হৃদয়নন্দন বনে-কুশিক্ষার পঙ্কিল আবর্ত থেকে আকাশের আলোয় চাওয়া! by আলী যাকের

কেবল যে উদ্ভিদ উদ্যানেই এই ধরনের অরাজক ব্যবস্থা চলছে, তা নয়। আমার কেন যেন ধারণা, আমাদের আজকের বেশিরভাগ তরুণের শিক্ষা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। তারা প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য কিংবা তার নন্দনতত্ত্ব সম্বন্ধে আদৌ আগ্রহী নয় এখন। হায়-হুলস্থূল করে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলেই হলো।


আমার মনে আছে, একবার আমি এবং প্রয়াত নওয়াজেশ আহমেদ পাহাড়পুরের স্তূপ দেখতে গিয়েছিলাম, আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে। সেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রছাত্রী এসেছিল বনভোজনে। তাদের মধ্যে দু'জন যুবক ওই ক্ষুদ্রায়তন পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় উঠে উৎকট শব্দে বোম্বাইয়া গান বাজিয়ে তার সঙ্গে কোমর দুলিয়ে নাচছিল

পথ তো মেলাই আছে। নগর, জনপদ, গ্রামে বিস্তর পথ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেসব পথ ধরে, কোনো জাগতিক কাজের ব্যস্ততা না থাকলে দিব্যি ঘুরে বেড়ানো যায়। পথে পথে ঘুরে বেড়ানো এক আনন্দের ব্যাপার, যদি না পথ বন্ধুর হয়ে ওঠে। এই আমাদের ঢাকায় যেমন হয়েছে সাম্প্রতিককালে। গীতিকার ও সঙ্গীতজ্ঞ সলিল চৌধুরী যেমন বলেছিলেন, 'পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে পথ চেনা...।' এই পথ চিনতে নেমে পথকে তো চেনা হয়ই, সেই সঙ্গে চেনা হয় পথচারীকে_ নানা মতের, নানা বর্ণের পথচারী, চেনা হয় পথের দু'ধারের বাড়িঘর, উদ্যান কিংবা বৃক্ষরাজি। তবে আমাদের এই ঢাকায় পথচলা বড় সহজ নয়। চলতে চলতে থেমে যাই আমরা। থেমে থাকি এবং আবার চলতে শুরু করি। গন্তব্যে পেঁৗছতে দুই কিংবা তিন ঘণ্টাও লেগে যেতে পারে, আমাদের এই অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রায়তন শহরে। তাই কোনো বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেবল পথকে জানার জন্য, চেনার জন্য কেউ পথে নামতে চায় না আজকাল। একবার কোনোমতে কষ্টে-সৃষ্টে নিজের কর্তব্যস্থলে পেঁৗছে যেতে পারলেই বাকি সময় সেখাতে থিতু হয়ে থাকা, দূর সন্ধ্যায় রাস্তার অবস্থা অপেক্ষাকৃত হালকা হলে বাড়ির পথে ফের যাত্রা শুরু করার জন্য।
এসবই আছে, তবুও বেরিয়ে পড়া যায়। বেরিয়ে পড়া দরকার বলেই মনে হয় আমার। আমি এমন একজনকে জানি, যিনি অবসর সময় হাতে পেলেই বেরিয়ে পড়েন। বেশিরভাগ সময় তিনি কোনো যানবাহনের সাহায্য নেন না। তার দুই পা তখন হয়ে দাঁড়ায় তার ভরসা। তিনি হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ান। বাংলার বুনোফুলে আমার যৎকিঞ্চিৎ আগ্রহ আছে। তিনি সেটা জানেন এবং সেই সূত্র ধরে জিজ্ঞেস করেন, 'পথে ঘুরতে ঘুরতে নর্দমার পাশে কিংবা কারও বাড়ির বাগানের বাইরের দেয়াল ঘেঁষে যে অজস্র বুনোফুল ফোটে, সেগুলোর কি কখনও ছবি তুলে দেখেছো?' আমি তাকে বলি, নর্দমার পাশে নজর দেওয়ার প্রবৃত্তি আমার হয়নি। তবে রাস্তার ধারে, এখানে, সেখানে অনেক বুনোফুল দেখেছি বৈকি। মহাভৃঙ্গরাজ, বনগাঁদা, হাতিশূরা, দণ্ডকলস, শিয়ালমূত্র, এ রকম কত ফুল দেখেছি রাস্তার ধারে আমি। শুনে তিনি খুশি হয়ে যান। তিনিও যখন রাস্তায় হাঁটেন তখন তার চোখ খোলা থাকে। এসব ফুল তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ ছাড়াও আমার এই বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু বৃক্ষ চেনারও বাতিকগ্রস্ত। তিনি গুলশানে থাকেন এবং গুলশান এলাকার তাবৎ বৃক্ষ তার চেনা। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, তিনি কেন কোনো এক ছুটির দিনে আমাদের ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত উদ্ভিদ উদ্যানে যান না। তিনি আমায় উল্টো প্রশ্ন করেন, 'তুমি ওই দিকে গিয়েছো সম্প্রতি?' স্বীকার করি, দীর্ঘদিন আমাদের বোটানিক্যাল গার্ডেনে আমার যাওয়া হয়নি। তিনি কথা না বাড়িয়ে কেবল বলেন, 'গিয়ে দেখো।' বলেই হনহন করে তার গন্তব্যের দিকে হেঁটে চলে যান। আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, একবার শিগগিরই আমাদের বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখতে যেতে হবে।
আমি বিশ্বের যত শহরেই গেছি, হাতে সময় থাকলে চেষ্টা করেছি, আর কোনো দর্শনীয় স্থান না হোক, নিদেনপক্ষে তাদের উদ্ভিদ উদ্যানটি ঘুরে দেখতে। এর শুরু হয়েছিল কলকাতায়। হুগলী নদীর অপর পাড়ে হাওড়ায় অবস্থিত কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেন দিয়ে। এখানে কলকাতার অনেক মানুষ ভিড় করে কেবল গাছ দেখতে। ভারি সুবিন্যস্ত বাগান। প্রতিটি বৃক্ষের বোটানিক্যাল নাম, চলিত নাম, আদি বাস এবং ইতিহাস লেখা রয়েছে গাছটির সামনে। এই বাগানে আমি গিয়েছি আজ থেকে দীর্ঘ ৪০-৪৫ বছর আগে। অতএব, সব গাছের কথা এখন আর মনে নেই। তবে অনেক দুর্লভ গাছই এই বাগানে আমি দেখেছি, স্পষ্ট মনে আছে। কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে দুটি দর্শনীয় বস্তু ভারতবিখ্যাত। এক. উদ্যানের প্রায় মাঝখানে চার একর জায়গা বিস্তৃত একটি রাজ বটগাছ, যার মূল কাণ্ডটি ১৯২৫ সালেই মরে যায়। মূল কাণ্ডটির উচ্চতা ছিল ৪৫ ফুট। সুতরাং এ কথা সহজেই অনুমেয়, কী বিশাল এই বটবৃক্ষ! এই বৃক্ষ দেখে, বস্তুতপক্ষে মনে ভয়ের সঞ্চার হয়। প্রথমবার যখন ওই উদ্যানে যাই আমি, এই বৃক্ষের প্রায় অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলাম। সূর্য তখন মধ্যগগনে, কিন্তু ভেতরটা ছিল অন্ধকার। দুই. কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে একটি পদ্মপুকুর রয়েছে। এখানে বিশাল থালার মতো সব পদ্মফুলের পাতা ভেসে থাকে। ফুলের আকারও বিশাল। ওই পাতাগুলোর ওপরে দিব্যি ব্যাঙেরা খেলা করে। একবার কোনো এক দর্শনার্থী তার কোলের ছোট শিশুটিকে ওই রকম একটি পাতার থালার ওপরে শুইয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পাতাটি শিশুটির ভারে ডুবে যায়নি। এই উদ্যানে হাজার হাজার মানুষ আসে, বিশেষ করে সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে। তাদের বেশিরভাগকেই আমি দেখেছি অতি আগ্রহ নিয়ে বৃক্ষ এবং বিভিন্ন গাছগাছালি মনোযোগ দিয়ে দেখতে।
প্রসঙ্গত, আমি আরও একটি ছোট উদ্ভিদ উদ্যানের উল্লেখ করতে চাই এখানে। সিঙ্গাপুরের এই বাগানটি আমার অত্যন্ত প্রিয়। কোনো কাজে সিঙ্গাপুরে গেলে অন্ততপক্ষে একবার সেখানে আমি যাই। ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যে দেয়াল সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে প্রদর্শিত সব বস্তু দেখে আবার শুরু জায়গায় ফিরে আসা যায় এই বাগানে। কিন্তু কী সুচারুভাবে রচিত হয়েছে এই উদ্যান! এখানে প্রাগৈতিহাসিক ফসিল বৃক্ষ থেকে আরম্ভ করে একেবারে সম্প্রতি আবিষ্কৃত গাছও প্রদর্শিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিটি গাছ চেনা-জানার জন্য তার বৃত্তান্ত সামনেই লেখা রয়েছে। এই বাগানেও আমি দেখেছি অজস্র মানুষের আনাগোনা, এমনকি বাচ্চাদেরও। তারা আসছে, সময় নিয়ে গাছগুলোকে দেখছে। তারপর গেটের কাছে রেস্তোরাঁয় বসে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছে যার যার গন্তব্যে।
পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনটি অতি সুন্দর। এসব বাগান দেখে মন ভরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। মাঝে মধ্যে আমার মাঝে ক্ষ্যাপানি দেখা দেয়। তখন আমি কোনো সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আমাদের ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত বোটানিক্যাল গার্ডেনে চলে যাই। আগে, যখন আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু ড. নওয়াজেশ আহমেদ বেঁচে ছিলেন, তার সঙ্গী হতাম আমি। এখন একাই সুযোগ পেলে যাই ওই বাগানে। মনটা বড় খারাপ হয়ে যায়। এখনও অনেক বৃক্ষ আছে এই উদ্যানে, যা দেখতে মানুষ ভিড় করে আসতে পারে। জানতে চাইতে পারে ওই সব বৃক্ষের পরিচয়। কিন্তু সে পথ মাড়ায় না আমাদের মানুষেরা। তারা বনভোজনে প্রয়াসী। বনের চেয়ে ভোজনেই তাদের অধিক আগ্রহ। ধুমধাড়াক্কা করে হাজির হয় ওই উদ্যানে। তারপর বৃক্ষশোভিত, পুষ্পরাজি অলঙ্কৃৃত, নানা পাখির কাকলি-কূজনে মুখরিত ওই উদ্যানের শোভাকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে নিজেদের আনন্দ আহরণ করে যার যার গন্তব্যে চলে যায় তারা। অনেক প্রেমিক যুগলকেও দেখা যায় এখানে। তারা প্রেম করতেই আসে; গাছ দেখতে না। আমি ভাবি, প্রেম করলে কি মেধার বিষয়গুলো ঠোঙায় ভরে বাড়িতে রেখে আসতে হয়? বরং দুই সঙ্গী যদি এসব নৈসর্গিক বিষয়ে সমান আগ্রহী হয়, তাহলে তাদের উভয়েরই সাহচর্যের আনন্দ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের আজকের তরুণরা এই ধরনের সূক্ষ্ম রোমান্টিসিজম ছেড়ে কেবল আপাতরম্যে বিচরণ করায় আগ্রহী। কী হবে জেনে যে, বসন্তের ফুল কৃষ্ণচূড়া নয়। আমাদের বসন্তকালে ফোটে পলাশ, শিমুল এবং মাদার। কৃষ্ণচূড়া গ্রীষ্মের ফুল। কিন্তু বসন্ত উৎসব কিংবা শহীদ দিবস এলেই আমরা অবলীলায় কৃষ্ণচূড়াকে শহীদের রক্তের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের বোটানিক্যাল গার্ডেনটি আজকাল সুরক্ষিতও নয়। বিভিন্ন জায়গায় এর প্রাচীর ভেঙে পড়েছে। সেখান দিয়ে অবলীলায় মানুষ প্রবেশ করছে উদ্যানে। এরা অনেক সময় ফুল ছিঁড়ে, গাছের ডাল ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে। রাতে যদি দুর্লভ সব গাছ কেটে সরিয়েও নেওয়া হয়, তাহলেও কারও মাথাব্যথা থাকবে বলে মনে হয় না।
কেবল যে উদ্ভিদ উদ্যানেই এই ধরনের অরাজক ব্যবস্থা চলছে, তা নয়। আমার কেন যেন ধারণা, আমাদের আজকের বেশিরভাগ তরুণের শিক্ষা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। তারা প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য কিংবা তার নন্দনতত্ত্ব সম্বন্ধে আদৌ আগ্রহী নয় এখন। হায়-হুলস্থূল করে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলেই হলো। আমার মনে আছে, একবার আমি এবং প্রয়াত নওয়াজেশ আহমেদ পাহাড়পুরের স্তূপ দেখতে গিয়েছিলাম, আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে। সেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রছাত্রী এসেছিল বনভোজনে। তাদের মধ্যে দু'জন যুবক ওই ক্ষুদ্রায়তন পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় উঠে উৎকট শব্দে বোম্বাইয়া গান বাজিয়ে তার সঙ্গে কোমর দুলিয়ে নাচছিল। স্তূপের ওপরের গাঁথনিতে সেই পুরনো দিনের ইট একটা-দুটো করে খসে পড়ছিল এই উদ্দামতায়। বড় দুঃখ পেয়েছিলাম। আমি এবং নওয়াজেশ ভাই তৎক্ষণাৎ জয়পুরহাটের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তার দফতরে গিয়ে এই অরাজকতার খবর দিয়েছিলাম তাকে। তিনি কথা দিয়েছিলেন যে, ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এরপরে আর ওখানে যাইনি। আশা করি, আমাদের বড় গর্বের ধন পাহাড়পুরের স্তূপ এখনও অক্ষত আছে।
এই যে তরুণ মানসে সত্যিকারের মূল্যবোধের সঞ্চার, এইটি বোধ হয় শুরু হতে হয় নিজ পরিবার থেকে এবং আমি মনে করি, সময় এসেছে আমাদের সন্তানদের এ বিষয়ে সচেতন করে তোলার। না হলে একটি অর্বাচীন, অশিক্ষিত এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের পঙ্কিল আবর্তে ডুবে যাব আমরা সবাই।

আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.