নিজের দশের ও দেশের কথা by খোরশেদ আলম

অনেক দিন হলো কিছু লেখা হচ্ছে না। আমার সর্বশেষ লেখা বেরিয়েছিল গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তিন কিস্তিতে ইংরেজীতে Financial Express-G "What Lies Ahead" শিরোনামে।
তখন রাজনৈতিক উত্তাপ সম্ভবত একটু বেশি বোধ করছিলাম এবং অর্থনৈতিক কিছু বিষয়ের উপরও লেখার কিছু ছিল।
প্রথমটিতে বাংলাদেশের ইতিহাসের বিবর্তন বিধৃত হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৭ সালে একজন সিএসপি কর্মকর্তা হয়ে যাত্রা শুরু করে ১৯৫৮ সালেই দেখলাম আইযুব খানের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু। এরপর ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের অপসারণ ও ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন। অল্পদিনের মধ্যে নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের পাকিস্তানের সামরিক অভিযান সত্ত্বেও পাকিস্তানের মৃত্যু ও বাংলাদেশের জন্ম। কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অপমৃত্যু এবং জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন। ১৯৮০ সালে জিয়া শাসনের পরিসমাপ্তির পর এইচএম এরশাদের শাসনামল। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই আমলের অবসান হয় এবং সকল রাজনৈতিক দলের সমঝোতার মাধ্যমে গঠিত হয় বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অস্থায়ী সরকার। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় বিএনপির পার্লামেন্টারি সরকার। ১৯৯৬ সালে বিএনপি কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করতে বাধ্য হয় এবং তার অধীনে নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি পুনঃক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় কি কারণে এবং কোন যোগসূত্রে তাতে আমি যাচ্ছি না। আমি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার কথা বলছি। পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ২০০৬ সালে। নানান গোলযোগের কারণে সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ইয়াজউদ্দিন, মইনউদ্দিন ও ফখরুদ্দীনের আধা সামরিক শাসনের অধীনে ২০০৮ সালে। তাতে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতাসীন হয় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। আমি ইতিহাস একটানা বলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।
গত লেখাটি যখন লিখেছিলাম, তখন দেশের রাজনৈতিক গোলযোগ যাতে না হয় তার জন্য বিবদমান দুই দল ব্যতিরেকে দেশী, বিদেশী সকলে তাদের টেবিলে বসে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা তৈরির তাগাদা দিচ্ছিলেন। একদিকে বিএনপি কেয়ারটেকার সরকার ছাড়া আর কারও অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না অথবা হতে দেবে না।
অপরপক্ষে সরকারের কথা হলো দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। আমরা অতীতে এই ধরনের হঠকারিতার পরিণতি দেখেছি। এর পুনরাবৃত্তি কেউই নিশ্চয়ই দেখতে চায় না। সকল পক্ষের সুমতি হোক তাই আমরা আশা করব ও প্রার্থনা করব। আমার এই লেখার ফল্গুধারাটি আবার শুরু হলো ভাই আবদুল গাফফার চৌধুরীর স্ত্রীর মৃত্যুর পর তার প্রথম লেখাটি জনকণ্ঠে পড়ে। আমি অনেকদিন যাবত শারীরিক কারণে লেখাতে হাত দিতে পারছিলাম না। আর বাংলায় লম্বা হারে লেখতেও বেশ কষ্টসাধ্য। গাফফার ভাইকে অনেক দিন থেকে চিনি, যদিও বহুদিন ধরে তাঁর সঙ্গে দেখা সাক্ষাত নেই। আশা করি তিনি আমাকে চিনতে পারছেন। ভাবীর মৃত্যুর পর তাকে বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে দাফন করে তিনি লন্ডনে ফিরে গিয়ে একান্তভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। বন্ধু-বান্ধব অনেকেই তাঁকে উৎসাহিত করেছেন আবার লিখতে তিনি বোধহয় তিন চার সপ্তাহ কিছু লিখেননি। একজন বন্ধু তাকে এসে বললেন হয় আবার লিখুন। অথবা ঢাকায় কয়েকটি পত্রিকা পড়ুন। সে পড়া থেকেই তিনি শুধু উৎসাহিত হলেন না। তিনি লিখতে শুরু করলেন দেশের অবস্থার উপরে। যাতে তিনি সিদ্ধহস্ত।
প্রথম লেখাটিতে তিনি দুই বিজ্ঞ মানুষের বক্তব্যের ওপর মন্তব্য করেছেন। একটি, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছের লোক ড. কামাল হোসেন আর একজন অত্যন্ত দক্ষ আমলা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের কেয়ারটেকার সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। আমিও একদিন একজন আমলা ছিলাম। কিন্তু আমি কোনদিন কোন টকশোতে অর্থাৎ পাবলিক ফোরামে কথা বলিনি, বলব না। আমার পা-িত্য জাহির করার প্রয়োজন আমি বোধ করি না। ড. আকবর আলি খানের বক্তব্য সম্পর্কে গাফফার ভাইয়ের মন্তব্যই আমার বিবেচ্য বিষয়। ড. খান কোন ফোরামে বলেছেন, তাঁরা চারজন তৎকালীন উপদেষ্টা পদত্যাগ না করলে আজকের সরকার প্রতিষ্ঠিত হতো না। অর্থাৎ তাদের পদত্যাগই জনগণকে আওয়ামীমুখী করেছে। আমার পক্ষে এই বক্তব্যটি বুঝতে অনুবিধা হচ্ছে। তিনি একজন বোদ্ধা ব্যক্তি। তিনি আমার এবং নাসিমুদ্দিনের পর হয়েছিলেন অর্থসচিব (আমার অধীনে তিনি ছিলেন যুগ্ম অর্থসচিব এবং টেক্সটাইল মিনিস্ট্রি হয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে হয়েছিলেন অর্থসচিব)। একপর সৌভাগ্যবান ব্যক্তিটি হয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং সবশেষে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের বিকল্প প্রতিনিধি। আর তার পর তো রাজনৈতিক পদে সরকারের উপদেষ্টা।
কাজেই তাঁর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য এবং কীর্তিমান সাংবাদিক লেখক বন্ধু আবদুল গাফফার চৌধুরীর বক্তব্যও উপেক্ষা করার মতো নয়। তবে আমি গাফফার ভাইয়ের প্রতিপাদ্যের প্রতি সংবেদনশীল।
এখন আসি দেশের কথায়। অনেক দিন না লিখাতে সবকিছু অবগত হওয়া সত্ত্বেও সবকিছুর ওপর আমার কথা বলা হয়নি। পুরো একটা বছর কেটে গেছে, ২০১২ সাল। সেই সময়ে অনেক কিছু ভাল হয়েছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ। সংক্ষেপে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দেশজ উৎপাদনও উর্ধমুখী। তার বিপরীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা হাতের নাগালের যেন বাইরে চলে গেছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি গ্রুপের লুটপাট এবং পদ্মা সেতুর অচলাবস্থা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই সমস্ত কেলেঙ্কারির সুরাহা করা যায় না, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। যৌথভাবে পুঁজিবাজারের অব্যবস্থাপনা অনেক ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য দিক। সরকার এর কোনটারই কুল-কিনারা করতে পারেনি এটা সম্ভব নয় তা আমরা দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে রাজি নই।
সবচেয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অবশ্যস্বীকার্য। গত বছরের ১ জানুয়ারি সাংবাদিক সাগর-রুনী হত্যা, নরসিংদী পৌরসভার চেয়ারম্যান লোকমানে হোসেনের হত্যাকা-, সিলেটে সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জায়গার ধর্ষণের ঘটনা ও তার পরবর্তী নৃশংসতা কিছুতেই উপেক্ষার যোগ্য নয়। পুলিশের তদন্ত বিভাগ কোন কিছুর চূড়ান্ত সুরাহা করতে পারে না। তা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা যারা প্রশাসনে কাজ করেছি, তারা পুলিশ প্রশাসন ও বিশেষত তাদের তদন্ত বিভাগের দক্ষতা ও কর্মস্পৃহা সম্পর্কে নিঃসন্ধিহান। যদি না তাতে অন্য প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না হয়। দেশের আপামর জনসাধারণ একটু স্বস্তি পেতে চায়। দেশ ও দশের সকলের মঙ্গল হোক।

লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর

No comments

Powered by Blogger.