এই দেশ-অর্থের রঙবদল বনাম কোভের বাতিঘর নীতি by কিশওয়ার ইমদাদ

সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এ দেশ কখনও গরিব হওয়ার কথা নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের চালিকাশক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে আজ অধিকাংশ জনগণ দরিদ্র। দুর্নীতি নির্মূল করা হলো শক্তিশালী ব্যবস্থাপনার এক নম্বর শর্ত।


একজন নিয়মিত করদাতা হিসেবে সরকারের কাছে আবেদন, সরকার যেন বৃহত্তর জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনায় নিয়ে দুর্নীতি নির্মূলের সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। তাতে করে সরকারও যেমন অধিক কর অর্জন করবে, জনগণও তার সঠিক অধিকার ও সুফল লাভ করবে

পশ্চিমা জগতের করপোরেট ব্যক্তিত্ব স্টিফেন কোভের বিখ্যাত বাতিঘর নীতির গল্পটা হয়তো অনেকেই জানেন। যারা জানেন না তাদের জন্য গল্পটা আবারও বলছি। গভীর রাত। প্রশান্ত মহাসাগরের অতল জলের উন্মত্ত ঢেউ অগ্রাহ্য করে গন্তব্যের পথে ভেসে চলছে মার্কিন নৌবহর। জাহাজে নিজের খাস কামরায় কমান্ডার গভীর ঘুমে অচেতন। হঠাৎ করে দরজায় টোকা পড়ল। সাধারণত এ সময় কমান্ডারকে বিরক্ত করা নিষেধ। স্বভাবতই বিরক্ত বদনে কমান্ডার জিজ্ঞাসা করল_ কে?
উত্তর এলো_ আমি সেকেন্ড অফিসার।
_কী হয়েছে? এত রাতে বিরক্ত করছ কেন?
_দুঃখিত কমান্ডার, একটা সমস্যা হয়েছে।
_কী সমস্যা?
_আমাদের নৌবহরের বিপরীত দিক থেকে একটা জাহাজ আসছে। বারবার নির্দেশ সত্ত্বেও জাহাজটা সরছে না।
কমান্ডার আরও বিরক্ত হলেন। বললেন, কে এই মূর্খ জোকার?
সেকেন্ড অফিসার বললেন, কমান্ডার, এ অবস্থায় আপনার নির্দেশনা দরকার।
কমান্ডার চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এসে বসলেন। ওয়্যারলেসে ঘোষণা দিলেন_
_আমি মার্কিন নৌবহরের কমান্ডার ডেভিডসন বলছি। তোমরা আমাদের গতিপথ থেকে ১০ ডিগ্রি সরে দাঁড়াও।
প্রত্যুত্তর এলো_ তুমি বরং ১০ ডিগ্রি দক্ষিণে গতিপথ পরিবর্তন করো।
কমান্ডার এবার রীতিমতো ক্ষেপে গেলেন। বললেন, তুমি বুঝতে পারছ না কার সঙ্গে কথা বলছ। আমার নির্দেশ অমান্য করলে তার পরিণাম হবে সাংঘাতিক।
অপরদিক থেকে উত্তর এলো, আমি তোমাকে চিনি। তুমি শক্তিশালী মার্কিন নৌবহরের কমান্ডার। কিন্তু তুমি আমাকে চিনতে পারোনি। আমি হলাম তোমার বিপদের সতর্কীকরণ বাতিঘর। আমার নির্দেশ অমান্য করলে বরং তোমারই পরিণাম হবে ভয়াবহ।
স্টিফেন কোভের ভাষায় এটি একটি সত্য কাহিনী। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বাতিঘর নীতির অবতারণা করেন। আমরা মনে করি, আমরা আমাদের জীবনধারা পরিচালনা করছি। কিন্তু গভীর সত্য হলো, জীবনে কিছু নীতিমালা আছে, যা আমাদের নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাতিঘরের নির্দেশের মতো আমরা যদি সেই নীতিমালা অগ্রাহ্য করি, তবে আমাদের তার পরিণতি ভোগ করতে হবে।
বাতিঘর নীতির গল্প অনেকটা ঈশপের গল্পের মতো শোনায়। কিন্তু যতই গভীরে যাই ততই এর সারসত্য অনুভব করি।
গত সপ্তাহের পত্রিকার প্রথম পাতায় লিড নিউজ 'আবারও ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আসছে'। বিষয়টা যেন এ রকম, প্রতি বছরই যে যত পারো কালো টাকা অর্জন করো এবং বছর শেষে ১০ শতাংশ কাফফারা দিয়ে সাদা করে নাও। টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না। এটা কি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া আর অনৈতিকতাকে বৈধতা দেওয়া নয়?
কথায় বলে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। তবে যে কর্তৃপক্ষ এ ধরনের বিধান দিচ্ছে, তারা নিশ্চয়ই বাতিঘর নীতির আওতার বাইরে নয়। কালো টাকার উৎস রোধ না করে বরং কাফফারার নামে উৎসাহ দেওয়া হলে তা হবে প্যানডোরার বাক্সের মতো। দুর্নীতির বাক্স যদি বন্ধ না করি তবে প্রতিনিয়তই সরকারকে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে এবং এর পরিণাম হবে আরও মারাত্মক।
প্রথমেই বলে রাখি, আমি অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ নই। তবে খোলা চোখে দেখা কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই। এনবিআর বলছে_ বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক। তাহলে ধরে নেওয়া যায়, সিদ্ধান্তটি এসেছে সরকারের জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসহ কোটি টাকার অধিক ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা প্রায় ২৭ হাজার। আর ১০ বছর আগে অর্থাৎ ২০০১ সালে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের কিছু বেশি। অন্যদিকে যদিও গত বছর ১০ লাখের বেশি জন বার্ষিক আয়কর বিবরণী বা ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিয়েছেন, তবে প্রকৃতপক্ষে সরকারকে কর প্রদান করেছেন তারও অর্ধেক অর্থাৎ পাঁচ লাখ লোক। একজন ব্যক্তি যদি মাসে ২০ হাজার টাকার অধিক আয় করে, তবে তার সরকারকে ট্যাক্স দিতে হবে। সেই হিসাবে বলা যায়, ২০ হাজার টাকার অধিক আয় করে এমন লোকের সংখ্যা পাঁচ লাখ বা তার কিছু বেশি।
অথচ বাজারে বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি হতে সময় লাগে না। জমির দাম বাড়ছে দ্বিগুণ হারে। টিভি, রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার বিক্রির বাজার রমরমা। মুদ্রাস্টম্ফীতিও চলছে ঊর্ধ্বগতিতে। তার মানে সহজ সূত্রে বলা যায়, আরও অনেক লোকের কাছে টাকা আছে। কর প্রদানকারী পাঁচ লাখ ব্যক্তির সীমানার বাইরে একটি বড় অংশ, যারা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল অথচ তারা কর প্রদান করছে না। তবে সেই সংখ্যা কত এবং সেই অর্থের রঙ এখন জনগণের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ।
যারা হালাল উপার্জন করে সরকারের নির্ধারিত কর দিচ্ছেন, তাদের কোনো বিশেষ স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদান করা হচ্ছে না। বরং যারা দুর্নীতি করে টাকা আত্মসাৎ করছে তাদের ১০ শতাংশ জরিমানা প্রদান করে টাকা হালাল করার জন্য সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। প্রতি বছর যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়, তা হবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার নামান্তর। তার মানে দাঁড়ায়, দুর্নীতিবাজদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান করা। কিন্তু এর পরিণতি যে দেশ ও জনগণের জন্য কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ভুক্তভোগী জনগণই তা বলতে পারবে।
সম্প্রতি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, দুর্নীতি শব্দের মধ্যে আরেকটি শব্দ লুকিয়ে আছে। শব্দটি হলো 'নীতি'। চোর বা ডাকাতের কাজ ঠিক দুর্নীতি নয়। কারণ তাদের কোনো নীতিই নেই। সুতরাং কালো টাকার উৎস না জেনে তাকে যদি ছাড় দেওয়া হয়, তা হবে চুরি-ডাকাতি বা এ ধরনের মারাত্মক অপরাধকে এক অর্থে স্বীকৃতি দেওয়া। এ টাকার রঙবদল লাভের থেকে ক্ষতি ডেকে আনবে অনেক বেশি।
সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এ দেশ কখনও গরিব হওয়ার কথা নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের চালিকাশক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে আজ অধিকাংশ জনগণ দরিদ্র। দুর্নীতি নির্মূল করা হলো শক্তিশালী ব্যবস্থাপনার এক নম্বর শর্ত। একজন নিয়মিত করদাতা হিসেবে সরকারের কাছে আবেদন, সরকার যেন বৃহত্তর জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনায় নিয়ে দুর্নীতি নির্মূলের সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। তাতে করে সরকারও যেমন অধিক কর অর্জন করবে, জনগণও তার সঠিক অধিকার ও সুফল লাভ করবে।

কিশওয়ার ইমদাদ : বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক
 

No comments

Powered by Blogger.