'মুক্তির গান' ও আমাদের মুক্তির পথ by লুৎফর রহমান রনো

মুক্তির গানে'র স্রষ্টা তারেক মাসুদ ও বৈদ্যুতিন মিডিয়ার পুরোধা সাংবাদিক মিশুক মুনীর ও তাঁদের সহকর্মীদের সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু দেশবাসী অভ্যস্ত মনে মেনে নিতে পারেনি। কারণ তাঁরা ছিলেন এই ভাগ্যাহত সমাজের মুখপাত্র। দুর্ভাগ্য, দুর্ভোগদণ্ডিত মানুষের মনের কথা, প্রত্যাশার কথা এবং প্রতিঘাতের কথা তাঁরা তাঁদের সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছেন।


বেঁচে থাকলে তাঁরা যে সাধারণ মানুষেরই কথা বলতেন, মানুষের জীবনের গান গাইতেন, তা মানুষের জানা হয়ে গিয়েছিল। এক আকস্মিক বজ্রপাত যেন এই গণমানুষের বুকের বাঁশি, মুখের ভাষা নিমেষে কেড়ে নিল। নিরুচ্চার সেই নিরীহ মানুষের অন্তঃকরণ কেঁদে উঠল, ফুঁসেও উঠল। গণমাধ্যমকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন সড়কব্যবস্থার তত্ত্বতালাশে। একাধারে কিছুদিন প্রকাশিত হলো সারা দেশের সড়ক যোগাযোগের বিকট-ভঙ্গুর ক্ষতচিত্র। বোঝা গেল যে খোদ নৌপরিবহনমন্ত্রীর সুপারিশে লাখ লাখ অদক্ষ হাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স তুলে দেওয়া হয়েছে।
একটু মনোযোগী হয়ে যদি আমরা দেখি, তবে স্পষ্ট হয়ে যায়, সরকারের দুর্নীতিপরায়ণ, দায়িত্বজ্ঞানহীন, দক্ষতাশূন্য মন্ত্রীরা সড়কের মোড়ে মোড়ে মৃত্যুফাঁদ তৈরি করছেন। জিইয়ে রাখছেন, প্ররোচিত করছেন। যোগাযোগমন্ত্রী এত দিন ধরে সারা দেশের সড়কগুলো ভেঙে ভেঙে আসছেন। আর নৌপরিবহনমন্ত্রী ভাঙা সড়কে ভাঙা গাড়ি চালানোর জন্য অদক্ষ চালক সরবরাহ করে চলেছেন। আহ্ কী অপূর্ব সমন্বয়! অনেকে বলে থাকেন আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়হীনতার কথা। এবার দেখে নিয়েছেন, নিশ্চয়ই সবাই। সমন্বয়ের সমুজ্জ্বল কীর্তি! পত্রিকার খবরে জানা গেছে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মোটরযান পরিদর্শক বলেছেন, 'এদের পরীক্ষা নেওয়ার সাহসই পায় না বিআরটিএ।' ২০০৯ সালে নাকি কথা উঠেছিল লাইসেন্স দেওয়ার আগে তালিকাভুক্তদের নূ্যনতম একটা পরীক্ষা নেওয়ার। কিন্তু তাও সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক পরিচয়ে এভাবেই সব সরকারের আমলে অদক্ষ ড্রাইভার লাখে লাখে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরেছে। আর, তার ফলে অকাতরে মানুষ মারা যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। আমাদের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা কেউই কিন্তু পায়ে হেঁটে চলেন না। কিন্তু সৌভাগ্য, তাঁদের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে না, তাঁদের প্রাণহানির ঘটনা, তাঁদের পরিবারে কেউ যে এমন বেঘোরে মারা গেছেন, তাও শোনা যায়নি। কারণ তাঁদের গাড়িতে ড্রাইভার নিয়োগে অভিজ্ঞ ও পরীক্ষিতদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের যাতায়াতের সড়ক 'ভিআইপি' চিহ্নিত এবং নিরাপদ।
তাঁরা নিরাপত্তা বেষ্টনীতে থাক, তাতে আমাদের যায়-আসে না। কারণ দেশটাই তো মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের। তা না হলে এই গরিব দেশের সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির সুবিধা তৈরি হতো কি? মজার ব্যাপার, বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য বলে খ্যাত, যাঁরা সংসদ বর্জন করে চলেছেন, তাঁরাও কিন্তু গাড়ি আমদানির সুবিধা বর্জন করছেন না। আর এই হলো আমাদের জননেতাদের যথার্থ পরিচয়। কোথাও রাস্তাঘাট ভেঙে, কোথাও জলাবদ্ধতায় জনগণ প্রায় অবরুদ্ধ। বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যুর হার। প্রান্তস্থ মানুষের আরো কত যে নিত্য সমস্যা, যা বলা না-বলা সমান কথা। কিন্তু মন্ত্রী-সংসদ সদস্য বা তথাকথিত জননেতাদের সুযোগ-সুবিধা আয়েশ-বিলাস বাড়ছে। তাঁরা নির্ভার, নিরাপদ। সাধারণ মানুষ নিয়ে তাঁদের আদৌ কোনো ভাবনাই নেই। থাকত যদি, তবে চক্ষুলজ্জার কারণে হলেও এই গাড়িবিলাসের সুবিধা নিতেন না কেউই, অন্তত জনগণের চিরদারিদ্র্যের প্রতি সহানুভূতিটুকু প্রকাশের জন্য।
এই যে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটল, তো ঘটলই। কষ্মিনকালেও এ দেশে কোনো জিনিসের দাম বাড়লে পরে আর কমেনি। সয়াবিন আর চিনি নিয়ে আরেক মন্ত্রীরত্ন_বাণিজ্যমন্ত্রী বছর বছর ধরে যা করলেন, তা দেশবাসী জানে। পরে তিনি অবশ্য একটি স্বাস্থ্যসম্মত সমাধান দিয়েছেন। বলেছেন কম করে খেতে। কম খেলে ব্যবসায়ীরা টের পাবে, জিনিসপত্রের দাম পড়বে। আহা, জয়তু মন্ত্রী মহাশয়! যে মন্ত্রী জানেন না তাঁর দেশের মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় কম খায় না বেশি খায়, সেই ব্যক্তিই হয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী! মন্ত্রী, আপনি জানেন কি, এ দেশে ১০ কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে? চরম অপুষ্টি ও অপুষ্টিজনিত রোগব্যাধির মধ্যে জীবনযাপন করে সাত কোটি মানুষ? নথিপত্রে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে দেখা গেলেও গ্রামে এর খুব একটা প্রভাব পড়েনি। দুঃখিত, এসব কথা তো আমাদের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের জানার কথা নয়। কারণ তাঁরা তো প্রায় সবাই শিল্পপতি সমাজের লোক। ক্ষুধা, অপুষ্টি, রোগবালাইর সঙ্গে পরিচয় থাকারই কথা নয়। তবুও তাঁরা এ দেশের 'জননেতা'! আর এমন হাজারো বৈপরীত্য, মিথ্যা ও ধাঁধার মধ্যে চলছে গরিব মানুষের দেশটি। তাই 'মুক্তির গান' আমাদের থেমে নেই। মুক্তিকামী মানুষের মধ্য থেকে পুনঃ পুনঃ জন্ম নেবে মুক্তির গানের রচয়িতা। সে আশা জেগেই থাকবে। বাণিজ্য-বৃত্ত ভাঙবেই এক দিন। ভোট-বাণিজ্য, ক্ষমতা-বাণিজ্য। ভোটে কোনোমতে টপকে এসে সরকার গঠন করতে পারলেই পোয়াবারো! মুনাফা আর মুনাফা...! আরাম-আয়েস, ধন-দৌলত! দল বা একটি গোষ্ঠী চিরদিনের জন্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করার বাসনায়, প্রয়োজনে তালেবানি শাসন কায়েম করার কথাও, চিন্তা করেছিল! আর এ জন্য প্রতিপক্ষকে সমূলে ধ্বংস করতে ২১ আগস্টের জন্ম দিয়েছিল। ভাগ্য ভালো দেশবাসীর! অন্ধকারের জাতকদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে এ দেশ। কিন্তু তাই বলে আমাদের আঁকাবাঁকা মুক্তির পথ এখন কেউ রুদ্ধ করে রাখবে, তা মেনে নেওয়া যায় না।

লেখক : সাংবাদিক


No comments

Powered by Blogger.