বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩০১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. আবদুল মতিন, বীর প্রতীক দুর্বার এক প্রতিরোধযোদ্ধা খুব ভোরে গোলাগুলির শব্দে মো. আবদুল মতিন সতর্ক হলেন। দ্রুত তৈরি হয়ে একজন সহযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নিজেদের প্রতিরক্ষা অবস্থান দেখতে। শেষে গেলেন মেশিনগান পোস্টে।
তাঁকে দেখে মেশিনগান পোস্টে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা উদ্দীপ্ত হলেন। সাহসিকতার সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করতে থাকলেন। যুদ্ধ চলল সারা দিন। এ ঘটনা মাস্তাননগরে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। প্রতিরোধযুদ্ধকালে।
মাস্তাননগর চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত। চট্টগ্রাম-ঢাকা রেলপথে সীতাকুণ্ডের পর মাস্তাননগর। এই যুদ্ধের বিবরণ আছে মো. আবদুুল মতিনের নিজের লেখাতেই। তিনি লিখেছেন, ‘...আমাকে পাঠানো হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল-সড়ক বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। আমরা প্রথমে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিই কুমিল্লা আর ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের মাঝামাঝি জায়গায়।
‘আমাকে মেজর জিয়ার (জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম, পরে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি) সাহায্যার্থে পাঠানো হয়। সেখানে কী করতে হবে খালেদ মোশাররফ (বীর-উত্তম, পরে মেজর জেনারেল) ব্রিফিং দেন। তিনি বলেছিলেন, সমুদ্রের দিক থেকেই ওরা (পাকিস্তান সেনাবাহিনী) আসার চেষ্টা করবে। কারণ, বাঙালিদের কোনো নৌযান নেই। সত্যি সত্যিই তাই ঘটেছিল।
‘আমরা প্রথম ডিফেন্স চারদিন ধরে রাখতে পেরেছিলাম। তারপর পিছিয়ে সীতাকুণ্ডে পরবর্তী ডিফেন্স নিই। সীতাকুণ্ডে সপ্তাহখানেক ছিলাম। সীতাকুণ্ডের পর মাস্তাননগরে ডিফেন্স গ্রহণ করি। এটাই আমার জীবনের স্মরণীয় ডিফেন্স। সেখানে সাত দিন ছিলাম। শেষ দিন সূর্য ওঠার আগে খুব ভোরবেলায় গোলাগুলির শব্দ পেয়ে হাবিলদার নজরুল ইসলামকে নিয়ে আমাদের মেশিনগান পোস্টে গেলাম।
‘আমি যাওয়ার পর গোলাগুলির প্রচণ্ডতা বেড়ে যায়। সারা দিন চলার পর সন্ধ্যার দিকে ট্রেঞ্চে বসে মনে হলো আমাদের পেছনেও গোলাগুলি হচ্ছে। আমার ডান-বামে আমাদের অবস্থান ঠিক আছে কি না জানার জন্য একজন সৈনিককে ডানদিকে পাঠালাম। সে ফিরে এসে জানাল, ডান দিকে আমাদের অবস্থানে পাকিস্তানি সেনারা এসে গেছে। বাম দিক থেকেও একই খবর পেলাম।
‘উদ্বেগে সিগারেট ধরিয়েছি। এমন সময় ট্যাংকের গোলা এসে আমাদের বাংকারের ছাদ উড়িয়ে নিয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম, মৃত্যু নিশ্চিত। আবু শামার (সুবেদার, মেশিনগান পোস্টের চার্জে ছিলেন) মতো সাহসী সৈনিক আর দেখিনি। সে বলল, “স্যার, আমি বেঁচে থাকতে আপনার কিছু হবে না, ইনশাআল্লাহ।” আমার কাছে অস্ত্র ছিল না। শামা আমাকে একটা পিস্তল দিল। যেন ধরা পড়লে আত্মহত্যা করতে পারি।’
মো. আবদুল মতিন ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। তিনি কোম্পানি (ব্রাভো) কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যোগ দেন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে ২ নম্বর সেক্টরে স্টাফ অফিসার হিসেবে কাজ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আবদুল মতিনকে বীর-প্রতীক খেতাব প্রদান করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ০১।
মো. আবদুল মতিন ২০০৯ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার রসুলপুর গ্রামে। তবে তিনি বাস করতেন ঢাকার মহাখালীর নতুন ডিওএইচএসের ১১৪ নম্বর সড়কে। তাঁর বাবার নাম মো. আলফু মিয়া। মা সখিনা খাতুন। স্ত্রী আর্জুমান্দআরা চৌধুরী। তাঁর দুই ছেলে, দুই মেয়ে।
সূত্র: পূরবী মতিন (মো. আবদুল মতিন বীর প্রতীকের মেয়ে), বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং আমাদের সংগ্রাম চলবেই, অপরাজেয় সংঘ।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.