কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-মানুষই হয় অমানুষ by রণজিৎ বিশ্বাস

: আজ ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন করি। একান্ত ব্যক্তিগত। : ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার বেলায় যাঁদের অনুমতির প্রয়োজন হয়, সে পর্যায়ে আমি কোনো দিন আমার বুনো স্বপ্নেও পেঁৗছুতে পারব না। আপনি যেমন খুশি প্রশ্ন করতে পারেন, শুধু যতক্ষণ খুশি না করলেই হলো।


: যতক্ষণ খুশি নয় কেন।
নয় এ জন্য যে আমার শ্রমজীবনের ডাক আছে। সে ডাক বড় ভয়ংকর। সে ডাক যখন-তখন আমার কাছে পেঁৗছে যায় এবং টেনে-খিঁচে আমাকে জায়গামতো পাঠিয়ে দেয়। তবু আপনি করুন প্রশ্ন, আমি জবাব দেওয়ার চেষ্টা করি। কথা বলার সুযোগ আমি তো তেমন পাই-ই না।
: আপনি তো কখনো কখনো কোথাও কোথাও সামান্য লেখালেখির চেষ্টা করেন।
: হ্যাঁ, করি। চেষ্টাই করি শুধু। লেখা আমাকে দিয়ে হয় না। যাদের দিয়ে হয়, তাদের আমি মাথায় তুলে রাখি; যাদের দিয়ে হয় না কিন্তু তারা মনে করে যে তাদের দিয়ে হচ্ছে এবং খুব ভালোভাবে হচ্ছে, তাদের দিকে আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। তাদের দুঃসাহস ও আত্মবিশ্বাস আমাকে মুগ্ধতায় ডুবিয়ে রাখে, আমাকে কাঁপিয়ে দেয়। আমাকে ভাবিয়ে তোলে। মাঝে মাঝে আমাকে তাতিয়েও দেয়। বুঝি, এমন হওয়া উচিত নয়; তবু এমন আমার হয়। হয় হয়তো ঈর্ষার কারণেই। হয় হয়তো নিজের ব্যর্থতা সইতে না পারার কারণেই।
: লেখার বিষয় হিসেবে 'মানুষ'কে কেন অমন করে আঁকড়ে ধরলেন?
: মানুষ ছাড়া লেখার কোনো বিষয় কি কখনো হতে পারে। নাকি মানুষ ছাড়া মানুষের ভাবনার কোনো বিষয় হতে পারে! এ প্রশ্ন আমি নিজেকে করি এবং প্রতিবারই জবাব পাই 'না'। আপনি মানবতার কথা বলতে চান, মানুষ আসবে; আপনি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার কথা বলতে চান, মানুষ আসবে; মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার পরও যারা জাতির জন্য অবদানের স্বীকৃতিতে কোনো স্থাবর সম্পদ পুরস্কার পায়- তাদের কথা বলতে চান, মানুষ আসবে; আপনি যদি এদের বিপরীতে সত্য, সুরুচি, সুশিক্ষা, সত্যবাদিতা, সততা, আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও সুন্দরের কথা বলতে চান, মানুষ আসবে; আপনি যদি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জন্য কাঁদতে চান, মানুষ আসবে; আপনি যদি ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ, সংশয়বাদী, আস্তিক ও নাস্তিকদের কথা বলতে চান, মানুষ আসবে; আপনি যদি ধর্মবাণিজ্য ও সন্ত্রাসবেনিয়াদের বিষয়ে মুখ খুলতে কিংবা কলম ধরতে চান, মানুষ আসবে; আপনি যদি পীড়ক-বঞ্চক-উৎপীড়ক-প্রবঞ্চকদের উদ্দেশ্যে বিষবমনের মতো পবিত্র কর্তব্য পালন করতে চান, করতে পারেন, কিন্তু সেখানেও মানুষের কথাই আসবে; এদের এক পক্ষ মানুষ না হলেও যারা পীড়িত, বঞ্চিত, উৎপীড়িত ও প্রবঞ্চিত, তারা কিন্তু মানুষ। আপনি যদি রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে চান, আপনি যদি নজরুলের কথা বলতে চান, মানুষ আসবে; মাদার তেরেসা কিংবা মার্টিন লুথার কিংয়ের কথা বলতে চান, মানুষ আসবে; আপনি গীতবিতান-সঞ্চয়িতা-সঞ্চিতা ও গল্পগুচ্ছের কথা বলতে চান, মানুষ আসবে; আপনি যদি জাতীয় সংগীত, জাতীয় কবি ও জাতির রণসংগীতের কথা বলতে চান, মানুষকে বাদ দিয়ে পারা যাবে না। যদি কণ্ঠ থেকে রবীন্দ্রসংগীত মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রের কথা স্মরণ করেন, যদি জাতীয় সংগীত পাল্টাবার প্রবক্তাদের দুঃসাহসকে অক্ষম্য ভাবেন, যদি মানবপরিচয়ের ওপর জন্মপরিচয়কে যারা বড় মানে তাদের কথা বলতে চান, তাহলেও আপনাকে এক পক্ষে মানুষকেই দাঁড় করাতে হবে।
একই প্রশ্নে অনেক কথা বলে আমি আপনাকে ক্লান্ত করতে চাই না। গোটাগুটি এটুকুই বলি- বলার কথায়, ভাবার কথায়, লেখার কথায়, গানের কথায়, শিল্পের কথায়, ক্রোধের কথায়, ঘৃণার কথায়, আনন্দের কথায়, উল্লাসের কথায়, প্রাণের কথায়, টানের কথায় এবং প্রেম ও অপ্রেমের কথায় মানুষ আসবে, মানুষই আসবে এবং মানুষকেই আসতে হবে। আপনি যদি অমানুষের কথা বলতে চান, তাহলেও মানুষের কথাই আসবে। কারণ মানুষ ছাড়া কেউ অমানুষ হতে পারে না। পশু হওয়ার জন্যও মনুষ্যাবয়রের একটি প্রাণী দরকার।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.