চরাচর-বিয়ের গান by পাভেল রহমান

বাংলা লোকসংগীতের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে বিয়ের গান। লোকসংগীতের অন্যান্য শাখার মতো ঠিক কবে থেকে এ বিয়ের গানের প্রচলন শরু হয়েছে, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা খুবই কঠিন। তবে খুব প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন বিয়ের উৎসবে মেয়েদের নাচ-গান করার উল্লেখ পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে ড. সুকুমার সেনের উক্তি প্রণিধানযোগ্য।


বিবাহ অনুষ্ঠানে মেয়েলি আচারের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল 'মঙ্গলগান'। ঋগ্বেদে যে বিয়ের মন্ত্রটি আছে তাতেও দেখতে পাই যে মেয়েরা গান গেয়ে কন্যার বসন পাট করছে। 'সর্যায়া ভদ্রমিদ বাসো গাথয়ৈতি পরিষ্কৃতম'। প্রাকৃত সাহিত্যেও যেসব মেয়ে বিয়ের উৎসবে গান করে তাদের 'মঙ্গল গায়িকা' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে বিয়ের গানের মূল্য স্বীকৃত হয়েছে। 'তস্মাদ বিবাহে গাধা গীয়তে' (মৈত্রায়ণী সংহিতা-৩-৭-৩-৩)। তবে অথর্ববেদের গৃহ্যসূত্র সম্ভবত প্রাচীনতম বিয়ের গানের উদাহরণ। হিন্দু বিবাহাচারে সেই প্রাচীনকাল থেকে বিয়ের গান অপরিসীম গুরুত্বের সঙ্গে পরিবেশিত হয়ে আসছে। এ বিষয়ে বিজয়ভূষণ ঘোষ মনে করেন, 'কামরূপের হিন্দুসমাজে বিবাহের বেদোক্ত মন্ত্রগুলো যেমন অপরিহার্য, বিংশ শতাব্দীর পূর্বে সেখানে বিয়ের গীতিগুলোও তদ্রূপ ছিল। তাই এসব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, এককালে বিয়ের গানগুলোর সঙ্গে ধর্মের প্রত্যক্ষ সংযোগ এবং এর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ছিল। সময়ের আবর্তে বিয়ের গান মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে মিশে গিয়ে আমাদের লোকসংস্কৃতিকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। বিয়ের গানগুলো সাধারণত ঘটক আগমন, গায়ে হলুদ ও কনে সাজানো থেকে শুরু করে কনে বিদায়, বাসরশয্যা ও বধূবরণ পর্যন্ত বিয়ের নানা কার্যক্রম নিয়ে নির্মিত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিয়ের গানগুলো নারীকণ্ঠেই বেশি গীত হতো। তাই একে মেয়েলি গীতও বলা হয়ে থাকে। বিয়ের গান সময়ের স্রোতে আমাদের সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্রেও একটা বড় জায়গা করে নিয়েছে। 'লীলাবালি লীলাবালি বড়ই যুবতি সইগো বড়ই যুবতি সইগো কী দিয়া সাজাইমো তরে'- এ গানটি তো মানুষের মুখে মুখে গাওয়া হয়। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর 'শ্রাবণ মেঘের দিনে' চলচ্চিত্রে যেমন ব্যবহার করেছেন 'কাইল আমরার কুসুম রানীর বিবাহ হইব/বিবাহ হইব কুসুম পিঁড়িতে বসিব/পিঁড়িতে বসিয়া কুসুম আলতা পরিব...। আবার অজিত মজুমদার পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যের নাট্যরূপ দিতে গিয়েও বিয়ের গানের ব্যবহার করেছেন। 'কী করো দোল্লাপের মা' লো বিভাবনায় বসিয়া, আসতাছে বেটির দামাল ফুর পাগড়ি উড়ায়া না রে/আসুক আসুক বেটির দামাল কিছুর চিন্তা নাই রে, আমার দরজায় বিছানায় থুয়ছি কামরাঙ্গার পাটি না রে...।' নাটক কিংবা চলচ্চিত্রে এর ব্যবহার হলেও মূলত বিয়ের গানের বিকাশ হয়েছে কালের পর কাল মানুষের মুখে মুখে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিয়ের গানকে ধারণ করেছে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিয়েছে এ গানকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের দু-একটি বিয়ের গান উল্লেখ করা যেতে পারে। পাটের শাড়ি পিইন্ধা গো ঝিধন/বাবার ছানমন খাড়া গো ঝিধন/বাবার ছানমন খাড়া/হাইস্য মুখে দে'র বিদায় বাবা যাইতাম বিদায়ের গান। সময়ের সঙ্গে চলতে চলতে বিয়ের গান যেন তার স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলছে। আমাদের গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় বিয়ের গানের প্রচলন বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো লক্ষ করা গেলেও নগর সংস্কৃতিতে বিয়ের গান যেন শুধুই বিনোদননির্ভর হয়ে যাচ্ছে। তাই তো আমরা দেখি বিশ্বায়নের প্রভাবে আমাদের অন্যান্য লোকসংস্কৃতির মতোই বিয়ের গান এখন হারিয়ে যাচ্ছে। আর এ জায়গায় চলে আসছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ব্যান্ড শো ও ডিজে পার্টি। তাই বিশ্বায়নের এ যুগে লোকসংস্কৃতির অন্যতম অংশ বিয়ের গান কি নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে? বিয়ের গান সম্পর্কে আমাদের এই প্রজন্ম কতটা জানে?
পাভেল রহমান

No comments

Powered by Blogger.