এই শীতে-শোক আর শক্তির যুগলবন্দী by মাহবুব আলম

অলস দুপুরে খোলা জানলায় উড়ে আসে টুকটুকে লাল একটি ফড়িং। ঘরের আয়নার গায়ে দুদণ্ড বসেই ভেসে যায় বাইরে; একটু পরই ফিরে আসে। ঢাকা শহরেও ঠিক এমনি করে শীত আসে আজকাল। দু-চার দিন রোদে চাঁপা ফুলের রং, বাতাসে শিরশিরানি, ভোরবেলায় এক পশলা কুয়াশা—ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই কোথায় যেন পালিয়ে যায় সে। নিজের খেয়ালে ফিরেও আসে আবার।


এহেন খামখেয়ালির জন্য শীত নিজে দায়ী নয়। দায়ী দুই খলনায়ক—বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ আর তার দোসর ঘূর্ণাবর্ত। এরাই শীতের দরজা হয় আগলে রাখে, না হয় কয়েক দিনের জন্য শীত হরণ করে নিয়ে যায়। এ দুই শক্তিধরের মুঠি ফসকে কখন শীত ফিরে আসবে, তারই প্রতীক্ষায় দিন গোনে শহরের শীতবিলাসী মানুষ।
কেতাদুরস্ত অতিথির মতো শীত তার আগাম বার্তা পাঠাতে কখনো ভোলে না। ‘শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকির ঐ ডালে ডালে।’ গ্রামের পুকুরে সর পড়া দিয়ে শুরু হয় সেই খবর পাঠানো। একে একে পালংশাকের ডগায়, কচি মুলোর গায়ে, ধবধবে ফুলকপিতে আর গলানো সোনার মতো উজ্জ্বল গাঁদা ফুলের গায়ে পাওয়া যায় শীতের বারতা। এখানেই শেষ নয়, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে গেলেই চোখ থমকে যায়। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল।’ গ্রামবাংলাজুড়ে এখন উৎসবের আমেজ, কৃষকের ঘরে নতুন ফসল ওঠার আনন্দ।
একটা বছরের শেষ আর একটা বছরের শুরু জুড়েই তো সারা শীতকাল। বছরের শেষ দিকটায় পরীক্ষার পর স্কুলে লম্বা ছুটি। ফলাফল বের হওয়ার পর আর নতুন ক্লাসে ওঠার আগে আবার ছুটি। সেই ছুটির দিনে সবাই বেরিয়ে পরতাম খেলতে। একটা কাপড়ের ছোট থলেভর্তি কাচের রঙিন মার্বেল ছিল আমাদের খেলার উপকরণ। শীতের সকালের রোদে ঝলমলিয়ে উঠত সেই মার্বেল। দুই পকেটে সেগুলো বোঝাই করে দৌড়াতাম খেলতে। আমাদের ছেলেবেলার সবচেয়ে কম পয়সার সবচেয়ে বেশি মজার খেলা—মার্বেল খেলা। খেলায় জিতলে মার্বেলের মতোই ঝলমল করত মুখ, আর হেরে গেলে মুখের সব আলো যেন নিভে যেত। এতগুলো সুন্দর মার্বেল দিয়ে আসতে দুঃখ তো হবেই! আর একটু বড় হয়ে হাতে উঠল মার্বেলের বদলে ক্রিকেটের ব্যাট। সারা শীতকাল তখন ক্রিকেটের মজায় ডুবুডুব।
ছেলেবেলার শীতকালের কোঁচড়ে থাকত নানা মনকাড়া উপহার। পরীক্ষার মতো একটা ভয়াবহ বিপদকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেও তার হাত থেকে একে একে বের হতো কমলালেবু, দেশি সার্কাস, চড়ুইভাতি, চিড়িয়াখানা, ধোঁয়া ওঠা মুখ, লেপের মিষ্টি ওম আর পিঠেপুলির স্বাদ; সঙ্গে থাকত দেবসাহিত্য কুটিরের বার্ষিকী বা মোহন সিরিজের গোয়েন্দা বই। ট্রাংক থেকে বের হতো ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা একটু ছোট হয়ে যাওয়া সোয়েটার, জানালার কার্নিশে থাকত ফুলের টবের বদলে রোদ পোহানো আচারের মুখ খোলা বয়াম—ভেতরে সোনারঙা তেলের প্রবল হাতছানি। এ যেন শেষ না হতে চাওয়া আনন্দ—পশম দিয়ে বোনা নানা রঙের গালিচা।
আমাদের কম বয়সের ঢাকা ছিল বেশ নাগরিকবান্ধব শহর। ছিল সবুজের অজস্র সারি, খোলামেলা রাস্তা, দূষণহীন শীতের ঠান্ডা বাতাস আর বিশুদ্ধ কুয়াশা। তখনকার পাবলিক লাইব্রেরির কোল ঘেঁষে রেসকোর্স ময়দান ছিল সবুজ ঘাসে ঢাকা বিশাল মাঠ। এপার থেকে ওপার স্পষ্ট দেখা যেত না। মাঠের এক কোণে একলা একটি মন্দির দাঁড়িয়ে। সেই মন্দিরের চূড়া সারা দিন শীতের রোদ পোহায়। মাঠের কালচে সবুজ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে কচি কলাপাতা রঙের ঘাসে ছাওয়া কয়েকটি গোলাকার জায়গা, সঙ্গে একটু নিচু জমি। বৃষ্টি হলে পানি জমে। শীতের এক বিকেলে দেখি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সেই হালকা সবুজ ঘাসে হাফ প্যান্ট পরা কয়েকজন সাহেব হাঁটাহাঁটি করছেন। প্রত্যেকের হাতেই একটি করে অদ্ভুতদর্শন বেটে লাঠি। লাঠির মাথাটা আরও অদ্ভুত। সাহেবরা সেই কচি ঘাসের দিকে নজর রেখে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন। শুনলাম, তাঁরা নাকি খেলার মহড়া দিচ্ছেন। এমনি করেই এক শীতের বিকেলে গলফ খেলার সঙ্গে প্রথম চাক্ষুষ পরিচয় হলো। এ মাঠই এখন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।
শীতের বিকেলের আগে একটি দৃশ্যের স্মৃতি এখনো মাঝেমধ্যে উঁকি দেয়। গুলিস্তানের পেছনে সেই আমলের রমনা রেস্ট হাউসের কাছেই ছিল রমনা পোস্ট অফিস। এরই পাশে কয়েকটি সুদৃশ্য ছোট বাংলো টাইপের বাড়ি। শীতের বিকেলে সেই রাস্তায় হাঁটতে বেরোলে চোখে পড়ত বাংলোর সামনের লনে ব্যাডমিন্টন খেলছে একঝাঁক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান তরুণ-তরুণী। তাদের সপ্রতিভ চলাফেরা, উচ্ছল হাসি ও ছন্দময় খেলার ভঙ্গিতে ছিল একরাশ লাবণ্য আর তারুণ্যের ছোঁয়া। এখন আর সেই বাংলো নেই, নেই সেই খেলোয়াড়েরাও। বহুদিন আগেই সম্ভবত বিদেশে পাড়ি দিয়েছে তারা।
বাঙালির কাছে শীত অর্থ সর্দিকাশি, জবুথবু, হাড়ে হাড়ে কনকনানি, গলাব্যথা ইত্যাদি। অভিযোগগুলো খুব মিথ্যে নয়, দরিদ্র ও বিপন্ন মানুষের কাছে এই ঋতু নিদারুণ কষ্টের। তীব্র শীতের প্রকোপে বহু শিশু প্রাণ হারায় প্রতিবছর। ক্ষণস্থায়ী হলেও শীতের নিষ্ঠুর রূপ প্রতিবারই দেখতে হয়। শহুরে শীতের অপচয়ী, বেহিসাবি চেহারাও আমাদের পরিচিত। অশন-ব্যসনের সংস্কৃতি, অপরিমিত পান-ভোজন আর বিনোদনের হুল্লোড় এ ঋতুতেই যেন বেশি। আবার অনেকের কাছে শীত মানে শুধুই ঝরাপাতা, রুক্ষতা জীর্ণতা আর ফসলবিহীন রিক্ত প্রান্তর। শীত গেলেই বাচি। শীত অর্থ বসন্তের জন্য একধরনের রোমান্টিক প্রতীক্ষার।
বৈষ্ণব কবিতায় বর্ষা নিয়ে কত উচ্ছ্বাস, অথচ শীত শুধুই কষ্টের। রবীন্দ্রনাথের গ্রীষ্ম ও বর্ষা নিয়ে উচ্ছ্বাসের কবিতা সবারই জানা। শরৎ ঋতুটিকেও তিনি জীবনস্মৃতির পাতায় এঁকেছেন বড় স্নেহে এমনই ভাষায়, ‘সে যেমন চাষিদের ধান পাকানো শরৎ তেমনি সে আমার গান পাকানো শরৎ...আমার সমস্ত দিনের অবকাশের গোলা বোঝা করা শরৎ।’ রক্তকবরীর ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে’ গেয়েই তার শীতের আনন্দ যেন থমকে গেল। গীতবিতান-এ কবির শীতের উপমাগুলোর দিকে তাকানো যাক। ক. ‘উড়িয়ে দেবার মাতন এসে কাঙ্গাল তারে করল শেষে।’ খ. ‘একি মায়া, লুকাও কায়া জীর্ণ শীতের সাজে।’ গ. ‘শীতের বনে কোন সে কঠিন আসবে বলে শিউলিগুলি ভয়ে মলিন বনের কোলে।’ তাঁর বেশির ভাগ গানেই কাঙাল করে দেওয়ার রিক্ততা, জীর্ণতা এ কাঠিন্যই যেন শীতের চিহ্ন গৌতম চক্রবর্তী হিসাব করে দেখিয়েছেন, গীতবিতান-এর প্রকৃতি পর্যায়ে শীতের গান মাত্র ১২টি, এর পাশে বসন্তের গান ১০৬টি; বর্ষার গান সবচেয়ে বেশি—১১৫টি।
শীতকে যথার্থ ভালোবেসেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। বারবার বলেছেন, কার্তিকের নীল কুয়াশার কথা। এই শীতে রূপসী বাংলার কবিই বাঙালির আধুনিকতম কবি।
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে শীত শুধু রিক্ততা ও জীর্ণতা নয়, এ ঋতু সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, আর বিজয়ের প্রতীক। আমাদের অধিকার আদায়ের সূত্রপাত বায়ান্নর এক শীতের সকালে শহীদের রক্তস্রোতে। পরে যা ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান পেরিয়ে ৭ মার্চের বজ্রকণ্ঠে মিশে স্বাধীন জন্মভূমির আহ্বান ছড়িয়ে দিয়েছিল। বীরের রক্তস্রোতে আর মায়ের অশ্রুধারায় স্নাত হয়ে একাত্তরের শীতের ১৬ ডিসেম্বরে স্বাধীনতার রক্ত-সূর্য আমাদের হাতে এল। এই শীতেই তো আমাদের স্বাধীনতার পবিত্র সূত্রপাত। আর এই শীতেই আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন—স্বাধীনতা। শোক আর শক্তির যুগলবন্দী এই শীতঋতু আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে অচ্ছেদ্য হয়ে আছে। অচ্ছেদ্য হয়ে রইবে চিরদিন।
মাহবুব আলম: প্রাবন্ধিক, সাবেক রাষ্ট্রদূত।
mahboob1122@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.