প্রকৃতির বৈরিতা বেড়েই চলেছে by প্রকৌশলী এসএম ফজলে আলী

আজ সারা বিশ্বে হাহাকার উঠেছে প্রকৃতির জন্য। এ ধরার বুকে মানুষ নামের প্রাণীটি বেঁচে থাকবে কিনা। তবে এর জন্য প্রাণী নিজে কম দায়ী নয়। মানুষ নিজেই তার কর্মকাণ্ডে এ ধ্বংস ডেকে আনছে। কিছু ভোগবাদী মানুষের অর্থের লোলুপতার জন্য আজ এ হাল। বিগত পঞ্চাশের দশকে দেখেছি প্রকৃতি মানুষের বান্ধব হিসেবে কাজ করেছে।

তখন পৌষের শেষে মাঘের প্রথমে পশলা বৃষ্টি হতো। তাতে রবিশস্যের উত্পাদন ভালো হতো, আবার বর্ষাকালে বান-বৃষ্টি ও বন্যা স্বাভাবিক ছিল। আমন ধানের ফুল আসার আগ মুহূর্তে চাষের জন্য পানির যে প্রয়োজন হতো তখন পরিমিত বৃষ্টি হতো। চাষীদের এখনকার মতো পানি সেচের প্রয়োজন হতো না। স্বাভাবিক যে বন্যা হতো তাতে প্লাবনের কারণে প্রচুর পলিমাটি পড়ায় জমির উর্বরতা বাড়ত। আর বর্তমানের হাল হচ্ছে, যখন বৃষ্টির প্রয়োজন নেই তখন মুষলধারে বৃষ্টি হয়। যখন বৃষ্টির পানির প্রয়োজন তখন ধান ও অন্যান্য ফসলের জমি ফেটে চৌচির। বন্যায় ফসল নষ্ট করে। সাইক্লোন, সিডর, আইলা ইত্যাদি এসে মানুষের জান-মালসহ সর্বস্ব ধ্বংস করে দিয়ে যায়। এখন মরু অঞ্চলেও বৃষ্টিতে বন্যা হয়। এবার হজ মৌসুমে সৌদি আরবে বৃষ্টির পানিতে প্রবল বন্যায় শতাধিক লোক মারা গেছে। আরব আমিরাতেও কিছুদিন আগে অস্বাভাবিক বৃষ্টিতে বন্যা হয়েছে। যারা ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ও ডিসকভারি চ্যানেল দেখেন তারা লক্ষ্য করেছেন, মেরু অঞ্চলের বরফের পাহাড়গুলো কীভাবে গলে যাচ্ছে। হিমালয়ের বরফও অস্বাভাবিকভাবে গলে যাচ্ছে।
এর মূল কারণ বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা। এ উষ্ণতা বৃদ্ধির মূল কারণ হলো ফসিল তেল ও কয়লা অতিরিক্ত পোড়ানো। ধনী দেশগুলো তাদের ধন ও ভোগের চাহিদা বাড়াবার জন্যই তেলের ব্যবহার লাগামছাড়া বাড়িয়ে যাচ্ছে। তার ফলে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস (Co2) বাতাসে ছড়াচ্ছে তাতেই আবহাওয়ার উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে প্রকৃতি দিন দিন বৈরী হয়ে যাচ্ছে। ধনী দেশগুলোর লাগামছাড়া তেল ব্যবহারে প্রকৃতিতে যে মারাত্মক বৈরিতার সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রতিবাদে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টসহ মন্ত্রিপরিষদ সাগরের তলায় এক প্রতিবাদ সভা করেন। অনুরূপভাবে হিমালয়দুহিতা নেপালের সরকার হিমালয় পর্বতের আঠার হাজার ফুট উচ্চতায় গিয়ে মন্ত্রিপরিষদের সভা করে তথাকথিত ভোগবাদীদের সঠিক জবাব দিয়েছেন। সমুদ্রের পানির উচ্চতা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে অচিরেই মালদ্বীপ নামের দেশটি সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। আর হিমালয়ের বরফ গলে শেষ হয়ে গেলে নেপালসহ বাংলাদেশ ও ভারত পানিশূন্য হয়ে মরুকরণে চলে যাবে। তাই উক্ত প্রতিবাদ দুটোকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মনে করি। জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ীদের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় প্রতিবাদ আজ পর্যন্ত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। প্রতিবাদের ঝড় ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও হচ্ছে। তা মামুলি। আর তাতে কোনো সরকার তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।
এরই মধ্যে জলবায়ু বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন বেশ কয়েকটি হয়ে গেছে। রিও-ডিজেনিরিও, হেলসিংকি, কিয়োটো ও দোহা সম্মেলনের পর এখন কোপেনহেগেন সম্মেলন হয়ে গেল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কিয়োটো চুক্তিতে যেসব কথা বলা হয়েছে, তা কেউ মেনে চলছে না। যে হারে উষ্ণতা বাড়ছে আগামী ৫০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে অবস্থা ভয়াবহ হবে। কিয়োটো প্রটোকল অনুযায়ী ২০০৫ সালের পর ঊষ্ণতা কমাবার কথা থাকলেও ১৯৭০ সালকে ভিত্তি ধরলে আজ উষ্ণতা প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ বেড়ে গেছে। এতে কৃষি উত্পাদন কমে যাচ্ছে। বিশ্বে খাদ্য সঙ্কট শুরু হয়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, শীত-গ্রীষ্মের তারতম্যের কারণে কৃষির উত্পাদন শতকরা ৫০ ভাগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি জমি শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ কমে যাবে। বর্তমানেই প্রায় ৬০ ভাগ লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে। তখনকার অবস্থা যে কী ভয়াবহ হবে তা কল্পনাও করা যায় না। উষ্ণতার কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র এলাকা ঘিরে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলমগ্ন হবে। প্রায় ৩ কোটি লোক বাস্তুহারা হবে। লবণাক্ত পানির জন্য কৃষির আবাদ ওই এলাকায় ধ্বংস হয়ে যাবে। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে বাস্তুচ্যুত লোকের আবাসন হবে না। আগামী বছরগুলোতে দেশে বন্যার তীব্রতা বাড়বে। সঙ্গে সঙ্গে অসময়ে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) উদ্যোগে “Action of Combat Global Climate Change & Bangladesh Perspective” সেমিনারে এটা বলা হয়। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন International Institute for Environment and Development, London-এর পরিচালক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ড. সলিমুল হক। ধনী দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণহীন জ্বালানি ব্যবহারেই এই ক্লাইমেট পরিবর্তন হচ্ছে। এ ব্যাপারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কোনো প্রতিরোধের ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, ২০২০ সাল নাগাদ বৃষ্টিপাত ১০ থেকে ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পাবে এবং ২০২৫ সালের দিকে এটা ১৫ থেকে ২৩ ভাগ বেড়ে যাবে। এ বৃষ্টিপাত কৃষির সহায়ক না হয়ে বরং হুমকি হিসেবে দেখা দেবে। ওদিকে নাসার উপগ্রহ ডাটায় ধরা পড়েছে, ২০০৮ সালে গ্রিনল্যান্ডে বরফ গলার হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডল ও পৃথিবীর মহাকর্ষের কারণে মহাসাগরে এর প্রভাবে বরফ দ্রুত গলছে। গ্রিনল্যান্ডের আইস শিটের পদার্থের পরিবর্তনে বছরে সেখানে ২৩৯ বর্গকিলোমিটার বরফ গলে যাচ্ছে। আগের তুলনায় এটা ৩ গুণ বেশি।
ওদিকে বিশেষজ্ঞরা হুশিয়ার করে দিয়েছেন যে, আগামী ৫০ বছরে বিশ্বে সুপেয় পানির মারাত্মক সঙ্কট দেখা দেবে। তখন বিশ্বের লোকসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৯৫০ কোটি। বর্তমানেই প্রতি ৩ জন লোকের ১ জন পানি পাচ্ছে না। কোনো কোনো দেশ অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করছে, আবার কোনো দেশ বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলো এর বড় উদাহরণ। ৭০০ পানি বিশেষজ্ঞের ৫ বছরের গবেষণায় এ তথ্য ওঠে আসে। আজকে জোরেসোরে বলা হচ্ছে যে, বিশ্বে তৃতীয় মহাযুদ্ধ হলে তা পানির বিরোধ নিয়েই শুরু হবে। জাতিসংঘের আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় যত লোক মারা যায় তার শতকরা ৬০ ভাগই বন্যা ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে। বছরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫০ কোটি লোক।
বর্তমানে বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসের (Co2 ও অন্যান্য) ঘনত্ব প্রতি মিলিয়নে প্রায় ৩৮০ ভাগ রয়েছে। এটা কোনোক্রমেই ৪৫০ ভাগ অতিক্রম করতে দেয়া যাবে না। কোনো দেশের হঠকারিতায় এটা অতিক্রম করলে তখন পৃথিবী মানুষ বাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এটা সহনীয় মাত্রার মধ্যে রাখতে গেলে ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত গ্রিনহাউস গ্যাস স্থিতিশীল রাখতে হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ তা কমপক্ষে শতকরা ৬০ ভাগ কমাতে হবে। Inter Government Panel on Climate Bench-এর প্রধান রাজেন্দ্র পাচৌরি হুশিয়ার করে বলেছেন, এটা মেনে চলতে হবে।
বিশ্বের জলবায়ুর যে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে তা প্রতিরোধ করার জন্য যে চেষ্টা হওয়া উচিত তা এখনও লক্ষ্য করা যায় না। বর্তমান বিশ্বে ফসিল তেল ব্যবহারের পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। তার শতকরা ৮০ ভাগই ব্যবহার করে কয়েকটি ধনী দেশ। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা লাগামছাড়া ব্যবহার করছে। ওদিকে নব্য শক্তিধর চীনও প্রচুর তেল-কয়লা পুড়িয়ে তার প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে বিশ্বের এক নাম্বার অবস্থানে আছে। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমানে একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিশ্বের জ্বালানি তেলের ৪০ শতাংশ ব্যবহার করছে। তাই চীনও এ মুহূর্তে জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমাতে নারাজ, তাতে তার জাতীয় প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। তবে একথা সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। আগে মানুষ বাঁচাতে হবে, তারপর উন্নয়ন।
কোপেনহেগেনে জলবায়ুর ওপর জাতিসংঘের উদ্যোগে যে আন্তর্জাতিক সমাবেশ হলো তাতে ১৯৩টি দেশের নেতা, বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবাদী, সমাজকর্মীর উপস্থিতিতে এক মহাযজ্ঞ। কিন্তু আভাস-ইঙ্গিতে যা শোনা যাচ্ছে তাতে কাজের কাজ তেমন হয়নি। যাদের জন্য আজ এ জলবায়ুর বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তারা এর দায়দায়িত্ব নিতে তেমন ইচ্ছুক নয়। তারা দায়সারা গোছের গোঁজামিল দিতে চায়। একমাত্র ব্রিটেনকে কিছুটা উদ্যোগী মনে হয়। উন্নত দেশগুলো ২২ বিলিয়ন ডলারের একটি প্যাকেজ গঠন করতে চায়—যা সমস্যা সমাধানের তুলনায় অতি নগণ্য। তাও ওয়াদাকৃত অর্থ সরকারগুলো সঠিক সময় আদৌ দেবে কিনা তা সন্দেহজনক। পূর্বের অভিজ্ঞতা মোটেই আশাপ্রদ নয়।
বর্তমান অবস্থার জন্য দরিদ্র দেশগুলো কোনোভাবেই দায়ী নয়, অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তারাই চরম ভোগান্তিতে পড়ছে। তাই বিশ্বজুড়ে দাবি ওঠছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর যে আর্থিক, কৃষি ও সামাজিক ক্ষতি হচ্ছে তার দায়দায়িত্ব উন্নত দেশগুলোকে নিতে হবে। এটা তাদের নৈতিক দায়িত্ব। এর সঙ্গে আরও জরুরি কাজ হলো এখন থেকে সীমার বাইরে গ্রিনহাউস গ্যাস উদগিরণ যাতে না হয় তার জন্য কঠোর বিধিবিধান মেনে চলা। এটা যে খুব কঠিন কাজ তাও নয়। উন্নত দেশগুলোর ভোগ-বিলাসের গতিতে লাগাম লাগানো দরকার। অনৈতিক উপায়ে পর্বত সমান অর্থ অর্জনের প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। আর ফসিল তেল ও কয়লা পোড়ানোর পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উত্কর্ষ সাধন করতে হবে। সৌর বিদ্যুত্, উইন্ডমিল, জলবিদ্যুত্ ইত্যাদির উত্পাদন বাড়াতে হবে। এগুলো এখন আর পরীক্ষাগারের বিষয় নয়। তবে স্বল্প খরচে এর উত্পাদন কীভাবে বাড়ানো যায় তার জন্য নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বের করা প্রয়োজন। বর্তমানে সারা বিশ্বের মোট জ্বালানি চাহিদার শতকরা ১৬ ভাগ এটমিক এনার্জি পূরণ করছে। এর উত্পাদন আরও বাড়িয়ে দেয়া উচিত এবং প্রতি ইউনিট কস্ট যাতে কম হয় তার জন্য গবেষণার প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো আণবিক মারণাস্ত্র ও প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করতে যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে তার একটা অংশ এই গবেষণার কাজে খরচ করলে অনেক সুন্দর সমাধান বেরিয়ে আসবে। সেদিকে কারও লক্ষ্য নেই। মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশের তেল-গ্যাস দখল করার জন্য তারা পিছপা হচ্ছে না। বুশের ইরাক ও আফগানিস্তান দখলের মূল কারণ এটাই। সন্ত্রাস দমনের নাম করে আজ দেশ দুটোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে তারা। সে সন্ত্রাস দমন না হয়ে আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। ওদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্ররা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার এই যুদ্ধের পেছনে খরচ করে চলেছে। যার জের হিসেবে বিশ্বে আজ মহামন্দা চলছে। অনুত্পাদন খাতে (সমরাস্ত্র) অস্বাভাবিক খরচ করায় বিশ্বের অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসে। যুক্তরাষ্ট্র যদি বাস্তবে সন্ত্রাস দমন করতে চাইত তাহলে বিশ্বে যাতে গণতন্ত্র সুসংহত হয় ও সামাজিক বৈষম্য দূর হয় তার জন্য কাজ করত। কিন্তু সে উদ্যোগ না নিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণের নামে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার কায়দাকানুন করে যাচ্ছে। বাণিজ্য সম্প্রসারণের নামে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বেনিয়ার ভূমিকায় নামিয়ে দিয়েছে। এই বেনিয়ারাই আজ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে মূলত দায়ী।
জলবায়ুর পরিবর্তনে কৃষি খাতের যে মারাত্মক ক্ষতি হবে তার চিত্রটি নিম্নরূপ : ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের কৃষি উত্পাদন ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জিডিপির ২৮ শতাংশ আসে কৃষি খাত থেকে। খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, রাস্তাঘাট, হাটবাজার, বন ধ্বংস, আবাসন ইত্যাদির কারণে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে অথচ লোকসংখ্যা বেড়েই চলেছে। জলাশয়সহ নদীগুলো ভরাট হওয়ার কারণে জীব বৈচিত্র্যের চরম ক্ষতি হচ্ছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে পৃথিবী ক্রমান্বয়ে উষ্ণ হচ্ছে। শিল্প বিপ্লবের আগে হাজার বছর ধরে Co2-এর ঘনত্ব ছিল ১০ থেকে ২৪০ পিপিএম (PPM) । এখন তা ৪৮০ পিপিএম ছাড়িয়ে গেছে। বিগত ৪ লাখ ২০ হাজার বছরে এটা দেখা যায়নি।
১৯৫০ সালের পর থেকে উত্তর গোলার্ধে বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে ভাসমান বরফের ১০ থেকে ১৫ ভাগ গলে গেছে এবং ওই সময়ের পর থেকে পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়েই চলেছে। বিশ শতকে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়েছে ০.১ মিলিমিটার। Co2 নির্গমন একুশ শতকের শেষে দাঁড়াবে ৫৪০ থেকে ৯৭০ পিপিএম এবং বৈশ্বিক গড় উষ্ণতা বাড়বে ১.৪হ্ন থেকে ৫.৮০হ্ন সেন্টিগ্রেড। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে পারে ০.৮৮ মিটার পর্যন্ত। Co2 (কার্বন-ডাই-অক্সাইড) প্রতিরোধের সহজ উপায় হলো নিবিড় বনায়ন। সারা বিশ্বে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ ভূমিতে বনায়ন দরকার। পৃথিবীর নির্গত Co2-এর ৬০ শতাংশই বনভূমি শুষে নেয়। বনায়নের অভাবে এখন ৯০ শতাংশ Co2 বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে। আফ্রিকা মহাদেশে বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে বনভূমি আছে মাত্র ১০% (২.৫২ মিলিয়ন হেক্টর)। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ৪ হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে বনায়ন ২০শতাংশ হওয়া অতীব জরুরি। অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বনায়নে সব দেশের গুরুত্ব দেয়া উচিত।
উপমহাদেশসহ বাংলাদেশের চিত্রটা আলোচনা করা যাক। বর্তমান ধারায় জলবায়ুর পরিবর্তনে আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদী শুকিয়ে যাবে। কারণ হিমালয় থেকে বরফ গলা পানি আর আসবে না। একটি আন্তর্জাতিক স্টাডি গ্রুপ নেপালে পর্যবেক্ষণ করে এ অভিমত ব্যক্ত করেন। গ্রুপের নেতা ফজলে রশিদ বলেন, যে হারে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে হিমালয়ের বরফ গলছে অস্বাভাবিকভাবে। ফলে আর নদীগুলোতে সেচের পানি পাওয়া যাবে না। চীন-ভারত হিমালয়ের পানি নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। হিমালয়ের চূড়ার বরফগলা পানির ওপর এই অঞ্চলের গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার ১৩০ কোটি মানুষের জীবিকা নির্ভর করছে। পানি সমস্যার সমাধান না হলে দক্ষিণ এশিয়ায় তীব্র রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দেবে। পানি নিয়ে যুদ্ধও হতে পারে। ব্রহ্মপুত্রের পানিতে চীন ও সিন্ধু নদের পানিতে পাকিস্তান বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছে। পানির অভাবে এ অঞ্চলের মানুষের মাইগ্রেট করার আশঙ্কা রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বে যে খাদ্য উত্পাদন কমে যাচ্ছে তার একটি চিত্র পাওয়া যায় জাতিসংঘের এফএও’র প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বে অনাহারী মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটির ঊর্ধ্বে। বিশ্বে প্রাচুর্য ও সম্পদ বাড়লেও অনাহারী কমছে না। আর প্রাচুর্য আসছে তেল পুড়ে। অনাহার প্রবৃদ্ধি খর্ব করে সামাজিক অস্থিতিশীলতা বাড়ায়। ২০০৭ সালে অনাহারী ছিল ৭৫ কোটি। আর ২০০৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১২০ কোটিতে। সে সময় খাদ্যশস্যের মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হয়। অনাহারে প্রতি ৬ সেকেন্ডে বিশ্বে একটি করে শিশু মারা যায়—বছরে যা ৬০ লাখে দাঁড়ায়। শৈশবে অপুষ্টিতে ভোগা একজন লোক জীবনে ৫ শতাংশ থেকে ১০% উপার্জন কম করে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যে কৃষি উত্পাদন কমে যাচ্ছে তা প্রতিরোধে FAO ৪৪.০ বিলিয়ন ডলারের দাবি করলে উন্নত বিশ্ব তাতে সম্মত হয়নি। তারা ২০২৫ সালে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রয়োজনীয় অর্থ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাকে প্রতিরোধ না করতে পারলে ২০২৫ সালে পৃথিবীর শতকরা ৭০ ভাগ ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হবে বলে জাতিসংঘের মরুকরণ রোধের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী সম্পাদক লাক জিনা কাজো ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০০৯, আর্জেন্টিনার রাজধানীতে মরুকরণরোধ কনভেনশনের ৯ম অধিবেশনে বলেন। তিনি বলেন, এর কোনো সমাধান না করতে পারলে বিশ্ব পরিস্থিতি মারাত্মক হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, খরা এরই মধ্যে পৃথিবীর প্রায় ৪১ শতাংশ ভূভাগে আঘাত হেনেছে। ১৯৯০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আবহাওয়ার অবনতি ঘটেছে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। তিনি আরও বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা ছাড়া বৈশ্বিক নিরাপত্তা সম্ভব নয়। মরুকরণ ঠেকাবার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বনায়ন কার্যক্রমে দ্রুত ও বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে। বর্?

No comments

Powered by Blogger.