উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ১৭ ঘণ্টা-মা-বাবার কোলে মায়েশা by কাজী আনিছ

আদুরে মুখে মিষ্টি হাসি। চোখ দুটি উৎসুক-চঞ্চল। ক্ষণে ক্ষণে মা-বাবার মুখে কোমল হাতের পরশ। আর আনন্দে ছোট্ট পা দুটো সজোরে ছোড়ার চেষ্টা। অপহরণের প্রায় ১৭ ঘণ্টা পর বাবা-মায়ের কোলে ফিরে আসে আট মাসের শিশু মোবাশ্বিরা আলম মায়েশা।


উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বিপর্যস্ত বাবা-মাকে যেন স্বাভাবিক হতে সহায়তা করছিল সে। শিশুটি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেসেছে, হাসিয়েছে সবাইকে। গতকাল রোববারের হরতালের রাজনৈতিক উত্তাপ-উৎকণ্ঠা ছাপিয়ে এ দৃশ্য কেবলই প্রশান্তি ছড়িয়েছে পরিবারের পাশাপাশি উপস্থিত সাংবাদিক, পুলিশ ও উৎসুক জনের মাঝে।
গত শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় খিলগাঁওয়ের সি ব্লকের বাড়ির চতুর্থ তলা থেকে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করে দুর্বৃত্তরা। সঙ্গে নিয়ে যায় ব্যাংক কর্মকর্তা শাহ আলমের শিশুকন্যা মায়েশাকে। দাবি করে ২৫ লাখ টাকার মুক্তিপণ। অজানা আশঙ্কায় নিমজ্জিত হয় পুরো পরিবার। সংবাদমাধ্যমে এই খবর জেনে বিমূঢ় হয়ে পড়ে সংবেদনশীল মানুষ।
রাত গড়িয়ে দিন আসে। উৎকণ্ঠা বাড়ে স্বজনের। হঠাৎ গতকাল দুপুর ১২টার দিকে খবর আসে, মিরপুরে মায়েশাকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। মিরপুর থানায় নিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। বাবা শাহ আলমকে নিয়ে খিলগাঁও থানার পুলিশ দ্রুত ছুটে যায় থানায়। সন্তানকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে শাহ আলম বুকে জড়িয়ে ধরেন। সেখান থেকে পুলিশের গাড়িতে করেই মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দপ্তরে নিয়ে আসা হয় মায়েশাকে। তারপর খিলগাঁও থানায়। পুলিশের কর্মকর্তারা শিশুটিকে কোলে নিয়ে আদর করেন। উপস্থিত একাধিক জন মায়েশার জন্য চকলেট নিয়ে আসেন। একটু পরই সেখানে ছুটে আসেন মা খালেদা বেগম। মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরেন, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে পানি। বেলা আড়াইটার দিকে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা-মায়ের কাছে মায়েশাকে হস্তান্তর করা হয়, তখন হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে উপস্থিত অনেকেই। মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী প্রথম আলোকে বললেন, ‘দুপুর ১২টার দিকে একজন থানায় ফোন করে জানায়, দক্ষিণ পাইকপাড়ার একটি বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে একটি শিশু পাওয়া গেছে। বাড়িটির এক গৃহকর্মী দেখে তাকে বাসায় নিয়ে রেখেছেন। তৎক্ষণাৎ আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করি। খিলগাঁও থেকে শিশু অপহরণের ঘটনাটি আগেই অবহিত হওয়ায় আমি খিলগাঁও থানার পুলিশকে জানাই। পরে পুলিশসহ পরিবার এসে শিশুটিকে শনাক্ত করে।’
ওয়াজেদ আলী বলেন, শিশুটির গায়ে জামা ছাড়াও পাশে সাদা গেঞ্জিতে মোড়ানো একটি ফিডার ছিল। গেঞ্জিতে লেখা ছিল, ‘দয়া করে বাচ্চাটিকে খিলগাঁও থানায় পৌঁছে দিন। বাচ্চাটির বাবার নম্বর ...।’
ফজিলা বেগম নামের ওই গৃহকর্মীকেও খিলগাঁও থানায় আনা হয়। ফজিলা বলেন, দুপুর ১২টার দিকে তিনি বাড়ির নিচতলায় কাজ করছিলেন। হঠাৎ বাইরে শিশুর কান্না শুনতে পান। বাইরে এসে শিশুটিকে দেখতে পান। পরে আশপাশের লোকজনকে জানানোর পর কয়েকজন গেঞ্জিতে লেখা ফোন নম্বরে ফোন দেন। তাঁরা মিরপুর থানায়ও ফোন করে বিষয়টি জানান।
বাড়ির বাসিন্দা আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমি প্রথমে থানায় ফোন করে বিষয়টি জানাই। পরে গেঞ্জিতে লেখা মুঠোফোনে যোগাযোগ করে পুলিশসহ মিরপুর থানায় আসতে বলি।’
পাশের বাড়ির সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমার মেয়ে নেই। শিশুটিকে দেখার পর মনে মনে ভেবেছিলাম, অভিভাবক পাওয়া না গেলে বাচ্চাটাকে আমি রাখব। কিন্তু পত্রিকার খবরের কথা মনে পড়লে থানায় দ্রুত ফোন করে জানাই।’
মায়েশার বাবা শাহ আলম জানান, গেঞ্জিতে লেখা মুঠোফোন নম্বরটি মায়েশার ফুফা হুমায়ুন কবীরের। তাঁরা একই বাসায় থাকেন। দুর্বৃত্তরা শনিবার অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর মুঠোফোন দুটিও নিয়ে যায়। তবে সিম দুটি রেখে যায়।
হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘একজন ফোন করে শিশু পাওয়া যাওয়ার কথা জানালে আমি দ্রুত পুলিশকে জানাই। ভয়ে ছিলাম, মায়েশাকে জীবিত পাব কি না? আল্লাহর রহমতে জীবিত পেয়েছি।’ তিনি জানান, দুর্বৃত্তরা ডাকাতির সময় তাঁর মুঠোফোন নম্বর জেনে নেয়। মায়েশার বাবা সে সময় বাসায় ছিলেন না।
সকাল থেকেই মায়েশাদের বাড়িতে পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডির লোকজন ছাড়াও আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা ভিড় করেন। উপস্থিত এলাকাবাসীর কয়েকজন জানান, শনিবার সন্ধ্যায় যখন ঘটনা ঘটেছে তখন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি হলেই এলাকার রাস্তায় পানি জমে যায়। রাস্তায় সোডিয়াম বাতি থাকলেও বেশির ভাগই জ্বলে না। আর বিদ্যুৎ চলে গেলে ভুতুড়ে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এসব আলোচনার মধ্যেই খবর আসে মায়েশা উদ্ধারের। সঙ্গে সঙ্গে সবার মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ‘পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে’ রব ওঠে। শেষে বেলা তিনটার দিকে খিলগাঁও থানা থেকে মায়েশাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। আনন্দে কেঁদে ফেলেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা।
খিলগাঁও থানায় আসা মতিঝিল অঞ্চলের উপকমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন দাবি করেন, ‘বাচ্চাটাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল। সকাল সাড়ে আটটার দিকে নিশ্চিত হয়েছি, বাচ্চাটাকে আমরা উদ্ধার করতে পারব।’ তাহলে কি জড়িতরা শনাক্ত হয়েছে? জানতে চাইলে ডিসি বলেন, ‘এখন পুরোপুরি বলা যাবে না।’ ডিসি বলেন, ‘বাসা লুট করার পর বাচ্চা অপহরণ করার ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেনি। পূর্বপরিকল্পিত, ভয় সঞ্চার অথবা মুক্তিপণের জন্য এ ঘটনা ঘটানো হতে পারে। জড়িতদের গ্রেপ্তারের পর সবকিছু জানা যাবে।’ গত রাত সাড়ে আটটায় যোগাযোগ করা হলে খিলগাঁও থানার পুলিশ জানায়, মামলার প্রস্তুতি চলছে।
বাসায় গেলে মায়েশার মা খালেদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংবাদিক, পুলিশ, র‌্যাব—সবার সহযোগিতায় আমার বাচ্চাকে পেয়েছি। আমি কৃতজ্ঞ। এ আনন্দ বোঝানোর মতো নয়। সবার কাছে আমরা ঋণী।’ বাবা শাহ আলম বলেন, ‘অসাধারণ, ভাই অসাধারণ! আমার আনন্দটা দেখেন আর আপনার যা ইচ্ছা লেখেন।’
মায়েশাকে দেখতে আসা এক প্রতিবেশী বললেন, ‘মনে হচ্ছে, খুব কাছের একজনকে ফিরে পাওয়া গেছে।’

No comments

Powered by Blogger.