জীবন থেকে নেয়া-যেভাবে চিত্রায়িত হলো একুশের গান by জাহীদ রেজা নূর

কথা শুরু হয় এভাবে, ‘আফজাল ভাই, আপনি কি জীবন থেকে নেয়া ছবিটির কথা মনে করতে পারেন?’ সোফায় বসা ৮২ বছর বয়সী আফজাল চৌধুরী হাসেন। বলেন, ‘আমি কি ভুলিতে পারি?’ আমরা আসলে এই গানটির কথাই শুনতে এসেছি। একুশের প্রভাতফেরির চিত্রায়ণ।


আনোয়ার হোসেন, রোজী সামাদ ও সুচন্দাকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে প্রভাতফেরির মিছিল। অন্য এক মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাজ্জাক। ভোরবেলা নগ্ন পায়ে শত শত মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে শহীদ মিনারে। কবে, কোথায় চিত্রধারণ করা হলো, সে কথাই তো শুনতে এসেছি আফজাল চৌধুরীর কাছে। তিনিই তো এ ছবির চিত্রগ্রহণের কাজটি করেছিলেন। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল।
আফজাল চৌধুরী স্মৃতির ঝাঁপি খুলে ধরেন, ‘আমরা শুটিং করতে বেরিয়েছিলাম রাত ১২টার পর। অর্থাৎ তখন ২১ ফেব্রুয়ারি। আমি আর জহির একটা ক্যামেরা নিয়ে শহীদ মিনারের কাছে ছিলাম। কবি জসীমউদ্দীনের ছেলে কামাল ছিল আমার সহকারী। ওকে আরেকটি ক্যামেরা দিয়ে রাজপথের প্রভাতফেরির ছবি তুলতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভোর হতে না হতেই ব্যানারসহ মিছিল আসতে শুরু করে। জহির ভীষণ উত্তেজিত! বলে, আমি এটাই চেয়েছিলাম! একটু পর সূর্যের আভাস দেখা গেল। শুটিং করার মতো যথেষ্ট আলো পেলাম আমরা। একবার আমার হাত থেকে ক্যামেরা নিয়ে নিল। নিজেই কিছুটা সময় ক্যামেরা চালাতে শুরু করল। জহির ক্যামেরার কাজটাও বুঝত খুব ভালো।’
জহির রায়হানকে নিয়ে কিছু শুনতে চাই।
‘অসাধারণ প্রতিভাবান ছিল জহির রায়হান। মাথায় কিছু একটা ঢুকলে বারবার প্রশ্ন করে জেনে নিত। বলত, আচ্ছা আমি এ রকম করে ভেবেছি। ঠিক আছে তো? জীবন থেকে নেয়া ছবিতেই খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে একজন শিল্পীর ওপর বারবার ক্লোজ-ব্যাক করার চিন্তা ওর মাথায় এল। বলল, তুমি যদি দ্রুত জুম আগে-পিছে করো, তাহলে আমি কেটে কেটে একটা ভিজ্যুয়াল দিতে পারব। সম্পাদনার সময় ক্যামেরার যাওয়া-আসার মধ্যে ফেরাটা রাখব না। এ রকম সাংঘাতিক চিন্তা শুধু জহিরের মাথায়ই আসতে পারে। ছবিতে সেই দৃশ্য আপনারা দেখেছেন নিশ্চয়।’
আবার ফিরে আসি একুশের চিত্রায়ণ প্রসঙ্গে। ‘যত দূর মনে পড়ে, আমরা শহীদ মিনারের সিঁড়ি আর আমাদের পিকআপ ভ্যান থেকে ক্যামেরার কাজ করেছি। সেদিন ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল শহীদ মিনার। সে ছবিও তুলেছি। ক্যামেরা কোথায় আছে, কীভাবে শট নেওয়া হচ্ছে, সেটা নিয়ে শিল্পীদের ভাবতে বলা হয়নি। ক্যামেরা তার কাজ করে গেছে। আমরা কাজ করেছি ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুর পর্যন্ত। এখনো ছবির মতো সে দৃশ্যগুলো চোখে ভাসে।’
ফেরার সময় আফজাল চৌধুরীর পাওয়া বিভিন্ন ক্রেস্ট দেখি। একটু অবাকই হতে হয়। ক্রেস্টগুলোর একটিও বাংলাদেশ থেকে পাওয়া নয়। এই বাংলায় প্রথম রঙিন ছবি, প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবির চিত্রগ্রহণ করেছেন আফজাল চৌধুরী। অথচ কোনো স্বীকৃতি নেই।
‘লোকে ভুলে যেতে চায়, সহজেই ভোলে।’

No comments

Powered by Blogger.