সংস্কৃতি চর্চা-সোনারগাঁর কলঙ্কদাগ মুছে ফেলতে হবে by কামাল লোহানী

বাংলার মানুষকে যারা ভালোবাসেন তারা প্রতিভা প্রদীপ্ত পরিশ্রমী প্রয়াসে যে সোনারগাঁ জাদুঘর নতুন নতুন ইতিহাসজুড়ে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার সুস্থ প্রয়াসে সমুজ্জ্বল, তাকে সহৃদয় সহযোগিতা দিয়ে অসৎ প্রয়াসকে দূর করবেন_ এটা আমাদের সবারই কাম্য।


তবে আমাদের ধারণা, সোনারগাঁ জাদুঘরের মতো পত্র-পল্লবে পুষ্পশোভিত হয়ে জনগণের উপস্থিতিতে মুখর এই সুসজ্জিত 'ইতিহাস বলা' চত্বর এবং স্থাপিত সব প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনাকে সুরক্ষার জন্যও সরকারকে নজর দিতে হবে


আদতেই বঙ্গ সংস্কৃতির লালনক্ষেত্র, প্রাচীনকালের বাংলার রাজধানী ঐতিহাসিক সোনারগাঁ এক সুবর্ণগ্রামের রূপ ধারণ করেছে। ঐতিহ্যমণ্ডিত এ গ্রামে নেই রাজকীয় জৌলুস, কিন্তু লোকজ শিল্প-সংস্কৃতির পাদপীঠে পরিণত হয়েছে। এককালের বাংলার রাজধানী যখন প্রবলভাবে মুখরিত মানুষের ভিড়ে, অনুষ্ঠিত হচ্ছে লোকজ উৎসব, আর ভাষা উৎসবের উদ্বোধন হবে যে প্রিয় মুহূর্তে, সেই সময়ই কলঙ্কের কালিমা লেপন করে দিল মাত্র ক'জন দুষ্কৃতকারী। সোনারগাঁর অনুপম পরিবেশে চলছে মাসব্যাপী লোকজমেলা, দোকান বসেছে। সে সঙ্গে এবারে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ বঙ্গ সংস্কৃতির আদি অভিনয়শিল্প 'যাত্রাপালা'র প্যান্ডেল ও অভিনয়ের অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু জাদুঘরের যাত্রা প্যান্ডেলে আগুন গোটা পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছে, আর যাত্রাশিল্পী দল ও মালিককে নিঃস্ব-অসহায় অবস্থায় ফেলে যন্ত্রণাদগ্ধ করছে। পরপর ২৪ দিন যাত্রাভিনয় সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে এবং ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে যাত্রা বন্ধ থাকার সুযোগ নিয়ে কেন এই ঘৃণ্য অপকর্ম সাধন করা হলো_ প্রশাসনকে তদন্ত করে বের করতে হবে। এর ভিডিও প্রশাসন ও পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দও ভিডিও ক্লিপটি দেখেছেন। এ থেকে যাত্রা প্যান্ডেলে হামলাকারী ২০-২৫ জনের দলটিকে শনাক্ত করা সহজ হবে। লাঠি, ব্যানার নিয়ে যারা ভেতরে ঢুকেছিল তাদের কি জাদুঘরের নিরাপত্তা প্রহরী বাধা দেয়নি? ভিডিওতে দেখা যায়, পাশেই দু'জন পুলিশ নিশ্চুপ বসে ছিল। গেট দিয়ে ঢুকে বেশ অনেকটা দূরত্বে যাত্রা প্যান্ডেল পর্যন্ত স্লোগান দিতে দিতে ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন লাগিয়ে জাদুঘরের দু'নম্বর গেট দিয়ে হামলাকারীরা বেরিয়ে যায়।
লোকের মুখে শুনেছি, এ নাকি জিঘাংসারই পরিণতি। কতিপয় ছাত্র-যুবক যাত্রাদলের কাছে নজরানা দাবি করে না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ-ত্রুক্রদ্ধ হয়ে যাত্রাবিরোধী লোক নিয়ে দল পাকিয়ে প্যান্ডেলে আগুন দেয়। বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের পাকড়াও করে বিচার করতেই হবে। সে সঙ্গে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাও তদন্তে বিবেচনায় নিতে হবে। পুলিশ কাদের সেবা করার জন্য মোতায়েন ছিল?
এ দিনটি ছিল মাসব্যাপী লোকমেলার শেষ সপ্তাহব্যাপী 'ভাষা উৎসব ২০১২'র উদ্বোধনী দিন। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন এমপি ভাষা উৎসবের উদ্বোধন করেছেন। মূল মঞ্চে আয়োজন ছিল আলোচনা সভার, সে সঙ্গে ভাষার গান, রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি চিত্রাঙ্গদার নাট্যরূপ উপস্থাপনা। এর মধ্যে গান ও নাটক অংশকে অকস্মাৎ বাদ দেওয়া হলো কেন, সেটা বুঝলাম না। তবে কি হাতেগোনা ক'জন দুষ্কৃতকারীর হামলায় ভীত হয়ে এটা বন্ধ করা হলো? যদি হয়ে থাকে তবে যে ভূত শর্ষেতে ঢুকে গেল, তাকে ছাড়াতে কষ্ট হবে। সোনারগাঁ জাদুঘরের বয়সকালে এমন দুঃস্বপ্নের কাল কখনও আসেনি। ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের প্রস্তুতি পর্বেও একটি ঘটনা ঘটেছিল। এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তি বিধান না করলে এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান গত তিন বছরে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা ক্রমশ বিলীন হতে বাধ্য।
সোনারগাঁ পুরনো বাংলার রাজধানী ছিল। এখানের প্রাচীন নিদর্শন নিজ দেশের মানুষকে আকৃষ্ট করে, বিদেশি পর্যটকদেরও টেনে আনে। এমন ধ্বংসাত্মক, বৈরী মনোভাব প্রকাশ পেলে তাদের উৎসাহে ভাটা পড়বে। যে 'অশ্লীলতা'র অভিযোগ তোলা হয়েছে যাত্রার বিরুদ্ধে, তা আজ নয়, পাকিস্তানি আমল থেকেই হচ্ছে। ব্রিটিশরা 'স্বদেশী' আন্দোলনকে ভয় পেয়েছিল বলে মুকুন্দ দাসের যাত্রাভিনয়কে বিধিনিষেধে আটকে দিয়েছিল এবং পাকিস্তান আমলে এই প্রাচীন শিল্পমাধ্যমকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে এর মধ্যে অশ্লীলতা আর বেআবরু নাচ ঢুকিয়েছিল; বিশেষ করে ষাটের দশকে, যখন দেশ বিস্ফোরণোন্মুখ, সেই সময় বঙ্গ সংস্কৃতির এই শাখাটি ছিল তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে সহজেই পেঁৗছে যাওয়ার একটি মাধ্যম। তাকে ধ্বংস করতে পারলে পাকিস্তানিদেরই সফলতা এবং আমদানিকৃত অপসংস্কৃতি এ দেশের সরল প্রাণ মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে বলে শাসকগোষ্ঠীর ধারণা ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধউত্তর এই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে যাত্রার প্রতি কেন বিরূপ মনোভাব? সে হয়তো অশালীন নৃত্য ও উপস্থাপনার হালকা মেজাজের কারণেই। একে দূর করে কোনো সরকারই যাত্রাপালাকে যথার্থ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার কোনো চেষ্টাই করেনি। যখন বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার লোকজ ঐতিহ্যকে এবং মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য অভিনয় মাধ্যমকে যথোপযুক্ত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা, যাত্রার আদি শুদ্ধ রূপ ও চরিত্রে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে, এমনকি একটি চমৎকার নীতিমালা প্রণয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং এর সঙ্গে জড়িত মরণোন্মুখ শিল্পী-কলাকুশলীর যোগ্য সম্মান দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রাকে ঢেলে সাজাবার ও আধুনিক সময়োপযোগী করার নৈতিক দায়িত্ব পালন করার লক্ষ্যে প্রায় পেঁৗছে গেছে, ঠিক এমন একটি সময়ে সোনারগাঁ জাদুঘরের মতো নিষ্কলঙ্ক স্থানে দুর্ঘটনা ঘটানোয় কত বড় যে ক্ষতি হলো, তা অনুধাবন করা যাবে না। এতে যাত্রাদলের ক্ষতি হলো না কেবল, গোটা যাত্রাশিল্পকেই নতুন করে পুরনো অভিযোগের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা দেখা গেল। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে দৃষ্কৃতকারীরা এই কাজটি করেছে, তাদের অবশ্যই অনুতপ্ত হতে হবে। কারণ, এ যে তাদের পূর্বপুরুষের গৌরবকেই কলঙ্কিত করেছে। এর ফলে যাত্রাশিল্পের উন্নয়নে সরকারি যে উদ্যোগ, তা হয়তো বাধাপ্রাপ্ত হবে না; কিন্তু নতুন করে সেই পুরনো কাসুন্দিই ঘাঁটবার চেষ্টা করবে সেই যাত্রাবিরোধী শকুনিরা।
সরকার বিশেষ করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ, যাত্রাকে সত্যিকার অর্থেই জনগণের শিল্প হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য যে পদক্ষেপ এই গণতান্ত্রিক ও তুলনামূলকভাবে সংস্কৃতিমনস্ক সরকার নিয়েছিল, সেটি যথাসম্ভব শিগগিরই সম্পন্ন করে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্যকে বস্তুতই এমন একটি অসত্য ও অমানবিক অভিযোগ থেকে মুক্ত করুন। কারণ, এ অভিযোগ বানোয়াট_ বহুবার বলেছি, লিখেছি। আবারও বলি, এর সঙ্গে যাত্রার নট-নটীরা সংশ্লিষ্ট নয়। বায়নাকারীরাই মূলত এ ধরনের নীতিহীনতাকে প্রশ্রয় দেয়। আর সোনারগাঁ জাদুঘর এত বছর ধরে যে জনগণের শিল্পকে চর্চা, সমৃদ্ধ এবং পরিবেশন ও প্রদর্শন করে আসছে, তাদের তো এমন কুৎসিত আচরণের প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং যারা অশ্লীলতার অভিযোগ দেখিয়ে দোষারোপ করার চেষ্টা করেছেন, তারা কি পাকিস্তানি আমলের নোংরামিরই প্রশ্রয় দেওয়ার কোশেশ করছেন না? কেন সেখান থেকে এই জনপ্রিয় শিল্পকে মুক্তি দিতে পারবেন না?
তাই ঐতিহাসিক সোনারগাঁ প্রাচীন ঐতিহ্যকে তুলে ধরে বাংলার আপামর জনসাধারণের সৃষ্ট শিল্পমাধ্যমকে সাধারণ মানুষের সামনে যথার্থ প্রয়াসে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছিল সোনারগাঁ জাদুঘর, তা সততা ও নির্ভয়ে পালন করার সুযোগ তাদের দিতে হবে। কোনো কল্পিত অভিযোগ কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এমন মহান শিল্প, জনপ্রিয় মাধ্যমকে 'হত্যা' করার ফল কেন সোনারগাঁ নেবে? যে অশ্লীলতার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তা যদি আদৌ সত্য হয় তবে এতদিন ধরে কেন চলল এই যাত্রা? কেন একে বন্ধ করার জন্য জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়নি? এতদিন যাত্রাভিনয় চলার পর হঠাৎ যখন ঈদে মিলাদুন্নবীর জন্য তিন দিন বন্ধ, তখনই কেন এই প্যান্ডেলের ওপর হামলা করা হলো? সাধারণ মানুষ যারা প্রতিনিয়ত এই যাত্রা দেখেছেন, এই যাত্রাকে ঘিরে যে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান, আয়-উপার্জন হচ্ছিল, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সোনারগাঁ এসেছিলেন তাদের মতামত জরিপ করে দেখলে অনুধাবন করা যাবে, এই যাত্রা কীভাবে চলছিল, কী উপস্থাপিত হচ্ছিল। কেন এই পালাভিনয় 'অশ্লীলতা' পরিবেশন হওয়া সত্ত্বেও প্রতিরাতেই অভিনীত হচ্ছিল? খোঁজ করে দেখে দুষ্ট মানুষদের শাস্তি বিধান করতে হবে। কিন্তু ভয়ে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিলে চলবে না। বাংলার মানুষকে যারা ভালোবাসেন তারা প্রতিভা প্রদীপ্ত পরিশ্রমী প্রয়াসে যে সোনারগাঁ জাদুঘর নতুন নতুন ইতিহাসজুড়ে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার সুস্থ প্রয়াসে সমুজ্জ্বল, তাকে সহৃদয় সহযোগিতা দিয়ে অসৎ প্রয়াসকে দূর করবেন_ এটা আমাদের সবারই কাম্য। তবে আমাদের ধারণা, সোনারগাঁ জাদুঘরের মতো পত্র-পল্লবে পুষ্পশোভিত হয়ে জনগণের উপস্থিতিতে মুখর এই সুসজ্জিত 'ইতিহাস বলা' চত্বর এবং স্থাপিত সব প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনাকে সুরক্ষার জন্যও সরকারকে নজর দিতে হবে। এমন দুষ্কৃতকারীর হামলা-হুমকি যেন এই নবযাত্রাকে কলঙ্কিত করতে না পারে তার জন্য প্রবল প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বঙ্গবন্ধুর ঈপ্সিত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার কাজ সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাবে। এখানে কোনো কপটতার প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। এর প্রতিবাদ হতে হবে।
সব সচেতন ও সংস্কৃতিজনের কাছে আমার আবেদন, এমন ঘটনাবলিকে প্রত্যাখ্যান করুন। নিশ্চুপ থাকবেন না, সোচ্চার হোন।

কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.