কপিরাইট লঙ্ঘন প্রসঙ্গে by মুহম্মদ নূরুল হুদা

ভাষার মাস একুশে ফেব্রুয়ারি আসছে। দেদার বই বেরোবে, লঙ্ঘিত হবে দেদার কপিরাইটও। বাংলাদেশে প্রকাশনা ছাড়াও সঙ্গীত, কম্পিউটার, চিত্রকর্মসহ নানা ক্ষেত্রে এই লঙ্ঘন চলছে। তবে সরকারি-বেসরকারি তত্পররতাও শুরু হয়েছে এর প্রতিবিধানের জন্য। সম্প্রতি একাধিক টাস্কফোর্স অভিযান শুরু করেছে। স্রষ্টা ও নির্মাতারা সংঘবদ্ধ হচ্ছেন।

কপিরাইট আইনের ত্রয়োদশ অধ্যায়ে ৭১, ৭২, ৭৩ ও ৭৪ নং ধারায় অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা আছে। কোনো সৃষ্টিকর্মের বৈধ মালিক বা কপিরাইট রেজিস্ট্রার (যেক্ষেত্রে মালিক অশনাক্ত) কর্তৃক ‘প্রদত্ত লাইসেন্স ছাড়া বা অনুরূপভাবে প্রদত্ত লাইসেন্সের শর্ত বা এই আইনের অধীন কোনো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আরোপিত কোনো শর্ত লঙ্ঘনপূর্বক’ কোনো ব্যবসায়ী, প্রকাশক, বিক্রেতা, আমদানিকারক, প্রযোজক, রেকর্ড প্রস্তুতকারক, ফটোকপিকারক, সম্প্রচারক, কনটেম্লট প্রোভাইডার, মোবাইল ফোন কোম্পানি, চলচ্চিত্রকার, অনুবাদক, রূপান্তরকারী, উদ্ভাবক, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, নির্মাতা, সব পর্যায়ের ব্যবহারকারী ও অন্য যে কেউ বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে যা কিছু করবে তা-ই কপিরাইট লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে। বাণিজ্যিক লাভালাভের উদ্দেশ্য ছাড়া কেবল অধ্যয়ন, গবেষণা, চর্চা, উদ্ভাবন, জনস্বার্থে সংবাদপত্র বা অন্য মিডিয়ায় প্রচার, বিচারকার্য, জাতীয় সংসদের কার্যসম্পাদন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সার্টিফায়েড কপি প্রদান, জনসমক্ষে কোনো কর্মের যুক্তিসঙ্গত উদ্ধৃতি, শিক্ষামূলক কাজের জন্য আংশিক উদ্ধৃতি বা সংক্ষেপায়ন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ইত্যাকার অব্যবসায়িক ও অলাভজনক কাজ সাধারণত কপিরাইট লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে না। এ ধরনের ব্যবহারে প্রণেতার বিশেষ স্বত্ব স্বীকার করা বিধেয়। আইন না জেনেও কেউ কপিরাইট লঙ্ঘন করে থাকলে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। প্রণেতা বা কপিরাইটের বৈধ স্বত্বাধিকারী দেওয়ানি প্রতিকার চেয়ে আদালতে মামলা রুজু করতে পারেন। তারও আগে তিনি কপিরাইট বোর্ডের কাছে আবেদন করতে পারেন। এ ধরনের আবেদন বা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধ শনাক্তকরণ ও আইনানুগ শাস্তি প্রদান করা যেতে পারে। আবার গোপন ও বিশ্বস্ত সংবাদের সূত্র ধরে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ লঙ্ঘনকার্য শনাক্ত করার পর লঙ্ঘিত মালামাল জব্দ করে আইনানুগ কর্তৃপক্ষের কাছে সোপর্দ করতে পারে। সরকার কর্তক গঠিত টাস্কফোর্সও কাজটি করতে পারে। পঞ্চদশ অধ্যায়ে ৮২ থেকে ৯৩ পর্যন্ত বিভিন্ন ধারায় অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য আছে। ২০০৫ সালের সংশোধনও এক্ষেত্রে যুক্ত করা অত্যাবশ্যক। ৮২ নং ধারামতে, যদি কেউ চলচ্চিত্র ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রের কপিরাইট ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করেন বা লঙ্ঘন করতে সাহায্য করেন, ‘তিনি অনূর্ধ্ব চার বছর কিন্তু অন্যূন ছয় মাস মেয়াদের কারাদণ্ড এবং অনূর্ধ্ব দুই লাখ টাকা কিন্তু অন্যূন পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয়’ হবেন। তবে আদালতে যদি প্রমাণ করা যায় যে, লঙ্ঘনটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হয়নি, তাহলে আদালত শাস্তির পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারেন। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে জেল ও অর্থদণ্ড অপেক্ষাকৃত বেশি। এক্ষেত্রে এক বছর থেকে পাঁচ বছর জেল ও এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড প্রদেয়, তদুপরি শাস্তি শিথিল করার কোনো অবকাশ নেই। ৮২ নং ধারায় ‘দ্বিতীয় বা পরবর্তী অপরাধের বর্ধিত শাস্তি’ বর্ণিত। প্রথমবার অপরাধ করে শাস্তিভোগের পর কেউ যদি আবার অপরাধ করে তাহলে সেই ব্যক্তি ছয় মাস থেকে তিন বছর কারাদণ্ড ও এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৮৪ নং ধারায় কম্পিউটার প্রোগ্রামের লঙ্ঘিত কপি জ্ঞাতসারে ব্যবহারের অপরাধ বর্ণিত হয়েছে। ধারাটির অংশবিশেষ ২০০৫ সালে সংশোধিত হয়েছে। এক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব চার বছরের কারাদণ্ড ও চার লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান আছে। যদি প্রমাণিত হয় যে লঙ্ঘনটি অব্যবসায়িক কারণে ঘটেছে, তাহলে দণ্ড শিথিল করা যেতে পারে। ৮৫ ও ৮৬ নং ধারায় অধিকার লঙ্ঘনকারী প্লেট তৈরি, দখল ও বিলি-বণ্টনের শাস্তি পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড ও দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। ৮৭ নং ধারায় রেজিস্টারে মিথ্যা অন্তর্ভুক্তি, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান ইত্যাদির শাস্তি বর্ণিত হয়েছে অনূর্ধ্ব দুই বছর কারাবাস ও দশ হাজার টাকা জরিমানা। ৮৮ নং ধারায় ‘প্রতারিত বা প্রভাবিত করিবার উদ্দেশ্যে মিথ্যা বিবৃতি প্রদান’ সম্পর্কিত শাস্তি অনূর্ধ্ব দুই বছর কারাবাস ও পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা। ৮৯ নং ধারায় ‘প্রণেতার মিথ্যা কর্তৃত্ব আরোপ’-এর শাস্তি অনূর্ধ্ব দুই বছর কারাবাস ও পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা। এ ধারাটি লেখক, প্রণেতা, সুরকার, গীতিকার, পারফরমার, চিত্রকর, কম্পিউটর নির্মাতা, চলচ্চিত্রকার প্রমুখের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। ৯০ ধারায় আইনের ৭১ ধারা লঙ্ঘনপূর্বক রেকর্ড বা ভিডিও চিত্র তৈরির শাস্তি অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদণ্ড ও তিন লাখ টাকা জরিমানা। ৯১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানির অপরাধের ক্ষেত্রে কোম্পানির দায়িত্বে নিয়োজিত ও কোম্পানির কাছে দায়ী সব ব্যক্তি দোষী বিবেচিত হবেন। তবে তদন্ত শেষে নির্দোষ ব্যক্তি অব্যাহতি পেতে পারেন। ‘কোম্পানি’ বলতে কোনো বিধিবদ্ধ সংস্থা বা অন্য কোনো সমিতি বোঝাবে। ৯২ ধারা অনুযায়ী দায়রা জজ আদালত অপেক্ষা নিম্নতর কোনো আদালত বর্ণিত অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণ করবে না। ৯৩ ধারামতে সাব-ইন্সপেক্টরের নিম্নে নয় এমন যে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই লঙ্ঘিত অনুলিপি জব্দ করে যত দ্রুত সম্ভব একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থাপন করবেন। নির্বাহী আদেশে গঠিত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্সকেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া যুক্তিযুক্ত। এই উদ্যোগ সফল হলে আমরা একটি সৃষ্টিশীল ও সম্মানজনক জাতিতে পরিণত হব।
লেখক : কবি, প্রফেসর; সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব ও বাংলাদেশ রাইটার্স কপিরাইট সোসাইটি

No comments

Powered by Blogger.