প্রিয় শিক্ষক সফিউদ্দীন আহমেদ by সৈয়দ জাহাঙ্গীর

অনেক দিন আগের কথা। আমি তখন ছাত্র। সফিউদ্দীন স্যারের স্বামীবাগের বাসায় যেতাম, প্রায়ই ছুটির দিনে। এক তলার একটা পুরনো বাড়ি। ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকা চলে এসে বেশ কয় বছর অন্যত্র থাকার পর স্থায়ী বসবাসের জন্য এ বাড়িতে চলে আসেন।


বাসায় গেলে স্যার খুব খুশি হতেন। আমারও ভালো লাগত তাঁর কথা শুনতে। এমনিতেই ছিলেন খুব লম্বা সুঠাম চেহারার একজন সুপুরুষ। ব্যাক-ব্রাশ করা মাথাভরা কোঁকড়া চুল দেখলেই শ্রদ্ধায় ভরে যেত মন। ডিস্ক রেকর্ডে গান বাজিয়ে শোনাতেন আর নিজের কাজ নিয়েই আলোচনা করতেন। কম্পোজিশন, টেঙ্চার আর ছাপাই কলাকৌশলের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতেন। কিছুক্ষণ গল্প করে উঠে ভেতরে যেতেন, বলতেন- বসো, আসছি। কিন্তু স্যারের আর দেখা নেই। অনেকক্ষণ পর দুই পাল্লার দরজায় টানানো পাতলা একটা কাপড়ের পর্দা সরিয়ে স্যার ফিরতেন একটা ট্রেতে রাখা চারটা বিস্কুট আর দুই পেয়ালা চা হাতে নিয়ে। চারুকলার চত্বরে কফিনে রাখা স্যারের চেহারাটা দেখে মনে হলো এবার তিনি আর দরজার পর্দার আড়ালে নয়, আকাশের আড়ালে চলে গেছেন। সফিউদ্দীন স্যার আবেদিন স্যার বা কামরুল হাসানের মতো ছিলেন না। অল্প কথা বলতেন; কিন্তু খুব পরিষ্কার শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন। কথার মধ্যে পশ্চিম বাংলার টান স্পষ্টই বোঝা যেত। খুব রসিকও ছিলেন তিনি। ক্লাসে এক ছাত্র দেরি করে ঢুকছে দেখে সফি স্যার রসিকতা করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ...কিহে ঢুকছ না বেরুচ্ছো? ক্লাসে হয়তো জলরঙে ছাত্ররা কাজ করছে, স্যার পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছেন। ছাত্রটা ব্রাশ ঝেড়ে ফেলতেই স্যার চিৎকার করে বলতেন, এই কী করছ, কী করছ, গায়ে ছিটা লাগবে যে। তিনি সব সময় খুব পরিপাটিভাবে জামাকাপড় পরে ক্লাসে আসতেন। মাড় দেওয়া, ইস্ত্রি করা প্যান্ট-জামা পরে থাকতেন সব সময়। বলা বাহুল্য, এতে সবাই আকৃষ্ট হতো। আমি ড্রইং পেন্টিংয়ের ছাত্র হলেও তাঁর বিভাগে কাজ করেছি উডকাট, লিথোগ্রাফ এবং এচিংও করেছি। সফি স্যারের বীরভূমের দুমকার গ্রামের যেসব কাঠ খোদাই দেখেছিলাম আর্ট কলেজে ঢোকার পর পরই সেগুলো ছিল অসাধারণ। এত সূক্ষ্ম কারুকার্যে কাঠ খোদাই করা যায় তা তখন ভাবতেই পারতাম না। তারপর যখন দেখলাম তাঁর তামার প্লেটে খোদাই করা লম্বা, বাঁকা দীর্ঘ নিখুঁত এক একটা টানে প্লেট কেটে ছবি নির্মাণের দৃশ্য, তখন এগুলো অসম্ভব বলে মনে হয়েছে। সত্যিই তিনি একজন অসাধারণ শিল্পী ছিলেন। এমনিতে তাঁর কাজ দেখার সুযোগ খুব একটা হতো না। পঞ্চাশপূর্ব এবং পঞ্চাশের শুরু থেকে ষাটের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি তেল রঙে বেশ কিছু কাজ করলেও সত্তরের পর তাঁর কাজে আসে আমূল পরিবর্তন। উল্লেখযোগ্য মাছ ধরা, মাছ ধরার জাল, মাছ ধরা নৌকা ইত্যাদি। মাছ ধরা জালে ছবিটি সম্ভবত পাঁচ ফুট লম্বা এবং আড়াই ফুট খাড়া। ছবিটি আধা-বিমূর্ত রীতিতে আঁকা। গাঢ় নীল, হালকা নীল, হলুদ জমিন আর কালো রঙের রেখা দিয়ে আবদ্ধ করা নদী, আকাশ, নৌকা, মাছ-জাল এবং জেলের অবয়ব। এ সিরিজে অনেক কাজ করেছিলেন তিনি। বিস্মিত হই যখন দেখি একই ধরনের বিষয়; অর্থাৎ মাছ ও জাল নিয়ে তিনি ১৯৯১ সালে এঁকেছেন 'মাছ ও জাল' অন্য মাত্রার একটা ছবি, যার উপস্থাপনা একেবারে ভিন্ন। এখানে তিনি প্রায় বৃত্তাকার একটি জালের মধ্যে আটকেপড়া মাছের অবয়ব ফুটিয়ে তুলেছেন রঙও বদলেছে। এখানে লাল আর হালকা নীলের প্রাধান্য বেশি। আগের কাজের উপস্থাপনা ছিল সমান্তরাল ভূমি বিন্যাসে আর নব্বইয়ের দশকের ছবিগুলো ঠিক তার বিপরীত, লম্বাকৃতির। মজার ব্যাপার হলো, ছবির শিরোনাম নীল জল অথচ ছবির উপরাংশে স্পষ্ট রেখায় আঁকা একটি জালের নিম্নাংশ- কালো, বাদামি আর নীল-হলুদে সনি্নবেশিত। এই সময় তিনি একাধারে চারকোল ও ক্রেয়নে বহু উল্লেখযোগ্য ড্রইং করেছেন। এসব কাজেই তাঁর পূর্বেকার এচিং অ্যাকোয়টিন্ট কাজের যথেষ্ট সাযুজ্য আছে অথচ নিঃসন্দেহে সেগুলো ভিন্ন আঙ্গিক ও ভিন্ন মাত্রায় স্বতন্ত্র। স্যারের সঙ্গে তাঁর বাসায় ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মধ্যে তাঁর কাজ দেখার জন্য বহুবার তাগিদ দেওয়ার পর কখনোসখনো আলমারিতে গুছিয়ে (প্রায় লুকিয়ে) রাখা কাজের মধ্য থেকে কিছু কিছু কাজ দেখাতেন। সেগুলো বেশির ভাগই এচিং প্রিন্ট। কিছু কাজ ছিল চারকোল কষ্টিতে আঁকা। অপূর্ব সুন্দর ড্রইং এবং বিষয়ের বিস্তার দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বিশেষ করে তিনি যখন ওই সব ড্রইং নির্মাণের দক্ষতা অর্জনের পেছনে যে ধৈর্য, শ্রম আর সাহসের কথা বলতেন, একক প্রদর্শনী তিনি একেবারেই করতে চাইতেন না এবং করেনওনি। আমি শিল্পকলা একাডেমীতেও থাকাকালে '৭৭ থেকে '৯১ পর্যন্ত, কিছুতেই তাঁকে রাজি করাতে পারিনি। প্রদর্শনী করতে মাত্র কয়েক বছর আগে বেঙ্গল গ্যালারি থেকে সুবীর চৌধুরীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সফি স্যার রাজি হন এবং তাঁর একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এ দেশের সুধীজনের কাছে শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্পকলার প্রদর্শনী এবং ব্যাপক প্রচার গেল মাত্র কয়েক বছরের। তাঁর সংরক্ষিত শিল্পভাণ্ডার সবেমাত্র উন্মোচিত হয়েছে। তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে একটি উচ্চমানের আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। আর ঠিক এমনি সময়ে তাঁর চিরবিদায় খুবই মর্মান্তিক। নিভৃতচারী এই শিল্পী চিরদিনের মতো নিভৃতে চলে গেলেন। তবে বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে আধুনিক কলার পুরোধা হয়ে তিনি চির জাগরূক থাকবেন আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি।
লেখক : শিল্পী

No comments

Powered by Blogger.