স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন by আইয়ুব হোসেন

‘স্বশিক্ষিত লোকমাত্রই সুশিক্ষিত’— বাংলাভাষার সুসাহিত্যিক মননশীল লেখক প্রমথ চৌধুরীর সুখ্যাত ও বহুল উচ্চারিত এ বাক্যটি কম-বেশি সবাই জানেন। তিনি তার প্রবন্ধসংগ্রহ বইয়ের একটি রচনায় এ বাক্যটি উল্লেখ করেছিলেন।

পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে তার পূর্ব-পুরুষের বাস ছিল। জমিদার পরিবারের সন্তান। জীবনের প্রথম পাঠ তার পল্লী প্রান্তরেই ঘটেছিল। আপন প্রয়াসে অর্জিত শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা সেই উপলব্ধিটা তার পল্লী প্রান্তরের সুনসান জনপদের চাষাভূষা লোকজনদের দেখে-শুনে-বুঝে গড়ে উঠেছিল। প্রকৃতি ও জীবন বাস্তবতার অবয়ব থেকে মৃত্তিকা-সংলগ্নম্ন মানুষের যে জ্ঞান আহরণ তার কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক মূল্য আমাদের দেশে নিরূপণ করা হয় না। কিন্তু এর যে অপরিসীম মূল্য তা কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বা সমাজ স্বীকৃতি ও সহায়তার জোগান দেয়।
সম্প্র্রতি আমাদের রাজধানী নগরীতে অনুষ্ঠিত একটি অন্যরকম ও অভিনব মেলার আয়োজন দেখে উপরোক্ত কথাগুলোর অবতারণা করতে হলো। আয়োজিত এই মেলার নাম দেয়া হয়েছিল উদ্ভাবন মেলা। উদ্ভাবন বা আবিষ্কারের পসরা সাজিয়ে দুদিন স্থায়ী ছিল এই মেলা। তবে উদ্ভাবনগুলো তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতজনদের নয়। প্রতিষ্ঠান-বঞ্চিত তৃণমূল মানুষের, যারা স্বশিক্ষায় শিক্ষিত তথা স্বশিক্ষিত বলে আমরা যাদের অভিহিত করি; তাদের উদ্ভাবিত বিচিত্র সব সামগ্রী। আমরা তাদের বিজ্ঞানী বললে নিশ্চিত অনেকে নাক সিঁটকাবেন অথবা মতিভ্রম বলে চিহ্নিত করতে সচেষ্ট হবেন। বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন মানে তো তাবড় তাবড় উচ্চশিক্ষিত লোকজন, বইপুস্তক, জার্নাল, ল্যাবরেটরি, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। সে অর্থে উদ্ভাবন মেলায় সমবেত উদ্ভাবকদের কোনোক্রমেই বিজ্ঞানী বলার অবকাশ নেই। আবার যদি আপন প্রচেষ্টায় আপনার অজান্তেই আকস্মিকই সৃজনশীল কিছু আবিষ্কার করে বসেন, তাহলে কেউ তাকে নিদেনপক্ষে স্ব্বশিক্ষিত বিজ্ঞানী বা উদ্ভাবক বললে দোষের কিছু থাকে না। উদ্ভাবন মেলায় অংশগ্রহণকারী গ্রামীণ উদ্ভাবকরা তেমনই বিজ্ঞানী। সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানী তারা।
ড. কুদরাত-এ-খুদা প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ শিল্প ও গবেষণা পরিষদ যার সংক্ষিপ্ত ও পরিচিত নাম সায়েন্স ল্যাবরেটরি। সায়েন্স ল্যাবরেটরির আইএফএসটি মিলনায়তন এবং এর বহিঃভাগের সুপরিসর বারান্দায় আয়োজিত উদ্ভাবন মেলায় যোগ দিয়েছিলেন ১৫-১৬ স্বয়ংশিক্ষিত উদ্ভাবক। এদের বিজ্ঞানী বলে অভিহিত করতে শহুরে লোকজনের আপত্তির আশঙ্কায় সম্ভবত আয়োজকরা নিরীহ গন্ধ চয়ন করে নাম রেখেছেন উদ্ভাবন মেলা। এত আকর্ষণীয় ও প্রয়োজনীয় উপকরণ এই স্বশিক্ষিত উদ্ভাবকরা আবিষ্কার করেছেন, বিস্ময়াভিভূত না হয়ে উপায় নেই। এরা স্বীকৃতি তো দূরে থাক, কোনো ধরনের ন্যূনতম সহায়তা পাননি কখনও, কারও কাছ থেকে। কিন্তু মস্তিষ্কে রয়েছে ক্ষ্যাপাটেপনা। পাগলামি বলে সমাজ যাদের হেলাফেলাই করে। এই পাগলামি অব্যাহত রাখতে সমাজ, সংসার, স্বজন ত্যাগ এবং অবহেলা কুড়োতে কুণ্ঠিত নয় তারা। আপন খেয়ালে নিভৃতে বসে বেশিরভাগই নিরতিশয় দরিদ্র, প্রকৃতির কাছ থেকে পাঠ নেয়া বিজ্ঞানী। আনন্দের ও গর্বের কথা হলো— তারা কেউই শৌখিন কোনো সামগ্রী উদ্ভাবনে রত হননি। আমাদের গ্রামীণ জীবনে বিশেষত কৃষি তথা কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার্য উপকরণাদি নিয়ে তাদের কাজ-কারবার। অর্থাত্ তাদের চারপাশের প্রয়োজন, অভাব ইত্যাদি বিমোচনে তাদের উদ্ভাবিত সামগ্রীগুলো নিত্য ব্যবহার হয়, কাজে লাগে। ক্ষেত্রগুলো এ কথার যথার্থতা প্রমাণিত করবে। চাষাবাদ, সেচ, শস্য ফলানো, শস্য সংগ্রহ, উন্নত জাতের শস্য, একই জমিতে বছরে ৬টি পর্যন্ত শস্য ফলানো, যথাযথ বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি, উচ্চ ফলনশীন বীজ উদ্ভাবন ইত্যাদি। এছাড়া ফল ও মাছের চিকিত্সা, বন্ধ্যা গাছে ফল উত্পাদন, বছরে একাধিকবার ফল উত্পাদন, ইকো সিস্টেম বজায় রেখে চাষাবাদ করার সাধারণ পদ্ধতি প্রভৃতি অসংখ্য ধরনের উদ্ভাবন। ময়মনসিংহ জেলার গৌরিপুরের এক কেনু মিস্ত্রিই আবিষ্কার করেছেন কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত ৪২টি যন্ত্রপাতি। নিতান্তই সাধারণ উপকরণে, সাধারণ খরচাপাতিতে। আবার হরিপদ মাত্র একটি আবিষ্কার দিয়ে দেশে-বিদেশে নন্দিত হয়েছেন। তার উদ্ভাবিত পণ্যের নাম হরি ধান, যার কথা এরই মধ্যে অনেকে জেনেছেন। আবিষ্কৃত এ নতুন প্রজাতির ধানের নাম স্থানীয় লোকজন সত্তরোর্ধ্ব হরিপদের নামানুসারে হরিধান ধার্য করেছে। তা যথার্থও বটে। ক্ষেতের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী অতিমাত্রায় পুষ্ট ধানগাছ একদিন তার নজরবন্দি হয়। এরপর টানা পর্যবেক্ষণ। অবশেষে তার ধারণাই সত্যে পরিণত হয়। ওই বিশেষ গাছটিতে ধান উত্পাদন হয় গড় উত্পাদনের চেয়ে দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি। ওই গাছের সব ধান বীজ হিসেবে পরে এবং তারও পরে লাগিয়ে একই ফল। গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেল, সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির ধানই বটে। চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বানুসারে আমাদের চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হচ্ছে যেমন অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী, তেমনি সৃষ্টিও হচ্ছে নতুন। তেমনি এক সৃষ্টি এই হরিধান।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে কেনু মিস্ত্রি বা হরিপদ কাপালী কারও লেখাপড়ার প্রাথমিক সবক পর্যন্ত নেয়ার সুযোগ হয়নি। কৃষি উপকরণ নিয়ে অনেকে এসেছিলেন মেলায়। এসেছিলেন প্রাণী ও মত্স্য সম্পদের উন্নয়ন ও চিকিত্সার ওষুধ বা উপকরণ নিয়ে। শেখ আশরাফ হোসেন হান্টু তো রীতিমত তার এলাকায় মত্স্য হাসপাতালই গড়ে তুলেছেন। খুব প্রয়োজনীয় তার উদ্ভাবন প্যাটেম্লট করাতে পারছেন না। আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজালে আটকে আছে কয়েক বছর। উদ্ভাবন তালিকায় রয়েছে বায়ুচালিত গাড়ি, সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে অসংখ্য রকমের সামগ্রী, স্বল্পমাত্রার রেডিও ইত্যাদি।
মেলায় অনেকে এসেছিলেন নিছক কাগজে আঁকা ডায়াগ্রাম নিয়ে। সঙ্গে কোনো উদ্ভাবন নেই। এর কারণ দুটো। এক. বড়সড় যন্ত্রপাতি, যা সহজে বা কোনোক্রমেই বহনযোগ্য নয়—এমন উদ্ভাবনগুলো আনা যায়নি। দুই. ছক কষে, হিসেবে মিলিয়ে উদ্ভাবনের স্কেচ করেছেন অনেকে, কিন্তু অর্থ সঙ্কট বাঁধ সেধেছে। প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনার সামর্থ্য নেই। ফলে কেবল ডায়াগ্রাম সম্বল করে এবং তা সামনে মেলে ধরে দর্শকদের উত্সুক্য মিটিয়েছেন। মনে তাদের আশা—কেউ যদি সহায়তায় এগিয়ে আসে! এমন অসংখ্য উদাহরণ পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটানোর সম্ভাবনা বিধায় ক্ষান্ত দিয়ে উদ্ভাবন মেলার আয়োজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে খোঁজখবর করা যাক। আয়োজক সংগঠন জনবিজ্ঞান ফাউন্ডেশনের বক্তব্য নিম্নরূপ— ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক, লোকজ, স্বয়ংশিক্ষিত, স্বতঃস্ফূর্ত এবং সৃজনশীল বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার বা উদ্ভাবন যা জাতীয় অগ্রগতিতে সবিশেষ অবদান রাখতে পারে এমন উদ্ভাবনগুলো এবং সেগুলোর উদ্ভাবকদের সমাবেশ ঘটিয়ে উদ্ভাবন মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। মেলা আয়োজনের উদ্দেশ্য মূলত চতুর্বিধ।
এক. জাতীয় পর্যায়ে স্ব্বশিক্ষিত সৃজনশীল প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদের পরিচিত করানো; দুই. সরকার বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিজ্ঞানীদের যোগাযোগ ঘটানো; তিন. মিডিয়ায় প্রচারণা এবং চার. তৃণমূল পর্যায়ের অপরাপর প্রতিভাধর স্ব্বশিক্ষিত বিজ্ঞানীদেরও উত্সাহী করে তোলা।’
এই মেলা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় স্বয়ংশিক্ষিত বিজ্ঞানীদের প্রশস্ত ক্ষেত্র বা অবকাশ তৈরি হবে, লোকজ সৃজনশীলতার বিকাশ হবে। সমাজ, দেশ ও জাতি তাদের ক্রমাগত উদ্ভাবনে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। আমরা যে মেধায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে দীন নই তাও প্রমাণিত হবে। মেধা পরিচর্যায় আমাদের সম্ভব উদ্যোগ এবং নিরন্তর অংশীদার হওয়া প্রয়োজন। অংশীদারিত্ব প্রয়োজন সরকার ও শুভবাদী সব মহলের।
মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানের শেষে ৮ দফাভিত্তিক উদ্ভাবন মেলা ঘোষণা পাঠ করা হয়। এগুলো যথাক্রমে—১. দেশীয় উদ্ভাবনের প্রতি সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের সর্বাধিক মনোযোগ ও গুরূত্ব প্রদান করা আবশ্যক, ২. বিশেষত বিজ্ঞান এং তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সম্ভাব্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন, ৩. সারা দেশে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নিয়োজিত স্বশিক্ষিত সৃজনশীল উদ্ভাবকদের অনুসন্ধান ও তালিকাবদ্ধকরণ, ৪. নির্দিষ্ট মেয়াদে তাদের পর্যায়ক্রমে আর্থিক সহায়তা, বৃত্তি অথবা ফেলোশিপ প্রদান করা প্রয়োজন, ৫. উদ্ভাবিত পণ্য উত্পাদন ও বাজারজাতকরণের জন্য সুদমুক্ত অথবা নামমাত্র সুদে ব্যাংক ঋণ প্রদান, ৬. উদ্ভাবিত পণ্যসামগ্রী নিবন্ধীকরণ (প্যাটেম্লট) প্রক্রিয়া সহজ করা। ৭. দেশীয় উদ্ভাবন সম্পর্কে মিডিয়ায় প্রচারণা জোরদারকরণ এবং ৮. স্বশিক্ষিত উদ্ভাবকদের নিরন্তর উত্সাহ প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সরকারের একটি বিশেষ সেল গঠন করা গেলে ভালো হয়।
সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রতি দু’বছর অন্তর উদ্ভাবন মেলার আয়োজন করা হবে। দেশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত এ মেলার উদ্বোধন করেছেন বিজ্ঞান ও তথ্য যোগাযোগ এবং প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। তিনি এ আয়োজনের ভূয়সী প্রশংসা করে অনেক আশীর্বাণী উচ্চারণ করেছেন স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানীদের উন্নয়নে। তার মন্ত্রণালয়ে স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানীদের জন্য প্রচলিত কিছু বিধান সংস্কার করে সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। এরকম মেলা আয়োজনে তার মন্ত্রণালয় অংশীদার হবে বলেও জানিয়েছেন। এ ধরনের প্রতিশ্রুতি সত্যি সত্যিই আশার কথা। কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রের জন্য আবশ্যকীয় নতুন নতুন উদ্ভাবন সবার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে সন্দেহাতীতভাবে।
আমাদের সম্মান ও সহায়তা উভয়ই স্বয়ংশিক্ষিত উদ্ভাবকদের প্রাপ্য। এখন বাস্তব পদক্ষেপের দিকেই সবার তাকিয়ে থাকা।

No comments

Powered by Blogger.