ইতি-নেতি-প্রয়োজন চিহ্নিত সমস্যার বাক্যহীন ত্বরিত সমাধান by মাসুদা ভাট্টি

বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে আন্না হাজারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিশ্বময় গান্ধীর পুনরাবির্ভাবের বার্তা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল মোর্চা সরকার এমনিতেই দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে নানাভাবে জনগণের সামনে নম্বর খুইয়েছে, ফলে আন্না হাজারে ইস্যুটি ভারত সরকারকে বেশ ভালোভাবেই নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে।


সম্প্রতি কলকাতায় অবস্থানকালে বাঙালি বিজ্ঞজনদের মাঝে আন্না হাজারেকে নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য শুনতে পাইনি। এমনকি নিখিল ভারত পত্রপত্রিকায়ও আন্না হাজারেকে নিয়ে বিজ্ঞজনদের মতামত একটু বিরুদ্ধবাদীই মনে হয়েছে। সেখানে সাধারণ জনগণই কেবল আন্না হাজারেকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছে বলে বোঝা যাচ্ছে। তবে সেলিব্রিটি বা মিডিয়ার কল্যাণে বিশিষ্টতা অর্জনকারীদেরও যে কেউ কেউ আন্নাকে সমর্থন দিচ্ছেন না, তা নয়। কিন্তু একটি বিষয় আমাকে আশ্চর্য করেছে খুব, সেটা হচ্ছে, আন্না হাজারে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে বেশ হেলিয়ে দিলেও কংগ্রেস নেতারা এ ব্যাপারে কোথাও কোনো কথা বলছেন না, ব্যতিক্রম প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। তিনি যা বলার সংসদে দাঁড়িয়ে বলে দিয়েছেন। দলের পক্ষ থেকে দলীয় মন্ত্রী, শরিক দলীয় মন্ত্রীসহ নেতাকর্মীদের নিঃসন্দেহে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে এ ব্যাপারে (শুধু কী এ ব্যাপারে? নিশ্চয়ই সব ব্যাপারেই) টুঁ-শব্দটি না করার জন্য। বাধ্য নেতা-কর্মী, মন্ত্রীরা তা মেনেও নিয়েছেন, কেউ কোনো কথা বলছেন না, শুধু দলীয় মুখপাত্ররা সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলে যাচ্ছেন দলীয় অবস্থানের কথা। আর সরকারের কথা তো ড. সিং বলেছেনই সংসদে। সুতরাং বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ কোথাও নেই। ভারতের মতো একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চালানোর জন্য এই গভীর নিঃশব্দময়তার যে কতখানি প্রয়োজন তা রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাত্রই জানেন এবং বোঝেন। আশা করা যাচ্ছে, অচিরেই কংগ্রেস সরকার আন্না-পর্ব থেকে বেরিয়ে আসবে কিংবা বলা যায় না, আন্না-পর্ব জতুগৃহ পুড়িয়ে ছারখারও করতে পারে সব কিছু। কিন্তু সেসব তো পরের ব্যাপার, জনগণের ব্যাপার। দল ও সরকার তো ঠিকমতো কাজ করছে, তাই না?
এবার তাকাই বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশে একেক সময় একেকটি বিষয় সামনে উঠে আসে, আর তা-ই নিয়ে শুরু হয় কীর্তন। সরকার বলে এক রকম, দলীয় মন্ত্রীরা বলেন এক রকম, নেতা-কর্মীরা বলেন আরেক রকম, আর তারপর গভীর রাতের টকশো-তে চলে তা-ই কথা-পর্ব নিয়ে ময়নাতদন্ত। এই কথা চালাচালি ক্ষতিকারক কিংবা এসবের প্রয়োজন নেই সে কথা বলছি না, কিন্তু এর বাড়াবাড়ি জাতি হিসেবে আমাদের অকর্মণ্যতাকেই স্পষ্ট করে তোলে বলে মনে হয়। মনে হয়, আমরা শুধু কথাই বলতে জানি, এত কথার মাঝে আমাদের আসল কাজ করার সুযোগ হারিয়ে যায়। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত যত মানুষ (খ্যাত এবং অখ্যাত) প্রাণ হারিয়েছে, পৃথিবীর অনেক দেশেই বড় কোনো মহামারিতে এত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে কি না সন্দেহ। সম্প্রতি মানিকগঞ্জে চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। একই দিনে আরো কয়েক জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আর গোটা সপ্তাহ যদি ধরি, তাহলে তালিকা বেশ লম্বা হবে। প্রতিবছর ঈদ উপলক্ষে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের লাশ হয়ে ঘরে ফেরার ঘটনা তো আমাদের অজ্ঞাত নয়। ঢাকা-চট্টগ্রামের পথে যেতে যেতে কতগুলো দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ির দেখা মেলে, তা যাঁরা এ পথে নিয়মিত যাতায়াত করেন তাঁরাই জানেন। প্রাণটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে গাড়িতে ওঠেন এবং জীবিতাবস্থায় গন্তব্যে পেঁৗছতে পারলে শুকরিয়া আদায় করেন, আর না ফিরতে পারলে কিছুদিন পত্রপত্রিকায় খবর, তারপর সব চুপচাপ। আমরা তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের মৃত্যুর জাতীয় শোকও কাটিয়ে উঠব, কেবল আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হব এই অপমৃত্যু প্রতিকারে।
সড়ক দুর্ঘটনা কেন ঘটে, তার কারণ বিশ্লেষণে আমি যাব না। কেবল চালকদের ত্রুটি, মন্ত্রীদের অকর্মণ্যতা কিংবা রাস্তা সংস্কারে সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করলে সত্যকে অস্বীকার করা হবে। এসব সড়ক দুর্ঘটনার অনেক কারণের কয়েকটি মাত্র, কিন্তু তার পরও এসব অগ্রাহ্য করার নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরকার এবং মিডিয়া যেন প্রতিপক্ষ হয়ে পড়ছে এ বিষয়ে। মিডিয়ায় রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়া মাত্রই সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা নেমে পড়ছেন তা খণ্ডানোর জন্য। এবং মিডিয়া সেই বক্তব্য উপস্থাপন করছে জনগণের সামনে। যেহেতু জনগণ ভুক্তভোগী, সেহেতু তাৎক্ষণিকভাবে খ্যাপে উঠছে। আগের মতোই এই পক্ষ-বিপক্ষের খ্যাপাখেপি কিছুদিন পরেই থেমে যাবে। ঈদুল ফিতর গেলে ঈদুল আজহা আসার আগেই মানুষ ভুলবে এই ঈদে ঘটে যাওয়া (যেন কিছু না ঘটে, তাই-ই চাই) যেকোনো দুর্ঘটনার কথা। জীবন যে থেমে থাকে না, বাঙালি হিসেবে আমরা বোধ করি সবচেয়ে ভালোভাবে তা প্রমাণ করে দিই।
এখন পশ্ন হলো, এই পক্ষ-বিপক্ষের বিবাদ-বিসংবাদ আমাদের কতটুকু সামনে নেবে? আমি বিগত কোনো আমলের কথা বলতে চাই না। বর্তমান সরকারের কথাই বলি। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে তিন বছরের কাছাকাছি। প্রথমদিকে যা বিগতের দোষ বলে জনগণ মেনে নিয়েছে, তিন বছর পর এসে তা বিগতের নয়, সম্পূর্ণ বর্তমানের ওপর পড়েছে স্বাভাবিকভাবেই। এবং এ কথাও মাথায় রাখাটা জরুরি যে আজকের যা কিছু ত্রুটি, যা কিছু অব্যবস্থা_তা গিয়ে পড়বে দুই বছর পরের নির্বাচনের ভবিষ্যতের ওপর। এ খুব স্বাভাবিক অঙ্ক। একটি ব্যাপার এখানে উল্লেখ করাটা জরুরি বলে মনে করছি, সেটা হচ্ছে, আজকে যা কিছু সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অব্যবস্থা বলে মিডিয়ায় উঠে আসছে, তার বেনিফিশিয়ারি কিন্তু সরকারই। সেটা কিভাবে? কোনো সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার মেয়াদের শেষদিকে যদি এ রকমভাবে সরকারবিরোধী কথাবার্তা ছড়ায়, তাহলে তা সংশ্লিষ্ট সরকারের জন্য আত্মহত্যার মতো ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। যেহেতু দুই বছর আগেই কথা উঠেছে এসব নিয়ে, সেহেতু সরকারের হাতে সময় রয়েছে এগুলো শোধরানোর এবং জনগণের সামনে তরতাজা ইমেজ নিয়ে হাজির হওয়ার। আজকে তাই বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগের তীর ছোঁড়া হচ্ছে, সরকার চাইলেই সে তীর ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবে অভিযোগকারীর দিকে। কারণ এখনো সময় রয়েছে দুই বছর। যদিও এ সময় খুব কম, তবুও সদিচ্ছা থাকলে এর মধ্যে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব। বিডিআর বিদ্রোহের মতো ভয়ংকর ঘটনা সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা যে সরকারের রয়েছে সে সরকার বর্তমান সময়ের ঘটনাবলি সামাল দিতে পারবে না, তা বিশ্বাস হয় না। এ জন্য সরকার প্রধান মন্ত্রিসভা বদলাবেন কি বদলাবেন না, সেটি তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত, তিনি যেভাবে পারেন সেভাবে পরিস্থিতি বদলাবেন_এটাই এখন সময়ের দাবি।

লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ
editor@ekpokkho.com

No comments

Powered by Blogger.