চালের মজুদ ঠেকাতে ব্যাংক ঋণে বিধিনিষেধ আসছে by মিজান চৌধুরী

চালের মজুদ ঠেকাতে দাদন ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ (সিসি) দেয়ার ওপর বিধি নিষেধ আরোপ হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য সংক্রানত্ম টাস্কফোর্স কমিটি চাল মজুদের সঙ্গে দাদন ব্যবসায়ীদের জড়িত থাকার বিষয়ে প্রমাণ পেয়েছে।
ব্যাংক থেকে সিসি ঋণ নিয়ে চাল মজুদ করছে দাদন ব্যবসায়ীরা। ফসল ওঠার সঙ্গে কম মূল্যে তারা কৃষককের কাছ থেকে ধান কিনে মজুদ করছে। সরবরাহে ঘাটতির কারণে বাজার উর্ধমুখী হলে মজুদ ধান দাদন ব্যবসায়ীরা উচ্চ মূল্যে বিক্রি করছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আনত্মঃমন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স কমিটির সভায় দাদন ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ বন্ধ করার প্রসত্মাব আনা হয়। কমিটির ওই প্রসত্মাবটি বাংলাদেশ ব্যাংকে লিখিত আকারে জানানোর সিদ্ধানত্ম হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন এক কর্মকর্তা জানান, টাস্কফোর্স কমিটির সিদ্ধানত্ম কেন্দ্রীয় ব্যাংককে লিখিতভাবে জানানো হবে। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যাপারে চূড়ানত্ম সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করবে। তবে চাল মজুদের সঙ্গে দাদন ব্যবসায়ীদের জড়িত থাকার বিষয়টি জানা গেছে। চাল মজুদ বন্ধ করতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাল মিল ও চাতাল মালিকদের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি গুরম্নত্ব সহকারে দেখবেন।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলোতে বিপুল পরিমাণ অর্থ অলসভাবে পড়ে আছে। কিছু ব্যাংক ওইসব অর্থ ঋণ হিসেবে দিচ্ছে চালের পেছনে। বিশেষ করে চাল মিল, চাতাল মালিক ও দাদন ব্যবসায়ীদের ব্যাপক হারে নগদ ঋণ প্রদান করছে। ওই ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ করছে না। ব্যাংক থেকেও এ ব্যাপারে কোন চাপ সৃষ্টি করছে না ব্যবসায়ীদের ওপর। ফলে ১৩ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ৩৫ শতাংশ মুনাফায় চাল বিক্রি করছে। ব্যাংক ঋণের সুদ ১৩ শতাংশ পরিশোধ করা হলেও ২০ শতাংশ মুনাফা থেকে যাচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ী, চাতাল মালিক, দাদন ব্যবসায়ী চাল মজুদের েেত্র ব্যাপক হারে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। এদিকে মজুদ বিরোধী কোন আইন না থাকায় ওইসব ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এসব কারণে চালের বাজারে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কৃষি ব্যাংক ৩৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনার জন্য ঋণ দেয়ার বিধান থাকলেও ওই ঋণের মধ্যে ৫ কোটি টাকা গেছে চাতাল, চাল মিল ও দাদন ব্যবসায়ীদের হাতে। সূত্র মতে, ময়মনসিংহের মেসার্স ভাই ভাই অটোরাইস প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১২ লাখ টাকা, আসমা রাইস মিলে ৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ফুলবাড়িয়া সেলিনা ট্রেডার্সের অনুকূলে ১২ লাখ টাকা, মেসার্স গোলাম কিবরিয়ার অনুকূলে ১০ লাখ টাকা, সাকিব এন্টারপ্রাইজে ১০ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হয়। এ ছাড়া মহেশপুর শাখা থেকে চাতালের জন্য শংকর কুমার দে'কে ১৭ লাখ টাকা, খালেকুজ্জামানকে ১৪ লাখ টাকা দেয়া হয়। রাইস মিলের জন্য রামু শাখা থেকে মেসার্স আলম ট্রেডার্সকে ১০ লাখ টাকা, চিরিংগা শাখা থেকে আল আমিন অটো রাইস মিলে ১০ লাখ টাকা, শাহ আমানত রাইস মিলে ৫ লাখ টাকা, গুলজার অটো রাইস মিলে ১০ লাখ টাকা, আদর্শ অটো রাইস মিলে ৫ লাখ টাকা, মেঘনা অটো রাইস মিলে ৪ লাখ টাকা, হাজী আলম রাইস মিলে ১০ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হয়। ধান ক্রয় করে চাল উৎপাদনের জন্য উজলপুর শাখা থেকে লতিব, দিলরম্নবাসহ ৬ জনকে সোয়া দুই লাখ টাকা, জীবননগর শাখা থেকে চাতালের মাধ্যমে চাল প্রক্রিয়ার জন্য ৩০ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হয়। এ ছাড়া বদরগঞ্জ শাখা থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা, আলমডাঙ্গা শাখা থেকে সোয়া লাখ টাকা, মাগুরা শাখা থেকে রম্নহুল আমিনকে আড়াই লাখ টাকা, মালেক মোল্যাকে ৩০ লাখ টাকা, সৈয়দ মইনুল ইসলামকে ৫ লাখ টাকা, ভাবনহাট শাখা থেকে চাতাল মালিক সালামকে ৩ লাখ টাকা, আড়পাড়া শাখা থেকে ধ্রম্নব রায়কে ৩ লাখ টাকা, সিকদার হোসেনকে ৫ লাখ টাকা, চাল কেনার জন্য মাগুরার আড়তপাড়া শাখা থেকে গাফফার মোল্যাকে ৭ লাখ টাকা, হরিদাসকে ৭ লাখ টাকা, যশোর গোপালপুর শাখা থেকে চাতাল মালিক গনি বিশ্বাসকে ৭ লাখ টাকা, মাহবুবুর রহমানকে ৬ লাখ টাকা, তফসিল হোসেনকে ২ লাখ টাকা, কুয়াদাবাজার রশিদ দফাদারকে ৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা ঋণ দেয়া হয়। রগুনাথপুরে ইকবালকে ২ লাখ টাকা, কেসবপুর হাসানপুরের আতিয়ার রহমানকে ৩৫ লাখ টাকা, আরবিন্দু দাসকে সাড়ে তিন লাখ টাকা, যশোর রম্নপাদিয়ার প্রশানত্ম শাহাকে ১৮ লাখ, সিরাজুল ইসলামকে ১০ লাখ, ইদ্রিস আলীকে ৫ লাখ, একরাম মোলস্নাকে ২৫ লাখ ও আজিজুল হককে ৩ লাখ টাকা নগদ ঋণ দেয়া হয়। এভাবে সারাদেশের বিভিন্ন চাল মিল মালিক, দাদন ব্যবসায়ী, চাতাল মালিকদের হাতে পর্যাপ্ত ব্যাংক ঋণ চলে যাওয়া চাল কিনে মজুদ করতে সুবিধা হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে একটি বেসরকারী ব্যাংক ব্যাপক হারে চাল মিল মালিক ও চাতাল মালিকদের ঋণ প্রদান করে আসছে। বড় বড় মিল মালিকরা এই ঋণ পেয়ে লাখ লাখ বসত্মা চাল মজুদ করছে। ওই চাল ব্যাংকের গুদামে সিল করে রাখা হচ্ছে। প্রায় ব্যাংক এভাবে চাল কেনা, চাল প্রক্রিয়া ও দাদন ব্যবসায়ীদের ঋণ দিচ্ছে। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে চাল ব্যবসায়ী জড়িত হয়ে কারসাজির মাধ্যমে বাজার অস্থির করে তুলেছে। এ জন্য চালের মৌসুমেও দাম কমছে না।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স কমিটি মনে করছে দাদন ব্যবসায়ীদের হাতে ঋণ চলে যাওয়া চাল মজুদ করতে তাদের সমস্যা হচ্ছে না। তাই ঋণ দেয়ার ব্যাপারে দাদন ব্যবসায়ীদের ওপর বিধি নিষেধ আনা প্রসত্মাব দেয়ার সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়েছে।
এদিকে শুক্রবার পর্যনত্ম চালের দাম খুচরা বাজারে কমেনি। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৮ টাকা দরে। মাঝারি চাল ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা ও সরম্ন চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা দরে। তবে বাজারে চিনি মসুর ডাল ও রসুনের দাম কমেছে।

No comments

Powered by Blogger.