কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-শিক্ষায় নিহিত সমস্যার সমাধান by রণজিৎ বিশ্বাস

নিজের দেশের কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে যখন কেউ বলে, এখানে মানুষ ফুটপাথ হাঁটার জন্য ব্যবহার করতে পারে না দুটি কারণে- নির্মাণ সামগ্রী, যেমন ইট, বালু, নুড়ি, রড ইত্যাদির স্তূপীকরণ ও ওপেন এয়ার টয়লেট হিসেবে গ্রহণের জন্য, অথবা যখন কেউ বলে, এখানে ফুটওভারব্রিজে কোথাও মানববর্জ্যের নিঃসরণ করা হয় অথবা বসানো হয়


হকার-মার্কেট, তখন আমার খারাপ লাগে। কারণ প্রতিকারের কোনো ভাষা আমি তৎক্ষণাৎ খুঁজে পাই না হাতের কাছে।
কিন্তু আমার দেশের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা যখন কেউ বলে, আমি তার কারণ খুঁজে পাই। যেমন, তোমার দেশে সবকিছুতে দুটো ভাগ। পরিষ্কার দুটো ভাগ, কোনাকুনি দুটো ভাগ, পুরোপুরি বিপরীত দুটো ভাগ। ভাগগুলো যেমন আদায় কাঁচকলায়, যেমন তেলেজলে, যেমন চাউলে তেঁতুলে, যেমন বাঘে-মোষে, যেমন দা-কুমড়োয়, যেমন বুনো ওলে বাঘা তেঁতুলে, যেমন আউশ ধানের খইয়ে আর ঠাকুরঝিয়ের গালে।
আমি তখন বলি- তুমি হয়ে যাও আজ বকাউল্লা, আমি হই শোনাউল্লা। তুমি বলো, আমি শুনি।
তার আগে পাঠকের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য বলে রাখাই ভালো, এখানে দুজনই দেশের লোক। বাংলাদেশের। মাঝেমধ্যেই তারা দুটো পক্ষ নিয়ে পাতানো বিতর্কে মেতে ওঠে।
বকাউল্লা বলতে শুরু করে- তোমার দেশে এক পক্ষ শিক্ষিত, আরেকপক্ষ তার বিপরীত, একেবারে ধারেকাছেও নেই!
একপক্ষ সাধুতা, সুরুচি, সততা, উদারতা, আধুনিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধ, মানবতা ও রবীন্দ্রনাথের পক্ষে, আরেকপক্ষ তার বিপরীত।
একপক্ষ মানুষকে মানুষ মানার আগে দেখে সে কোন জাতের মানুষ, দেখে তার জন্মপরিচয় কী, দেখে কোন দিকে সে নত হয়। দেখে বিধাতার নামে বিদায় নেওয়ার সময় হাফেজ নামের পবিত্র শব্দটির আগে কারা খোদা জুড়ছে, কারা আল্লা জুড়ছে, দেখে হ্যান্ডশেক করার পর কে নিজের হাতের পাঞ্জাটিকে বুকে লাগাচ্ছে, কে লাগাচ্ছে না।
একপক্ষ যুক্তির জোরে কথা বলে, আরেকপক্ষ জোরের যুক্তিতে। দেশের সব শিক্ষিত, যুক্তিবাদী ও শীলিত-পরিশীলিত মানুষ একদিকে, আর তার বিপরীত মানুষগুলো আরেক দিকে। অর্থের বর্ণ আর জন্মের ক্ষণ পাল্টানো মানুষগুলো একদিকে, তার সঙ্গে সংশ্রবহীন মানুষগুলো অন্যদিকে।
যারা মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের ঘৃণা করে ও যুদ্ধাপরাধীদের কোনোভাবেই বঞ্চিত না করে বিলম্বে হলেও যথাপ্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে চায়, তারা একদিকে আর যারা তার বিপরীত তারা আরেক দিকে। সাহিত্য, সংগীত, কবিতা, শিল্পসংস্কৃতি ইত্যাদি যারা ভালোবাসে তারা একদিকে আর যারা তারা হাস্যকরভাবে ও জোরাজুরির সঙ্গে করতে চায় তারা আরেক দিকে।
যারা মানুষের মধ্যে আমাদের তোমাদের ভাগ ছাড়া দ্বিতীয় কিছু বোঝে না, তারা একদিকে, অন্যরা আরেক দিকে। একপক্ষ পরিচয়ের দোষে ও শিক্ষাবঞ্চিত কিছু হতভাগ্য মানুষের পরামর্শ নিয়ে বিপরীত বৈশিষ্ট্যের মানুষগুলোকে দলন ও পীড়ন করে, আরেকপক্ষ তার বিপরীত আচরণ করে।
একপক্ষ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পরিচালিত হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে পুনর্বাসন করে এবং মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক ভিনদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দেয়, আরেকপক্ষের মাথায় এসব কখনো ঢোকেও না। তারা মুক্তিযুদ্ধের দুশমনদের কখনো ক্রোড়ে বসে, কখনো অশুভ পক্ষপুটে আশ্রয় দেয়। একপক্ষ মানবপীড়ন ও মানববঞ্চনের জন্য বায়বীয় ভবনের জন্ম দেয়, আরেকপক্ষ তার সর্বনাশা বৈশিষ্ট্য টের পেয়ে তা থেকে দূরে থাকে।
এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার পর বকাউল্লা থামে। থামার আগে বলে, তুমি সব শুনলে শোনাউল্লা, এবার এর কারণ বলো।
শোনাউল্লা বলে- অনেকগুলো কারণ তোমার বিভক্তিকরণের মধ্যেই আছে। আমি শুধু দুটি কারণ বলবো, তাও খুব সংক্ষেপে। তোমার পছন্দ হয় কিনা দেখ। প্রথম কারণ মুক্তিযুদ্ধ। একপক্ষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে ও প্রাণে মনে করেছে; আরেকপক্ষ মুক্তিযুদ্ধ করেইনি, দুয়েকজন করেছে বলে পরিচিত হলেও করেছে সব তালেগোলে হরিবোলে। দ্বিতীয় কারণ শিক্ষা। একপক্ষ শিক্ষার স্পর্শ পেয়েছে, আরেকপক্ষ দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা পায়ইনি। যে বিধাতাকে তারা সাম্প্রদায়িক করে তুলেছে, তিনি সেদিকে তাদের নেনইনি। তারা বোঝার সুযোগই পায়নি যে শিক্ষা একাই পারে অনেক সমস্যার সমাধান দিতে।
লেখক : কথা সাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.