সফলদের স্বপ্নগাথা-তরুণদের কাছ থেকে আমি শিখি by রবিশংকর

জগদ্বিখ্যাত সেতারবাদক রবিশংকরের জন্ম ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল ভারতে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে যাঁরা বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেছেন, তাঁদের মধ্যে রবিশংকর অন্যতম। ১৯৭১ সালে জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনের যৌথ উদ্যোক্তা তিনি।


১৯৩০ সাল, আমার বয়স তখন মাত্র ১০ বছর। তখন আমার বড় ভাই নৃত্যশিল্পী উদয় শংকরের সঙ্গে প্যারিস সফরে গিয়েছিলাম ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য পরিবেশন করতে। মানে, আমার শুরুটা আসলে হয়েছিল নৃত্যশিল্পী হিসেবেই। পরে আমি আস্তে আস্তে নাচ ছেড়ে সংগীতের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠি। এর পাঁচ বছর পর ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের সান্নিধ্য পেলাম। তিনি হয়ে উঠলেন আমার গুরু। আমি আবার ভারতে ফিরে এলাম তাঁর কাছে তালিম নেওয়ার জন্য।
পাশ্চাত্যের সংগীতশিল্পের চেয়ে ভারতীয় সংগীত কিছুটা আলাদা। অন্যান্য সংগীতের ক্ষেত্রে প্রথমে সুর কম্পোজ করা হয়, তারপর শিল্পী সেই সুর অটুট রেখে বাজানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক সে রকম নয়। আমি যখনই মঞ্চে পারফর্ম করি, তখন আমার বাজানো সুরের ৯৫ শতাংশই একেবারে বদলে যায় আগের বারের চেয়ে।
‘এখন আমার বয়স ৯১ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে যশ-খ্যাতি এসব নিয়েই বাঁচতে শিখতে হয়েছে আমাকে। ১৯৬৬ সালের দিকের কথা, তখন আমি জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে কাজ শুরু করেছি। সে সময় একজন পপস্টার হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করেছিলাম আমি। যেখানেই যেতাম, সবাই আমাকে চিনে ফেলত। কিন্তু আমার সে ব্যাপারটা একদমই ভালো লাগত না। সে সময় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অনেক শ্রোতাই মনে করত যে আমি হয়তো ভারতীয় সংগীত বিসর্জন দিয়ে জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে কাজ শুরু করেছি। জর্জ হ্যারিসনের ‘বিটলস’ ব্যান্ডের ‘পঞ্চম সদস্য’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছিলাম আমি। তখন ভারতের সবাই বলাবলি করত, আমি পাগল হয়ে গেছি। কিন্তু আমি মনে করি, আমার সারা জীবনের কোনো একটা অংশ নিয়ে যদি আমি গর্ব করতে পারি, তবে তা হলো পশ্চিমাদের কাছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে জনপ্রিয় করে তোলা। যখন আমি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে পশ্চিমের মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিই, প্রথমে তারা এটা খুব একটা আমলে নেয়নি। এ রকম এক সময়ে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের কনসার্টে আমি টিউনিং করার সময় দর্শকেরা হঠাৎ তালি দিতে শুরু করে। তখন আমি তাদের অনুরোধে তাদের উদ্দেশে বাজাতে থাকি। এভাবেই আস্তে আস্তে সংগীতের এই অনন্য ধারাটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে পশ্চিমারা। সে ধারা আজও অটুট রয়েছে।
শুধু সংগীত নয়, পিকাসো আর মাতিসের আঁকা চিত্রকর্মের ওপরও আমার ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। এই কালজয়ী শিল্পীদের চিত্রকর্ম সংগ্রহে রাখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু আমার তো মিলিয়ন মিলিয়ন টাকা নেই, তাই সেটা সম্ভব হয় না। আমি সংগীতের অনেক ক্ষেত্রেই বিচরণ করেছি; কিন্তু যন্ত্রনির্ভর সংগীতের ব্যাপারে আমি কখনোই আগ্রহী হতে পারিনি। যন্ত্রনির্ভর সংগীত জিনিসটা আমাকে কেমন যেন অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
আমাকে একটা ব্যাপার বেশ পীড়া দেয়, আর সেটা হলো, আমি মনের দিক থেকে এখনো তরুণ রয়েছি, আমার মাথায় সংগীতবিষয়ক নিত্যনতুন হাজারো চিন্তা খেলা করে, কিন্তু আমার ৯১ বছরের জীর্ণ শরীর তা বাস্তবে রূপ নিতে দেয় না। আমি মনে করি, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো আমার পরিবার। আমি আমার পরিবার নিয়ে গর্বিত। আর কেউ যদি আমাকে মনে রাখতে চায়, তাহলে আমি চাই সে যেন আমাকে একজন সুরসাধক হিসেবেই মনে রাখে। এ সময়ের তরুণ শিল্পীদের আমি কোনো গৎবাঁধা উপদেশ দিতে চাই না; বরং আমি চাই তাদের কাছ থেকে শিখতে। তরুণদের সংগীতপ্রতিভা থেকে শিক্ষা নিতে চাই আমি।’
দ্য গার্ডিয়ানের একটি সাক্ষাৎকার অবলম্বনে অনুবাদ ফয়সাল হাসান

No comments

Powered by Blogger.