বিআইডব্লিউটিএর ১৩৫ কোটি টাকার খননযন্ত্র কেনা-কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ১৩৫ কোটি টাকার খননযন্ত্র কেনার প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ড যৌথ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ভোসতা এলএমজি-কর্ণফুলীকে দুটি ২০ ইঞ্চি কাটার সেকশন খননযন্ত্র,


তিনটি টাগবোট, ছয়টি ক্রেনবোট ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ হলো, প্রতিষ্ঠানটি কারিগরি ও ন্যূনতম অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ করতে পারেনি। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া ক্রয়সংক্রান্ত সরকারি নীতিমালার (পিপিআর, ২০০৮) লঙ্ঘন।
গত বছর আহ্বান করা দরপত্রে পিপিআরের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যৌথ বিনিয়োগের দুই প্রতিষ্ঠানের একটিকে মুখ্য প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করতে হবে। নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠানকে খনকযন্ত্র নির্মাণে ন্যূনতম ৪০ শতাংশ ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ২৫ শতাংশ অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে দরপত্রের নোটিশে এটাও উল্লেখ আছে, খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিজে কিংবা দেশীয় দরদাতার সঙ্গে দরপত্রে অংশ নিতে পারবে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে খনকযন্ত্র নিজেরাই সরবরাহ করতে পারে, সে জন্য দরপত্রের শর্তে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়।
এ ক্ষেত্রে বলা হয়, দরপত্রে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের যেসব প্রতিষ্ঠানের শিপইয়ার্ড আছে এবং জাহাজ রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সনদ আছে, তারা দরপত্রে অংশ নিতে পারবে। ভোসতা এলএমজি-কর্ণফুলীর স্থানীয় অংশীদার কর্ণফুলীর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে। কিন্তু ভোসতার খনকযন্ত্র তৈরির কোনো অভিজ্ঞতা নেই, নিজস্ব কোনো শিপইয়ার্ডও নেই। গত বছরের ১১ নভেম্বর বিআইডব্লিউটিএ চিঠি দিয়ে ভোসতার কাছে জানতে চায়, প্রতিষ্ঠানটি খনকযন্ত্র উৎপাদন করে কি না। জবাবে ২৫ নভেম্বর লেখা চিঠিতে ভোসতা জানায়, মূলত খনকযন্ত্রের নকশা তৈরি, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের পরামর্শ ও বিপণনের কাজ করে তারা।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ভোসতা এলএমজির সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (বিক্রয়) জোয়েরি ক্লিসেন্স জানান, ভোসতা এলএমজি দীর্ঘদিন ধরে খনকযন্ত্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে তিনটি খনকযন্ত্র সরবরাহের কাজ তারা পেয়েছে। প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে তিনি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট দেখার পরামর্শ দেন। ভোসতার ওয়েবসাইটে বলা আছে, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন-সুবিধা নেই। তাই দরপত্রের শর্ত [(১৪.১ (বি) (৩)] অনুযায়ী ভোসতা আলোচ্য দরপত্রে অযোগ্য প্রতিষ্ঠান।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ: এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০ ইঞ্চি কাটার সেকশন খনকযন্ত্র সরবরাহের দরপত্রেও অংশ নেয় ভোসতা এলএমজি-কর্ণফুলী। দরপত্রের প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় সেটি এখন পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
এই দরপত্র মূল্যায়নের কারিগরি কমিটির সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবদুর রশিদ সরকার মন্তব্য করেছেন, ভোসতা এলএমজি-কর্ণফুলীর উৎপাদনের সুবিধা না থাকায় এটিকে খনকযন্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কাজেই তাদের প্রস্তাব দরপত্রের শর্তানুযায়ী বিবেচনারই সুযোগ নেই।
কারিগরি ত্রুটি: বিআইডব্লিউটিএর কাজ পাওয়া ভোসতা এলএমজি-কর্ণফুলীর প্রস্তাবে কারিগরি ত্রুটিও ছিল বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দরপত্রে কারিগরি বিশেষত্বের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, খনকযন্ত্রের ড্রাফট (পানিতে নিমজ্জিত অংশের গভীরতা) সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৪৫ মিটার হবে। অথচ ভোসতা এলএমজি-কর্ণফুলীর প্রস্তাবে ড্রাফট ১ দশমিক ৬০ মিটার। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি দরপত্রের শর্তের চেয়ে দশমিক ১৫ মিটার বেশি ড্রাফটের খনকযন্ত্র সরবরাহের কথা জানিয়েছে।
জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ড্রাফট যত কম হবে, ততই অল্প পানিতে গিয়ে খননকাজ চালানো যাবে। আর বেশি হলে অল্প পানিতে খনকযন্ত্র নিয়ে যেতে অসুবিধা হবে।
আবার দরপত্রে টাগবোটের বোলার্ড পুলের ন্যূনতম ক্ষমতা ১০ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন দেওয়ার শর্ত ছিল। ভোসতা বলছে, তারা ১০ দশমিক ১০ মেট্রিক টন ক্ষমতার পুল সরবরাহ করবে। দশমিক ৪০ মেট্রিক টন কম ক্ষমতার বোলার্ড পুল সরবরাহের ব্যাপারে এক কর্মকর্তার মন্তব্য হচ্ছে, খনকযন্ত্র টেনে নেওয়া হয় টাগবোটের মাধ্যমে। আর বোলার্ড পুল হচ্ছে ইঞ্জিনের ক্ষমতা। কাজেই এটি কম হওয়ায় টাগবোটের ক্ষমতাও স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে।
বিআইডব্লিউটিএ কারিগরি এসব ত্রুটির বিষয়ে জানতে চাইলে ভোসতা এলএমজি-কর্ণফুলীর পক্ষ থেকে বলা হয়, মুদ্রণজনিত ভুলের কারণে এটা হয়েছে। পরে মূল্যায়ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটিকে এসব ‘সংশোধনের’ সুযোগ দেওয়া হয়।
তবে এ ধরনের কারিগরি দরপত্র প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দরপত্রে বড় মাপের কারিগরি ভুল থাকে, তা সংশোধন করার সুযোগ দেওয় যায় না। এটা করতে দেওয়া মানেই ওই প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা করে দেওয়া।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অন্য এক কর্মকর্তা বলেছেন, বড় ধরনের কারিগরি ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে জমা দেওয়া টাকা থেকে কত টাকা কাটা যাবে কিংবা কত টাকা জরিমানা গুনতে হবে, সেই হার নির্ধারণ করা আছে। কাজেই দরদাতা প্রতিষ্ঠান এটা করেও যদি পার পায়, তবে তো পুরো প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
আর্থিক সক্ষমতা পূরণ করেনি: দরপত্রের শর্তে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানকে গত পাঁচ বছরে সর্বোচ্চ দুটি চুক্তির আওতায় সাড়ে ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কিংবা ১৬৫ কোটি টাকা (ডলারে ৭৪ টাকা ধরে) মূল্যের খনকযন্ত্র ও সংশ্লিষ্ট পণ্য সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এর মধ্যে যৌথ বিনিয়োগপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রত্যেক অংশীদারকে সর্বোচ্চ চুক্তির আওতায় ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কিংবা ১৬৫ কোটি টাকার অন্যূন ২৫ শতাংশ অর্থাৎ ৪১ কোটি টাকা মূল্যমানের দ্রব্য সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথচ ভোসতার স্থানীয় অংশীদার কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড বৃহত্তম চুক্তির আওতায় প্রায় ৩৩ কোটি টাকার দ্রব্য সরবরাহের সনদ দাখিল করেছে। কাজেই এটি দরপত্র দলিলের ১৪.১ (বি) ধারা অনুযায়ী যোগ্য দরদাতার শর্ত পূরণ করতে পারেনি।
বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এভাবে কাজ দেওয়ায় দীর্ঘ ৩৫ বছর পর খনকযন্ত্র কেনার লক্ষ্য পূরণ সংশয়ের মুখে পড়েছে। কারণ বিশেষায়িত যন্ত্রটি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া হলে মানসম্পন্ন খনকযন্ত্র পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকত। সেই সঙ্গে পাওয়া যেত দীর্ঘস্থায়িত্ব ও যথাযথ বিক্রয়োত্তর সেবার নিশ্চয়তা।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দুটি ২০ ইঞ্চি কাটার সেকশন খনকযন্ত্র, তিনটি টাগবোট, ছয়টি ক্রেনবোট ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ভোসতা এলএমজি-কর্ণফুলীকে গত ৫ এপ্রিল বিআইডব্লিউটিএর খনকযন্ত্র শাখার প্রধান প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ চিঠি দেন। ১৩৫ কোটি ৪২ লাখ ছয় হাজার ৭১০ টাকায় উল্লিখিত যন্ত্রপাতি নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান পরবর্তী ১৮ মাসে সরবরাহ করবে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহনসচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার গত ২২ এপ্রিল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পৃথিবীর কোথাও দরপত্রের শর্ত শতভাগ পূরণ করে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় না। মূল উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কখনো শর্তে কিছুটা ছাড় দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, আলোচ্য ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্তের ব্যতয় ঘটেছে কি না, তা দরপত্র মূল্যায়নের কারিগরি কমিটিই ভালো বলতে পারবে।
কাজটি যেহেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে, সে ক্ষেত্রে সচিব হিসেবে তিনি বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন—জানতে চাইলে আবদুল মান্নান হাওলাদার দাবি করেন, অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে দরপত্র মূল্যায়নের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে যৌথ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের শর্ত পূূরণ না করার অভিযোগ আছে। কারিগরি প্রস্তাবের ত্রুটিও তো বড় ধরনের বিচ্যুতি—এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল মান্নান হাওলাদার পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি তো সাংবাদিক, কারিগরি বিষয়গুলো কি আপনি বোঝেন?’ দরপত্র-সংক্রান্ত কাগজপত্র পর্যালোচনা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতে এমন অভিযোগ উঠে এসেছে বলে জানালে সচিব আর কোনো মন্তব্য করেননি।

No comments

Powered by Blogger.