চরাচর-ঐতিহ্যবাহী বলীখেলা by আলম শাইন

'বলি' এবং 'বলী' শব্দ দুটির উচ্চারণ প্রায় একই হলেও আলাদা অর্থ বহন করে। যেমন_যজ্ঞাদিতে হত্যাযোগ্য প্রাণী হচ্ছে 'বলি'। অন্যদিকে 'বলী' হচ্ছে শক্তিশালী বা বলশালী। যার অর্থ অনেকেই বুঝতে সক্ষম হননি। ফলে বলীখেলাকে 'বলি' মনে করে ভুলটি করে থাকেন।


প্রাচীনকালে রাজ-রাজড়ারা বা জমিদার-শ্রেণীর মানুষ বলবান বা কুস্তিগির পুষতেন। নিজেদের আভিজাত্যকে জাহির করার উদ্দেশ্যে মূলত তাঁরা কুস্তিগিরদের বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিতেন। তাদের দৈহিক শক্তির পরীক্ষা হতো বলীখেলার মাধ্যমে। এতে করে ওই রাজা বা জমিদার-শ্রেণীর মানুষটির কদর বেড়ে যেত রাজ্যে। সেই অভিজাত খেলাটিকে ধরে রাখতে এ দেশে সর্বপ্রথম উদ্যোগ নিয়েছেন চট্টগ্রামের বক্সিরহাট নিবাসী সওদাগর আবদুল জব্বার। তিনি বাংলা ১৩১৫ সালের ১২ বৈশাখ প্রথম বলীখেলার আয়োজন করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল খেলার মাধ্যমে যুবসমাজকে সংগঠিত করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করা। আমৃত্যু তিনি এ খেলার অর্থ জোগানদাতা এবং সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর খেলাটি পরিচালনা করতেন তাঁরই ভাতিজারা। বর্তমানে খেলাটি পরিচালনা করেন আবুদল জাব্বারের নাতিরা। তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেছেন বংশপরম্পরায় যাতে খেলাটি টিকে থাকে, সে ব্যবস্থা করে যাবেন। উল্লেখ্য, প্রতিবছর ১২ বৈশাখ চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে বলীখেলার আয়োজন হয়। প্রচুর লোকসমাগম ঘটে খেলাটিকে ঘিরে। তিন দিনব্যাপী মেলার আয়োজনও করে থাকেন কর্তৃপক্ষ। বর্ণাঢ্য মেলাটি বলীখেলার আকর্ষণ বালিয়ে তোলে আরো। এ পর্যন্ত ১০২তম বলীখেলা পেরিয়ে গেলেও এর ধরন পাল্টানো হয়নি আজও। সওদাগর আবদুল জব্বার বলীখেলা পরিচালনা করতেন যেমনি, ঠিক তেমনি এখনো পরিচালিত হয়। তখনকার মতোই খেলার আগে ঢাকঢোল বাজিয়ে প্রচারকাজ চালানো হয় এবং বলীরা তাঁদের সমর্থকদের নিয়ে ঢোল বাজিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তারপর ময়দানে সমবেত হয়ে হাজার হাজার জনতার সামনে কুস্তিখেলায় শামিল হন। খেলায় বহু দল অংশগ্রহণ করে থাকে। পরে চূড়ান্ত পর্যায়ে দুই বলীর প্রতিযোগিতা হয়। খেলাটি চট্টগ্রামের স্থায়ী কালচারে পরিণত হলেও বর্তমানে মিডিয়ার কল্যাণে সারা দেশের মানুষ খেলাটি নিয়ে উৎসুক থাকেন। এমন একটি ঐতিহ্যবাহী খেলার প্রতি সম্প্রতি জুয়াড়িদের কালো থাবা পড়ার খবর শুনে আমরা মর্মাহত হচ্ছি। যাতে ভবিষ্যতে জুয়াড়িদের কালো থাবা প্রসারিত না হয় সে কামনা আমাদের অব্যাহত রইল। আমাদের বিশ্বাস, জুয়ামুক্ত থাকলে জব্বারের বলীখেলাটি মানুষের মনে দাগ কেটে থাকবে আজীবন।
আলম শাইন

No comments

Powered by Blogger.