ফারাক্কার ভূত by শেখ রোকন

ফারাক্কা ব্যারাজের দেড়টি কপাটে সামান্য বৈকল্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অসামান্য প্রতিক্রিয়ার পর কমিউনিস্ট ইশতেহারের প্রথম লাইনের প্যারোডিই মনে আসে_ মমতা ভূত দেখছেন, ফারাক্কার ভূত। জানা যাচ্ছে, ব্যারাজের একটি লক গেট গত বছরের ২৬ জুন এবং আরেকটি ৯ ডিসেম্বর থেকে ভাঙা।
তাতে করে, মুখ্যমন্ত্রীর মুখপাত্র আনন্দবাজারকে বলছেন_ 'ফারাক্কার পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। ব্যারাজের ভাঙা অংশ দিয়ে হু হু করে জল বেরিয়ে পদ্মা নদীতে চলে যাচ্ছে।' মনমোহন সিংকে লেখা চিঠিতে উদ্বিগ্ন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, দুই জলকপাটের কারণে ৮২,৮০১ কিউসেক পানি গচ্চা যাচ্ছে।
রাজনৈতিকভাবে আলোচিত ওই ব্যারাজের কারিগরি দিক খোলাসা করা যাক। স্থাপনাটিতে বাঁধ ও ফিডার ক্যানেল মিলিয়ে মোট ১২০টি লক গেট। তার মাত্র দুটি দিয়ে এ বিপুল জলরাশি বের হয়ে যাচ্ছে! ফারাক্কা পরিদর্শন শেষে রাজ্য সেচ সচিবের প্রতিবেদনেও যেখানে বলা হয়েছে ৪৬ হাজার, নির্ধারিত হিস্যার ৬ হাজার কিউসেক বেশি! এর ওপর যখন শনিবারের আনন্দবাজার শঙ্কা প্রকাশ করে, ফারাক্কার জলকপাট দিয়ে বেশি পানি বয়ে যাওয়ায় মমতা তিস্তার ক্ষেত্রে আরও বাগড়া দেবেন; তখন বুঝতে কষ্ট হয় না যে এই জলঘোলা সদুদ্দেশ্যে নয়। বৃহস্পতিবারের টাইমস অব ইন্ডিয়াও বলেছে, প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের সব সম্ভাবনা গোরস্থানে পাঠানোর পর মমতা ফারাক্কা নিয়ে হুজ্জতে নেমেছেন।
বস্তুত মুখ্যমন্ত্রী মমতা গঙ্গা-তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে যা বলে আসছেন, তাতে করে অভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের আন্তঃসীমান্ত অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে তার ধারণা ইতিমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ। এখন দেখা যাচ্ছে ফারাক্কার ভূত। যদিও ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার খর্ব করে; যদিও কয়েক সপ্তাহের 'পরীক্ষামূলক' পরিচালনার নামে সাড়ে তিন দশক ধরে পানি প্রত্যাহার চলছে; যদিও উজানের গঙ্গায় আরও হাফ ডজন বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মিত হয়েছে; যদিও গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ও এর বাস্তবায়ন নিয়ে আমাদের অসন্তোষ রয়েছে; মিজ ব্যানার্জি এখনও ফারাক্কাকেই পানি ভাগাভাগির মানদণ্ড মনে করছেন।
অথচ এভাবে পানি প্রত্যাহার ভবিষ্যতের ফর্মুলা নয়, ভূতপূর্ব। বিশ্বজুড়েই এখন চলছে অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকারের যুগ। কেবল কি ফর্মুলা? খোদ ফারাক্কা ব্যারাজের ভবিষ্যৎ কী? এই স্থাপনার বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা নিয়ে অন্যায্য অবস্থান নেওয়া মুখ্যমন্ত্রীজি কি তা জানেন? তিস্তার পানি নিয়ে তিনি যার নেতৃত্বে কমিশন গঠন করেছেন, ফারাক্কা ইস্যুতে রাজ্যের অবস্থান ঠিক করতে যার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসছেন, সেই কল্যাণ রুদ্র কিন্তু জানেন সবচেয়ে ভালো। নব্বইয়ের দশক থেকেই এই নদী বিশেষজ্ঞ হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছেন যে ফারাক্কা ব্যারাজ অকেজো হয়ে পড়তে পারে। এ নিয়ে তার তথ্যসমৃদ্ধ অথচ সুখপাঠ্য বইটি বাংলাদেশের বাজারেও মেলে।
ফারাক্কার বিবর্ণ ভবিষ্যতের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অনেক সমীক্ষাতেই পরিষ্কার_ প্রমত্ত গঙ্গার বুকে আজদাহা স্থাপনা তৈরির কারণে উজানে অস্বাভাবিক উচ্চতায় পানি জমছে। গঙ্গা বছরে যে সাতশ' মিলিয়ন টন পলি বহন করে, স্রোত না থাকায় তার ৩০০ টনই ফারাক্কা পয়েন্টে জমা হচ্ছে তলানি হিসেবে। উচ্চতা বাড়ছে গঙ্গাবক্ষের। ওদিকে পানি টেনে নেওয়ার মাধ্যম ভাগীরথীর উচ্চতাও বাড়ছে। অনিবার্য ফল_ প্রবল ভাঙনে মালদহ-মুর্শিদাবাদ এলাকার মাইলকে মাইল চলে গেছে গঙ্গার গর্ভে। বিপদ কেবল ভূমি ও ভূমিপুত্রদের নিঃস্ব হওয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়। গঙ্গা ভাঙতে ভাঙতে সমান্তরাল নদী পাগলার কাছাকাছি চলে গেছে। ফারাক্কার উজানে দুই নদীর ব্যবধান এখন ১০০ মিটারও নয়। যদিও কর্তৃপক্ষ ভাঙন ঠেকানোর নানা কসরত করছে, গঙ্গা-পাগলার মিলন সুপ্রভাতের অপেক্ষামাত্র। তাহলে ভাগীরথীতে ঠেলে দেওয়া গঙ্গার মূল স্রোত ফারাক্কা এড়িয়ে পাগলা-মহানন্দা হয়ে অর্ধ শতকের বন্দিদশা কাটিয়ে পদ্মায় ফিরতে পারে। হাজার বছরের ইতিহাসে গঙ্গা বেশ কয়েকবারই গতিপথ বদল করেছে; ফারাক্কার ভূত ঝেড়ে ফেলতে পুনরাবৃত্তিতে ক্ষতি কী?
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.