনত্মু দেখলাম মানুষ সেটা পছন্দ করছে না। ফলে আমরা সময় পরিবর্তন করলাম। এতে আমাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হলো, যে কোন কাজে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকলে সেই জিনিস ভাল হয়। মানুষকে আস্থায় নিলে, আলোচনা করলে পদপেটা ভাল হয়। এর আর একটা উদাহরণ হলো- কালো টাকা। কালো টাকার ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধানত্মের প্রতিক্রিয়া হলো বাজারে। আমরা সেটা গ্রহণ করলাম। সিদ্ধানত্ম নিয়েছিলাম, তিন বছরের জন্য সুযোগ দেব। সেটা পরিবর্তন করে এক বছরের জন্য করেছি। পদপেটি সঠিকই হয়েছে এবং সঠিক হওয়ার কারণ ওই আলোচনা। আমরা ভবিষ্যতের সিদ্ধানত্মগুলো সুবিধাভোগীদের ও জনগণের সঙ্গে আলোচনা করেই গ্রহণ করব। আগামী দিনের বাজেট প্রণয়নের জন্য আমরা এই আলোচনা অব্যাহত রাখব। এখন অভিজ্ঞতা হয়েছে। আশা করছি আগামী বাজেট দ্রম্নত গতিতে করা সম্ভব হবে।
আমাদের সফলতার পেছনে আর একটি কারণ হচ্ছে আলস্নাহর মেহেরবানি। আবহাওয়া আমাদের সাহায্য করেছে। খরা একটি সমস্যা ছিল। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সেটা দৰতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন। পরিবেশ যে অনেকটা সহায়ক ছিল তাও স্বীকার করতে হবে। বছর শেষে ভাল লাগছে। আমাদের পদপেগুলো সঠিক হয়েছে। প্রত্যেক েেত্র যথেষ্ট সাফল্য লাভ হয়েছে।
মিজান চৌধুরী : এবারের বাজেট উচ্চাভিলাষী বলে অভিযোগ ছিল। সেটা বাসত্মবায়নের অগ্রগতি কতটুকু?
এএমএ মুহিত : উচ্চাভিলাষী বাজেট নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। রাজস্ব আদায় নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। আমি বলতে পারি, রাজস্ব আদায়ের যে ল্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জিত হবেই। আমার ধারণা যতটা টার্গেট আছে তার চেয়ে বেশি আদায় হতে পারে ।
স্বদেশ রায় : গ্রামে এখন অনেক সম্পদ প্রবাহ আছে। আপনারা কি গ্রাম থেকে রাজস্ব আহরণের খাত বাড়াবেন?
এএমএ মুহিত : না, রাজস্ব আহরণের খাত বাড়াব না। রাজস্ব আহরণের সূত্রগুলো অভিন্ন থাকবে। এগুলোকে বিসত্মৃত করতে হবে। বলতে গেলে গ্রামে কোন আয়কর নেই। গ্রাম পর্যায়কে আয়করের আওতায় আনতে হবে। কী কৌশলে আনা হবে সেটা হলো কৌশলের ব্যাপার। কৃষিকর চালু করা যায় কিনা ভেবে দেখতে হবে। আমার মনে হয়, স্থানীয় সরকার ভবিষ্যতে বড় একটি বিষয় হবে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে পারলে রাজস্ব আদায়ও বেশি হবে। আমাদের দেশে 'খানা ট্যাক্স' যাচ্ছেতাই। মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স আশঙ্কাজনকভাবে কম। পাঁচ হাজার বর্গফুটের বাড়ি যার ঢাকায় আছে, তিনি কত ট্যাক্স দেন? মফস্বলে আরও খারাপ। আমার সিলেটে অবস্থা আরও খারাপ। ১৫-২০ বছর ধরে ট্যাক্স বাড়ানো হয় না। এগুলো বাড়ানো যাবে। স্থানীয় সরকার যদি শক্তিশালী হয়। জনগণ যদি স্থানীয় সরকারের কাজকর্মগুলো সরাসরি দেখতে পারে ও তার উপকার পেতে পারে, তখন কর দিতে তত অনীহা দেখাবে না। যদি বুঝতে পারে তার সনত্মানের শিা হচ্ছে জেলা বা উপজেলার খরচে, তখন জনগণ কর দিতে আগ্রহী হবে। শিার সমসত্ম ব্যবস্থা এখন ঢাকা থেকে হয়। সকল সিদ্ধানত্ম ঢাকা থেকে দেয়া হয়। এটা যদি স্থানীয় সরকারের কাছে চলে যায় তাহলে শিা ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আসবে। শিক নিয়োগ, স্বাস্থ্য কৃষি সব কার্যক্রমই উপজেলায় নিতে হবে। আমি মনে করে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের হাতে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া যায়। রম্নলস রেগুলেশন মনিটরিং ঢাকা থেকে করা হবে। স্থানীয় সরকার শুধু ভ্যাট আদায় করবে। এভাবে সেবার সকল দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া যায়।
স্বদেশ রায় : আপনার সরকার কি স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করবে? বিশেষ করে এমপিরা কি তা মেনে নেবেন?
এএমএ মুহিত : উপজেলাকে নিয়ে 'পলিটিক্স' করতে চাচ্ছেন অনেকে। তাঁদের অভিযোগ হলো এমপি সাহেবরা পরামর্শক হয়ে বসে আছেন এবং ওনাদের পরামর্শ শুনতেই হবে। এটাতেই আপত্তি। আমার মনে হয়, উপজেলা চেয়ারম্যানদের আপত্তি থাকত না, এমপি সাহেবরা যদি পরামর্শকই থাকতেন। পরামর্শকের কথা শতভাগ শুনতে হবে সেটাতেই তাঁদের যত আপত্তি। এটা একটা সংঘাতের ব্যাপার। সময় লাগবে তবে। একটা সমঝোতায় আসতে হবে এমপি সাহেবদের। তাঁরা তো আর সব কিছু করতে পারবেন না। আমি তো নিজে দেখছি। আমার সৌভাগ্য যে আমার মেয়র এবং উপজেলা চেয়ারম্যানরা সকলেই আমার দলের। আমি তাদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় কাজের বিষয়ে প্রায় নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছি। এলাকার প্রতিনিধি আমার দলের না হলেও তাঁর সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে হতো যে, কিভাবে কী করা যায়। এটা সময়ে ঠিক হয়ে যাবে। ওই যে ১১টি দায়িত্ব আছে উপজেলা সরকারের; সেটা তাদের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি। এটা তাঁদের হাতে গেলে তাঁদের মতা অনেক বাড়বে। তাঁরা অনেক কিছু করতে পারবেন। তখন ওই পরামর্শক সমস্যাটাও ঠিক হয়ে যাবে। যদি আগামী বছরের মধ্যে তা নাও হয়, আমাদের মেয়াদ শেষের আগেই এটা ঠিক হয়ে যাবে। এমপিরাও সংযত ও সহনশীল হচ্ছেন এখন। আমাদের নেত্রী বলেছেন যে, জেলায় শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠন করতে হবে।
কাওসার রহমান : বৈশ্বিক মন্দা কেটে যাচ্ছে। বিনিয়োগ এবং আমদানি-রফতানি খাত ছাড়া অর্থনীতির সব সূচকই উর্ধমুখী। আসলে অর্থনীতি এখন কোন্ অবস্থায় আছে?
এএমএ মুহিত : বিশ্বমন্দা চলে যাচ্ছে। আবারও মন্দা আসতে পারে, সেটা ভিন্ন কথা। এই মুহূর্তে মন্দা কেটে যাওয়ায় বিশ্বে শিল্প পণ্যের চাহিদা বাড়ছে, যেটাতে আমাদের বেশি আগ্রহ আছে। কারণ এতে আমাদের আয় বাড়বে। আমাদের প্রধান শিল্প হচ্ছে গার্মেন্টস। প্রধান রফতানি পণ্যও হচ্ছে তৈরি পোশাক। গার্মেন্টস শিল্প ২০০৭ ও ২০০৮ সালে অনেক সম্প্রসারণ করেছে। আমার মনে হয়, নিট ও ওভেন পোশাকের যে সম্প্রসারণ হয়েছে তা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। আমি মনে করি, আমরা এটা ক্যাশ এখন করতে পারব। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, এ বছর আমাদের প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের বেশি হবে। রফতানি খাতে আমাদের প্রবৃদ্ধি কমেছে। আশা করছি আগামী পাঁচ মাসে শিল্পের অলস মতা ব্যবহার করে আমাদের সরবরাহ বাড়াতে পারব। এই মন্দার মাঝেও আমাদের নিট পোশাকের মার্কেট শেয়ার বেড়েছে। এর সুবিধা আমরা পাব। অন্যান্য পণ্য খাতেও লোকসান কমে যাবে। বাড়বে প্রবৃদ্ধি।
জনশক্তি রফতানির েেত্র আমরা খুব একটা লোকসান করিনি। ২০০৬ সালে আড়াই লাখ লোক বিদেশে গেছে। ২০০৭ সালে পাঁচ লাখ এবং ২০০৮ সালে আট লাখ লোক বিদেশে গেছে। ২০০৬ সাল ছিল আমাদের আদর্শ বছর। তার সঙ্গে তুলনা করলে ২০০৯ সালে আমাদের জনশক্তি রফতানির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। এবছর প্রায় সাড়ে তিন লাখের মতো শ্রমিক বিদেশে গেছে। বিশ্বমন্দায় আমরা যে ধাক্কা খেলাম, তার জন্য নতুন শ্রম বাজার সৃষ্টির চেষ্টা করছি। কিছু কিছু পাচ্ছিও। গ্রীস, সাইপ্রাস, ইরাক, পূর্ব ইউরোপ প্রভৃতি দেশে শ্রমিক যাচ্ছে। ইরাক যদিও ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমাদের ছেলেরা ঝুঁকি নিতে পছন্দ করে। ফলে চলতি বছরও আমাদের জনশক্তি রফতানি বাড়বে।
কাওসার রহমান : বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও রেমিটেন্স প্রবাহে একটা চাঙ্গাভাব দেখা যাচ্ছে। এ ধারাকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে আপনার প্রস্তুতি কতটুকু?
এএমএ মুহিত : রেমিটেন্স বাড়ানোর জন্য আমরা ডেলিভারি ব্যবস্থাকে সহজ করেছি। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এখন রেমিটেন্স পাঠানো হচ্ছে। রেমিটেন্স প্রেরণের জন্য প্রযুক্তির বিকাশ হয়েছে। এতে প্রকৃত অর্থে হুন্ডি ব্যবসা কমেছে, কমেছে অবৈধভাবে টাকা পাঠানোর প্রবণতা। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ সঠিক পথে আসায় রেমিটেন্স বেড়েছে। এ ধারাকে আমরা অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন দেশে এক্সচেঞ্জ হাউজ বা রেমিটেন্স প্রেরণ বুথ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। যাতে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা নিজ নিজ এলাকা থেকেই দেশে দ্রম্নত সহজে অর্থ প্রেরণ করতে পারে। আবার বৈধপথে রেমিটেন্স প্রেরণকে উৎসাহিত করার জন্য দ্রম্নত তার পরিবারের কাছে অর্থ পেঁৗছে দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি।
কাওসার রহমান : কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগ খুবই জরম্নরী। বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য আপনারা কি কি পদপে নিচ্ছেন?
এএমএ মুহিত : আমাদের প্রধান ল্য হচ্ছে শিল্প খাতের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এ জন্য পণ্য উৎপাদন বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। সাবকনট্রাক্টিংয়ের মাধ্যমে উন্ন্নত গ্রামে নানা প্রসেসিং প্রক্রিয়া স্থাপন করতে হবে । শুধু তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। খেলনা, ফার্নিচারের মতো সম্ভাবনাময় শিল্প স্থাপন করতে হবে। আমাদের উদ্যোক্তারা কঠোর পরিশ্রমী। তাদের খেলনা ও ফার্নিচার শিল্প স্থাপনে উৎসাহিত করতে বন্ডেড সুবিধার মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানির ব্যবস্থা করা হবে। আমাদের সুবিধা হচ্ছে- এখানে শ্রমমূল্য খুব কম। খেলনা, ফার্নিচার ছাড়াও পস্নাস্টিক ও ওষুধ শিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপির) মাধ্যমে এসব করা যাবে। দেশে আখ থেকে চিনি উৎপাদন বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না। কিন্তু 'র' সুগার এনে রিফাইন করে ফিনিশড চিনি করা হচ্ছে। অপরিশোধিত ভোজ্যতেল এনে রিফাইনারিতে তাকে শোধন করা হচ্ছে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের জন্য আমাদের 'ওয়েজ এমপস্নয়মেন্টে' যেতে হবে।
মিজান চৌধুরী : শিল্পায়নের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন খুবই জরম্নরী। কিন্তু সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর বাসত্মবায়ন আশানুরূপ নয়। এই চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবেলা করবেন?
এএমএ মুহিত : যেভাবেই হোক প্রবৃদ্ধির জন্য রাজস্ব বাজেট ও উন্নয়ন বাজেট বাসত্মবায়নে দৰতা বাড়াতে হবে। আমি মনে করি আমাদের মেয়াদে সরকারী ব্যয় জিডিপির ২০ শতাংশ হওয়া উচিত। বর্তমান এটা ১৬ শতাংশ। এই ব্যয় বৃদ্ধি করা অত্যনত্ম জরম্নরী। শিায় হচ্ছে পাবলিক খরচ, স্বাস্থ্য পাবলিক খরচের এলাকার মধ্যে পড়বে। এসব খাতে খরচ বাড়াতে হবে। আরও নতুন কিছু যোগ করা হবে। তবে রাজস্ব আদায়ও বাড়াতে হবে। আমার এক বছরের অভিজ্ঞতায় রাজস্ব আদায়ের হার ভাল। তবে আমাদের পরিসংখ্যান অত্যনত্ম ভুল। পরিসংখ্যানে গরমিলের কারণে সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এটা রাতারাতি ঠিক করা যাবে না। তাই পরিসংখ্যান বু্যরোকে শক্তিশালী করার চেষ্টা চলছে।
কাওসার রহমান : বিনিয়োগে এক ধরনের খরা চলছে। অথচ ব্যাংকগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ তারল্য মজুদ রয়েছে। তাহলে কেন বিনিয়োগের সমস্যা হচ্ছে?
এএমএ মুহিত : আমরা যখন মতায় আসি তখন একটি ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছিল। ভয় ছিল যে, বিনিয়োগ করলে সমস্যা হবে। এই ভীতিটা দুর্ভাগ্যবশত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সৃষ্টি করে। 'সৈনিকদের রাজনীতিতে আসা উচিত নয়' বলে জেনারেল মইন উ আহমেদ যে মনত্মব্য করেছেন তা আমার ভাল লেগেছে। দীর্ঘ ২৭ মাস তাঁরা মতা পরিচালনা করেছেন। আমি তখন বার বার বলছিলাম যে, এদেশে বিরাজনীতিকরণের চেষ্টা কাজ করবে না। আমরা মতায় এসে ওই ২৭ মাসের ভীতিকর পরিবেশ পাই। বিনিয়োগকারীরাও ভয়ে ছিল, এরা (মহাজোট সরকার) মতায় এসে কী করে? ওই অবস্থা আমরা অতিক্রম করতে পেরেছি। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আমাদের ওপর একটা বিশ্বাস এসেছে, আস্থা এসেছে। ওই আস্থা তৈরি হতে না হতেই শুরম্ন হয় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা। বিনিয়োগকারীরা বোঝার চেষ্টা করে বাজার কোন্ দিকে যাচ্ছে। পণ্য উৎপাদনের পর বেচবে কোথায়? দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে- দেশের অভ্যনত্মরে বিদু্যত, গ্যাস সমস্যা ও দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থা। একজন উদ্যোক্তার পণ্য উৎপাদন করে নড়াচড়া করার কোন সুযোগ নেই। দেশের উন্নয়নের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা হচ্ছে অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ। দেশে নদীনালা নেই। একমাত্র রেল আছে তাও পর্যাপ্ত নয়। ওয়াগন ব্যবস্থা ভাল না। চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের রম্নটে ট্যাঙ্কার ওয়াগন দিয়ে তেল আনা হয়। রেলের ইঞ্জিনের মতা এত কম যে ট্যাঙ্কার ওয়াগন নিয়ে রেলগাড়ি ব্রিজে উঠতে পারে না। সিলেটে বড় বিমান যেতে পারে, কিন্তু সেখান থেকে সরাসরি ফাইট বিদেশে যেতে পারে না। কারণ সেখানে এভিয়েশন ফুয়েল সরবরাহ করা যায় না। এেেত্র অতীতের সরকারের চরম খামখেয়ালিপনা রয়েছে। এটা কি ধরনের খামখেয়ালিপনা তা চিনত্মা করা যায় না। এ সমস্যা আমরা কাটিয়ে উঠব আশা করছি। তবে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ব্যাপারে বাজেটে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটা বিনিয়োগের ব্যাপারে খুব সহায়ক হিসাবে কাজ করবে।
কাওসার রহমান : অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পিপিপি'র দায়িত্ব সরিয়ে বিনিয়োগ বোর্ডের কাছে দেয়া হয়েছে, এটা কিভাবে দেখছেন?
এএমএ মুহিত : এটা কোন সমস্যা নয়। কে করছে সেটা বড় বিষয় নয়। এখানে কিভাবে প্রশাসনিক অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে সেটা আসল বিষয়। বিনিয়োগ গাইড লাইন তৈরি হবে সবচেয়ে বড় বিষয়। যে গাইড লাইনের মাধ্যমে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কাজ করবে। আগে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিদু্যত পিপিপি'তে অনত্মর্ভুক্ত ছিল। সেখানে এখন শিা ও স্বাস্থ্য খাতকে নিচ্ছি। তবে পিপিপি'র পুরো প্রক্রিয়াটি কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। এ বছর যে রকম হওয়ার কথা ছিল সেটা হবে না। ঢাকা চট্টগ্রাম চার লেনের সড়ক, ঢাকায় উড়াল সড়ক, হয়ত পাতাল রেল পিপিপির আওতায় চলতি অর্থবছরে প্রক্রিয়াজাত করা যাবে; প্রস্তুতি শুরম্ন হয়েছে। শিা ও স্বাস্থ্য খাতের কিছু প্রকল্পের কাজ হতে পারে। আগামী বছর থেকে এর কাজ পুরোপুরি জোরদার হবে।
স্বদেশ রায় : আপনি বললেন পিপিপির কাজ বিলম্ব হচ্ছে। বাইরে একটি কথা আছে বর্তমান সরকার সবকিছুতে দেরি করছে, আসলে কি তাই?
এএমএ মুহিত : আমি একটু ব্যাখ্যা করে বলব। বর্তমানে প্রশাসনিক দৰতা অতি নিম্নমানের। সরকারী প্রতিষ্ঠানে সেবা প্রদানের কালচারদুষ্ট। দেশে সেবার গতি ও মান ফিরিয়ে আনতে হচ্ছে। এজন্য সময় লাগছে। প্রশাসন গতিশীল হলে সব কিছু দ্রম্নত কাজ করবে।
স্বদেশ রায় : বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, সরকারী কর্মকর্তাদের দতা ও যোগ্যতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছে?
এএমএ মুহিত : এসব প্রশ্ন অস্বাভাবিক নয়, অদৰতা এখানে সেখানে কিছু থাকবে বটে। সব তো আর সমান হয় না। কিছুটা দেরি হচ্ছে আমাদের নিজেদের কারণে, কিছুটা হচ্ছে প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে। যে কাজটি জুনের মধ্যে শেষ করার ল্য নির্ধারণ করা হয়। দেখা গেছে, ওই কাজটি শেষ হচ্ছে সেপ্টেম্বরে।
মিজান চৌধুরী : পিপিপির দায়িত্ব বিনিয়োগ বোর্ডের কাছে দেয়া হয়েছে, সত্যিকার অর্থে বিনিয়োগ বোর্ডের এটা বাসত্মবায়নের সমতা আছে?
এএমএ মুহিত : এজন্য বিনিয়োগ বোর্ড সংস্কার করে শক্তিশালী করা হচ্ছে। বেসরকারী খাত থেকেও লোকবল নেয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।
স্বদেশ রায় : তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকারের ২৭ মাসের ওপর আপনার লেখা বইতে লিখেছেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় আলাদা হওয়া ঠিক না, এটা যদি অবলুপ্ত করা হয় তাহলে আপনি কি মনে করেন কাজের ধীর গতি কমবে?
এএমএ মুহিত : প্রথম কথা হলো যে আমার বইয়ের সব অভিমত আমার দলের বা পরবর্তীকালে আমাদের দলীয় ইশতেহারের নয়। অনেক বিষয়ে ব্যক্তিগত ধারণা রয়েছে। আমি একনিষ্ঠভাবে ৰমতার বা সরকারের বিকেন্দ্রায়ন বা প্রতিসংক্রম চাই। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থাকার কারণে অনেক কিছু কেন্দ্রীয়ভাবে সাধিত হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে বেশি কাজকর্ম হলে স্বাভাবিক বিলম্ব হয়। সকলে প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করে থাকলে তো কাজের গতি কমবে। প্রধানমন্ত্রী কত সময় দিতে পারেন তা একটি বিষয় বটে। নানাকাজে তাঁকে দৃষ্টি দিতে হয়_ এ জন্য কিছুটা বিলম্ব হয়ে যেতে পারে। তার রাজনৈতিক দায়িত্বে অন্য কারও পৰে ভাগ নেয়া অসম্ভব। সেই দায়িত্ব পালনে তার বিসত্মর সময়ের প্রয়োজন। এছাড়া যে কোন কেন্দ্রায়িত পরিস্থিতিতে সমন্বয় দুর্বল হয়ে যায়। সকলের একটি মনোভাব থাকে যে, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সিদ্ধানত্মটি নিয়ে আসি। তাতে সমন্বয়ের বিষয়টি জটিল ও দীর্ঘায়িত হয়ে যেতে পারে।
মিজান চৌধুরী : ব্যবসায়ীরা বলছে বিনিয়োগের প্রধান বাধা গ্যাস, বিদু্যত সঙ্কট_ এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?
এএমএ মুহিত : হঁ্যা, গ্যাস-বিদু্যতের সঙ্কট আছে। এই সঙ্কট কাটানোর জন্য আমরা চেষ্টা করছি। দশ বছর পর মতায় এসে নয় মাসে আমরা অনেক দেয়ার চেষ্টা করছি। আমরা গ্যাস সরবরাহ প্রায় আড়াই/ ৩শ' এমএমসিএফটি বাড়িয়েছি। তবুও ঘাটতি অনেক, চাহিদা বেশি। এ কারণে আমাদের রেশনিং করতে হচ্ছে। একটা কথা উঠেছে- দেশে গ্যাসের মজুদ নেই। গ্যাস আছে কি না তা বুঝতে হলে উৎকলন কর্মকা- বাড়াতে হবে। নতুন কূপ খনন করলে জানা যায় গ্যাস আছে কি না। বিশ্বের যেসব দেশে গ্যাস আছে তার মধ্যে নেদারল্যান্ডস ৫০ বছরের বেশি সময় পর্যাপ্ত চাহিদা মিটিয়েও রফতানি করছে অথচ ১৯৫৫ সালে সেখানে প্রশ্ন উঠে যে গ্যাস রফতানি সঠিক কি না। বলিভিয়া পাইপলাইনে ব্রাজিলসহ অন্যান্য দেশে গ্যাস রফতানি করছে। এক সময় তাদেরও গ্যাস নেই বলা হয়েছিল। এখন তাদের গ্যাস মজুদ বাড়ছে। এসব দেশে মজুদ বাড়ার কারণ সেখানে প্রচুর গ্যাসকূপ খনন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে গত সাত বছরে তেমন গ্যাসকূপ খনন করা হয়নি। আমাদের পাশর্্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের প্রশাসন দুর্বল হলেও সেখানে বছরে ১০ থেকে ১২টি গ্যাসের কূপ খনন করা হচ্ছে। বিগত সাত বছরে মাত্র ৫টি উন্নয়ন বা ওয়ার্কঅভার কূপ খনন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের এই এক বছরে পাঁচটি কূপ খনন করা হচ্ছে। অনেক কূপে সাফল্য আসে না তবে চেষ্টা তো করতে হবে এবং তা'ই করা হচ্ছে। কারণ গ্যাস উত্তোলনের জন্য একটাতে 'হিট' করলে হয়, আবার অন্যটাতে হয় না। দেশে গ্যাসের জন্য উন্নয়ন বা ওয়ার্কঅভার কূপ নয় উৎকলন কূপও খনন করতে হবে। আগামী তিন বছরের মধ্যে গ্যাস শেষ হয়ে যাবে এই ভয় আমার মনে হয় কূপ খননে জোর আসলে কেটে যাবে। আমার ধারণা আমরা কূপ খননে জোর দিলেই গ্যাস পাবই। এজন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। কয়লার ব্যাপারে কিছু করা দরকার। দেশের কয়লা উত্তোলন করতে হবে।
আবার আমাদের এত বেশি ও ভাল কয়লা আছে। আমরা উত্তোলন করব না কেন? জানি, পরিবেশ নিয়ে সমস্যা আছে। কিন্তু কয়লা উত্তোলন পরিবেশবান্ধব না হলেও, অধুনা পরিবেশ সহায়ক প্রযুক্তি আছে। বাংলাদেশের কয়লার কয়েকটি গুণাবলী আছে। সালফারের পরিমাণ কম। এটার তাপ সৃষ্টির শক্তি বেশি। ফলে কয়লা 'ডাস্ট' কম হবে। এটা অবশ্য ঠিক যে পরিবেশগত সমস্যা হবে। কিন্তু এখনও তো ভারত, চীন, আমেরিকার মতো বড় বড় দেশ কলয়ার ওপর বেশি নির্ভর করে আছে। আমাদের এখানেও কয়লাভিত্তিক বিদু্যতকেন্দ্র স্থাপন করার টেন্ডার আহ্বান করা হচ্ছে। এগুলো হতে চার পাঁচ বছর লেগে যাবে।
কাওসার রহমান : কয়লার উত্তোলনের কয়লা নীতি করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ওই নীতি প্রণয়নে বিলম্ব হচ্ছে কেন?
এএমএ মুহিত : সরকার দুটি কয়লাভিত্তিক বিদু্যতকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কয়লা নীতি তার আগেই প্রণয়ন করা হবে। তবে উৎকলনের বিষয়ে নীতিমালা করা তত দ্রম্নত না করলেও চলে। কারণ কয়লাভিত্তিক বিদু্যত পস্নান্ট করতে ৪ থেকে ৫ বছর প্রয়োজন হবে। কয়লা আমদানি করতে হলে পরিবহন সমস্যা দেখা দেবে। কয়লা আমদানির মতো পরিবহন সমতা আমাদের বর্তমানে নেই। অভ্যনত্মরীণ উৎপাদনের পলিসিও এখনও হয়নি। এইসব পলিসি ও ব্যবস্থা চূড়ানত্ম করার আগেই কিন্তু কয়লা বিদু্যতের দরপত্র আহ্বান করা উচিত। এটার কাজ শুরম্ন হতে হতে আমরা অভ্যনত্মরীণ কয়লা পলিসি তৈরি করে ফেলতে পারব। অভ্যনত্মরীণ পলিসি প্রণয়ন করতে ছয় মাস লাগতে পারে। অভ্যনত্মরীণ পলিসি হয়ে গেলে আমি জানি অভ্যনত্মরীণভাবে কয়লা সরবরাহ দেয়া যাবে। ওপেন পিট করতে পারলে অভ্যনত্মরীণ সরবরাহ অনেক বেড়ে যাবে। আমদানিরও প্রয়োজন হবে না।
স্বদেশ রায় : ওপেন পিট পদ্ধতিতে গেলে আমাদের অনেক লোক উদ্ধাস্তু হবে এ বিষয়টি কি ভেবেছেন?
এএমএ মুহিত : ওপেন পিটে গেলে মানুষ উদ্ধাস্তু হবে ঠিক। ফুলবাড়িয়া উপজেলায় কেউ থাকতে পারবে না। তবে আমাদের বিবেচনা করতে হবে কোনটা পুরো জাতির জন্য ভাল হবে। আমার কথা হলো, আমাদের একটি মূল্যবান সম্পদ রয়েছে। এ সম্পদের ব্যবহারের জন্য আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে। পরিকল্পনায় যেয়ে সব পদ্ধতি বিবেচনা করা হবে। এটা করা আমাদের জন্য কঠিন কিছু হবে না। আমরা স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করি। আমরা সেখানকার মানুষদের বুঝাব। মাটির নিচে এই সম্পদ আছে। আপনার ব্যবহার করবেন নাকি মাটির নিচে রেখে দেবেন। ব্যবহার করতে হলে এই সমস্যা হবে। এরপর সিদ্ধানত্ম নেয়া হবে। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা সিদ্ধানত্ম নেব।
কাওসার রহমান : আপনাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রত্যেক ঘরে একজন করে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন। এটা বাসত্মবায়ন করবেন কিভাবে?
এএমএ মুহিত : সঠিক কথা হলো যে প্রত্যেক ঘরে একজনের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। সে চাকরিও করতে পারে, বিনিয়োগ করে স্বনিয়োজনেরও ব্যবস্থা হতে পারে। এবং প্রত্যেক পরিবারে অনত্মত একজনের জন্য কর্মসংস্থান করা হবে ২০২১ সালের মধ্যে, ২০১৪ সালের মধ্যে নয়। চালাকি করে অনেকে বলছেন যে এটা ২০১৪ সালের মধ্যে করা হবে। ২০২১ সালে দারিদ্র্যের হার যদি ১৫ শতাংশে নামাতে হয়, তাহলে আমাদের তা করতেই হবে এবং এটা করা সম্ভব। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, অনেক পরিবারে তিন জনও চাকরি করবে, আবার কোন পরিবারে চাকরি করবে একজন। এরকম না হলে দারিদ্র্যের হার ১৫ শতাংশে নামানো যাবে না।
স্বদেশ রায় : এটা কি এখন থেকেই নিয়মিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হচ্ছে, না কি ২০১৫ সাল থেকে শুরম্ন হবে?
এএমএ মুহিত : হঁ্যা, এটা এখন থেকেই করা হচ্ছে। এজন্য আমরা বিভিন্ন পদপে নিচ্ছি। কর্মসংস্থানের প্র্রক্রিয়া একটা নয়। আমরা এক শ' দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্প নিয়েছি, আমাদের ন্যাশনাল সার্ভিস আছে, প্রবাসে পাঠানোর জন্য প্রশিণের ব্যবস্থা আছে, ৰুদ্র ঋণ প্রকল্প সরকারী ও বেসরকারী খাতে আছে। পাঁচ থেকে ছয় ধরনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সবকিছুর উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রত্যেক পরিবার থেকে একজন আয়ের লোক তৈরি করা।
মিজান চৌধুরী : আপনার সরকারের সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, এতে আপনার অনুভূতি কি?
এএমএ মুহিত : আমাদের প্রবাসীরা টাকা পাঠাচ্ছেন। প্রবাসনে যেতে অনেক অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও আলস্নাহর মেহেরবানি আছে। আমরাও চেষ্টা করছি যাতে রেমিটেন্স দ্রম্নত প্রাপকের হাতে পেঁৗছে। তবে আমরা একটা বিষয় নিশ্চিত করছি যে, আমরা মুখে যা বলছি তা করার চেষ্টা করছি। মানুষের ভালবাসা পাচ্ছি। মানুষকে সামনে রাখছি। মানুষের সমালোচনা শুনছি। এ কারণেই সাফল্য আসছে।
স্বদেশ রায় : আমাদের দেশে বারবার রাজৈনৈতিক অস্থিতিশীলতা আসে, প্রত্যেকটা অস্থিতিশীলতার পিছনে অর্থনীতি কাজ করে, বর্তমানে রৰণশীল ও জঙ্গীবাদের হাতে বেশি পুঁজি চলে গেছে। এ বিষয়ে আপনাদের চিনত্মাভাবনা কি?
এএমএ মুহিত : এটা এক ধরনের বিপদ সঙ্কেত। তাদের টাকা আছে, তারা বিনিয়োগ করছে। আমরা যেটা করতে পারি তা হচ্ছে কোন অসৎ পথে বিনিয়োগ হচ্ছে কিনা, জঙ্গীবাদ উত্থানে কোন টাকা ব্যবহার হচ্ছে কিনা, এই বিনিয়োগ থেকে জাতি সুবিধা পাচ্ছে কিনা, ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া হচ্ছে কিনা তা দেখা। সেটা আমরা দেখছি ও করছি।
স্বদেশ রায় : উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য জাতীয়ভাবে অর্থনীতিতে কোন পুঁজি গড়ার পরিকল্পনা আছে আপনাদের?
এএমএ মুহিত : নিশ্চয় আছে। আমরা আমাদের উদাহরণ দিয়ে করতে চাচ্ছি সেটা। সংসদের বৈঠকেও আমরা বলেছি। দুইটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এক. দুর্নীতি, দুই. দুঃশাসন। দুঃশাসন আর দুর্নীতি থাকলে দেশের উন্নতি হবে না। দুঃশাসন আর দুর্নীতি অবলম্বন করলে দেশে কোন পরিবর্তন হবে না। দেশের মানুষের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। আর ওটা করতে গিয়ে সতর্ক থাকতে হবে যাতে দুর্নীতি ও দুঃশাসন না আসে। যদিও এটা নিশ্চিত করা খুবই কষ্টকর হবে।
স্বদেশ রায় : আপনাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারে ঢাকার যানজট নিরসনের কথা বলা আছে। সরকারের ভেতর আপনি স্থানীয় সরকার নিয়ে বেশি সোচ্চার। যানজট কমানোর জন্য বিকেন্দ্রীকরণ একটি গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন একটা উদাহরণ, আমরা দেখছি ভারতের শেয়ারবাজার দিলস্নীতে না হয়ে রয়েছে বোম্বেতে, আমাদেরটা কেন ঢাকায়?
এএমএ মুহিত : এটা একটা বড় প্রশ্ন। আমাদের সবকিছু ঢাকায়। বর্তমানে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল থাকলে সকাল আটটায় টাঙ্গাইল থেকে এসে অফিস করা সম্ভব। আমার অর্থ মন্ত্রণালয়ের কথা বলি। এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বর্তমানে ৬৭টি জেলায় সরকারী আয়-ব্যয়ের হিসাব রৰা করা হয়। আমি যে কোন সময় কম্পিউটার খুলে আয়-ব্যয় দেখতে পারি। এ জন্য আমাকে ঢাকায় থাকার প্রয়োজন নেই। যে কোন স্থান থেকে ইন্টারনেটে হিসাবের নানা বিষয় দেখতে পারি। তাই সব কিছু ঢাকায় হতে হবে_ তার দরকার নেই। প্রযুক্তিই আমাদের বিকেন্দ্রীকরণের দিকে নিয়ে যাবে।
স্বদেশ রায় : আপনার অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনার জন্য সকল ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় কি ঢাকায় থাকবে?
এএমএ মুহিত : তার কোন প্রয়োজন হবে না। কম্পিউটারাইজ করা হলে যে কোন স্থান থেকেই ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। এটা আমেরিকায় প্রায়ই হচ্ছে। একটি প্রতিষ্ঠান আজ এখানে আছে, কয়েকদিন পরই ওই প্রতিষ্ঠানের অবস্থান অন্যখানে চলে যাচ্ছে। আমাদেরও হবে। আর এই হওয়ার মাধ্যমেই হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপানত্মর।
কাওসার রহমান : দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বেশি। এ জন্য মূল্যস্ফীতিতে একটা চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখতে আপনি কী পদপে নিচ্ছেন?
এএমএ মুহিত : বর্তমানে মোটা চালের দাম বেশি। কিন্তু তা একেবারে অহেতুক। বাজারে চালের সরবরাহ পর্যাপ্ত; দেশে উৎপাদনও ভাল হয়েছে; উৎপাদন সম্ভাবনাও ভাল; মজুদও ভাল; সরকারী বিতরণও চলছে। মনে হয়, বর্তমানে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু বিত্তশালী লোভী ব্যবসায়ী। আমরা ভেবেছিলাম, আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে পারছি না। আমি চিনির বিষয়টি বলি। চিনির বাজার সহনশীল রাখতে আমি যেদিন আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করি, একই সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রী কয়েক রিফাইনারির সঙ্গে কথা বলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তাদের বলেন যে, আমি চিনি থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করব, আপনারা কী করবেন? পরে ফোন করে আমাকে বাণিজ্যমন্ত্রী জানান যে, আপনি শুল্ক বাবদ যত টাকা হ্রাস করবেন রিফাইনারি মালিকরা টনপ্রতি ওই টাকা কমাবে। আমরা পদপে নিলাম, শু�

No comments

Powered by Blogger.